ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৪ জুন ২০২৫, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ফারুক ওয়াসিফ

আমরা ব্যর্থ হলে এ ক্ষমতাই আমাদের গলার ফাঁস হবে

প্রকাশিত: ২০:৪৪, ১৩ জুন ২০২৫; আপডেট: ২০:৪৯, ১৩ জুন ২০২৫

আমরা ব্যর্থ হলে এ ক্ষমতাই আমাদের গলার ফাঁস হবে

ছবি:সংগৃহীত

আজ যদি আমরা ব্যর্থ হই, তাহলে এই যে “পথ” বা “ক্ষমতা” বলে যেটাকে বোঝানো হয়—সেটাই আমাদের গলার ফাঁস হয়ে যাবে। যদি আমরা ভুল করি, তার দায় চরম হবে। টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে দেওয়া এক খোলামেলা আলাপে এ মন্তব্য করেন ফারুক ওয়াসিফ, যিনি বর্তমানে প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)-এর মহাপরিচালক, একইসঙ্গে একজন লেখক ও সাংবাদিক। 

তিনি বলেন,  "আমরা যে সময়ে এই দায়িত্বগুলো নিয়েছি, সেটা ছিল কেবল গণভুত্থানের প্রাথমিক বিজয়ের মুহূর্ত। মানে, পুরনো শাসকগোষ্ঠী তখনই শুধু পালিয়ে গেছে মাত্র। কিন্তু ঝুঁকি একবিন্দুও কম ছিল না। রাষ্ট্রের ভেতরেই তখনও তাদের লোকজন ছিল, অস্ত্রবল ছিল, টাকাপয়সা ছিল, সংগঠন ছিল। বিদেশি এক বড় শক্তিও তখন তাদের পক্ষেই অবস্থান করছিল। এবং সেই কার্যকলাপ আজও চলছে—এখনো বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে তারা সক্রিয়। সেই প্রেক্ষাপটে আমাদের কাছে দায়িত্বটা ছিল এই বিজয়টাকে পাহারা দেওয়া এবং একই সঙ্গে রাষ্ট্র মেরামত বা সংস্কারের যে চ্যালেঞ্জ—তা গ্রহণ করা। আমরা কিন্তু একেবারে ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে এই দায়িত্ব নিয়েছি। ধরেন, ১৯৭১ সালে যারা সেক্টর কমান্ডার হলেন, বা নতুন রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিলেন—তারা কিন্তু চরম ঝুঁকিতে ছিলেন। তাদের কেউ কেউ জীবন দিয়েছেন, কেউ জেলে গেছেন। তারা যদি পরাজিত হতেন, তাহলে হয়তো মেরে ফেলা হতো, নাহয় কারাবরণ করতে হতো। আমাদের বাস্তবতা ছিল ঠিক সেই রকম।"

তিনি আরো বলেন, "আজ যদি আমরা ব্যর্থ হই, তাহলে এই যে “পথ” বা “ক্ষমতা” বলে যেটাকে বোঝানো হয়—সেটাই আমাদের গলার ফাঁস হয়ে যাবে। যদি আমরা ভুল করি, তার দায় চরম হবে। তাই এই কাজটা কোনো ভোগের জায়গা নয়, এটা বিশাল চ্যালেঞ্জের কাজ। সেই চ্যালেঞ্জ এখনো রয়ে গেছে। এখনো হুমকি আছে। সুতরাং এটা আমরা ‘ক্ষমতা’ হিসেবে উপভোগ করছি—এমন না। কেউ যদি করে, করুক, আমি জানি না। কিন্তু আমার বেলায়, বা আমাদের মতো অল্প কয়েকজনের বেলায়, এটা আসলে একটা আত্মত্যাগের জায়গা। আমাদের নিজের মনটাই স্যাক্রিফাইস হয়ে গেছে।"

