
.
মুসলিম জাহানকে জিলহজ মাসের আগমনী বার্তার জানান দিল আকাশে ওঠা নতুন বাঁকা চাঁদ। আরবি জিলহজ শব্দের অর্থ হজওয়ালা বা হজ স্মৃতিধন্য পবিত্র মাস। মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবন ও সালতামামির ক্ষেত্রে হিজরি সনের এ সমাপনী মাসের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ মহরম মাসে মুসলমানদের চিন্তা-চেতনায় আশুরার মাধ্যমে যে পূত পবিত্র ও দৃঢ় সংকল্পময় জীবনের অনুপ্রবেশ হয়, একে একে প্রত্যেক মাসের দায়িত্ব পালনের পর এক চরম উচ্ছ্বাস, পরীক্ষা, ত্যাগ ও প্রাপ্তির সমারোহ ঘটে জিলহজ মাসে পবিত্র হজ ও কোরবানির মাধ্যমে। সামর্থ্যবানরা এ মাসে পবিত্র হজের মহাসম্মেলনে নবী রাসূলদের (আ.) পুণ্য স্মৃতি বিজড়িত মক্কা- মদিনার বিভিন্ন বরকতময় স্থানে জিয়ারত ও উকূফ করে বিশেষ করে আল্লাহতায়ালার ঘরে তাওয়াফ ও চুমুদানে ধন্য হয়। পাশাপাশি বিশ্বের দেশে দেশে প্রায় মুসলিম পরিবারে শুরু হয় পবিত্র ঈদুল আজহার নামে খোদাতায়ালা প্রভুর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পিতা ইবরাহীম (আ.) ও প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (স.) এর অনুসরণে কোরবানি দানের মহোৎসবে।
কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে : ‘হে নবী (স.)! আপনাকে হেলাল বা নয়াচাঁদ সম্পর্কে প্রশ্ন করবে। আপনি বলবেন, এ চাঁদ হলো মুসলমানদের বার্ষিক ক্যালেন্ডার বিশেষত হজের।’ হজ ও কোরবানি সম্পর্কে আল কুরআনে একাধিক সূরা ও আয়াত নাজিল হয়েছে। এসব সূরায় হজ ও কোরবানির দৃশ্য মনোমুগ্ধকর করে বর্ণিত হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে : যারা কুফর করে এবং আল্লাহর পথে ও মসজিদে হারামে যেতে বাধা সৃষ্টি করে যাকে আমি প্রস্তুত করেছি স্থানীয় ও বহিরাগত সকল মানুষের জন্য সমভাবে (আমাকে ডাকার জন্য) এবং যে মসজিদে হারামে অন্যায়ভাবে কোনো ধর্মদ্রোহী কাজ করার ইচ্ছা করে, আমি তাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি আস্বাদন করাব। যখন আমি ইব্রাহীমকে বায়তুল্লাহর স্থান ঠিক করে দিয়ে বলেছিলাম যে, আমার সঙ্গে কাউকে শরিক করো না এবং আমার গৃহকে পবিত্র রাখ তাওয়াফকারীদের জন্য, নামাজে দ-ায়মানদের জন্য এবং রুকু-সিজদাকারীদের জন্য। আর মানুষের মধ্যে হজের উদ্দেশ্যে ঘোষণা