লেখক ও মতবাদ
ফারুক ওয়াসিফ বলেন, “আমাদের দেশে লেখকেরা আগে থেকেই কোনো এক মতবাদের মধ্যে ঢুকে যান। কেউ বামপন্থী, কেউ জাতীয়তাবাদী, কেউ ইসলামী ঘরানার লেখক হতে চান। এই পূর্বনির্ধারিত অবস্থান লেখকদের মনন ও দৃষ্টিকে সংকীর্ণ করে ফেলে।” তাঁর মতে, কৃষকের মতোই লেখককেও বাস্তবতার নিয়ম মেনে কাজ করতে হয়—নিজস্ব মতবাদে আবদ্ধ থেকে নয়, বরং সত্যের আলোকে পরিবর্তিত হতে হয়।

প্রতিষ্ঠানপ্রধান হওয়ার দায় ও সমালোচনার জবাব
বর্তমানে একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধান হওয়ায় কেউ কেউ সমালোচনা করেন—একজন “প্রগতিশীল লেখক” হিসেবে তিনি কেন রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে গেলেন? ফারুক ওয়াসিফ এই প্রসঙ্গে বলেন, “আমি যখন এই দায়িত্ব নিই, তখন গণজাগরণ প্রাথমিক বিজয় পেয়েছে, পুরনো শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা থেকে সরে গেছে। কিন্তু ঝুঁকি তখনও ছিল।”

তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, “এই দেশে ৭১ সালে যারা সেক্টর কমান্ডার ছিলেন বা নতুন রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তারাও জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন। আমার ক্ষেত্রেও তেমনই এক ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে দায়িত্ব নেওয়া হয়। পুরনো শাসকদের সহযোগী, অর্থবল, অস্ত্রবল, এমনকি বিদেশি মদত তখনও সক্রিয় ছিল।”

দায়িত্ব না উপভোগ
তিনি জোর দিয়ে বলেন, “এটা কোনো ক্ষমতা উপভোগের জায়গা না। এটা চরম পরিশ্রম ও আত্মত্যাগের জায়গা। আমি আমার মন ও সাহিত্যজীবনের একটা বড় অংশ স্যাক্রিফাইস করেছি।” কাজের চাপের কথা বলতে গিয়ে জানান, “প্রথম কয়েক মাসে প্রতিদিন ১৪–১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়েছে। একজন লেখক হিসেবে আমার স্বাধীনতা অনেকটাই হারিয়ে গেছে।”

লেখক, নাগরিক ও রাষ্ট্রকর্মীর দ্বন্দ্ব
এই মুহূর্তে তার সবচেয়ে বড় দ্বন্দ্ব নিজের সঙ্গে। তিনি বলেন, “আমি মূলত একজন ক্রিয়েটিভ লেখক ও কবি হতে চেয়েছিলাম। সাহিত্য ছিল আমার প্রকৃত জগৎ। কিন্তু রাষ্ট্রের সংকটের সময়ে দায়িত্ব না নিয়ে থাকা সম্ভব হয়নি। তাই আমি এই পথ বেছে নিয়েছি—যা হয়তো আমার ব্যক্তিগত সুখের জন্য উপযুক্ত না, কিন্তু সময়ের দায় মেটাতে হয়েছে।”

মূল্যায়ণ ও ভবিষ্যৎ
“যদি এই পথ ভুল হয়, যদি আমরা ব্যর্থ হই, তবে এই ক্ষমতা আমার জন্য গলার ফাঁস হবে,” বলেন ফারুক ওয়াসিফ। তিনি মনে করেন, ক্ষমতা শুধু ভোগের বস্তু নয়, বরং তা এক ধরনের দহন, আত্মত্যাগ ও নিরবিচার পরিশ্রমের অপর নাম।

সাক্ষাৎকারের শেষ দিকে যখন তার কাছে জানতে চাওয়া হয়—কোন পরিচয়ে তিনি নিজেকে দেখতে চান? তখন তিনি নিঃসংশয়ে বলেন, “আমি একজন লেখক ও কবি হিসেবেই থাকতে চাই।”

তথ্যসূত্রঃ https://www.facebook.com/share/v/16eNtx9g7j/

মারিয়া

আরো পড়ুন  

×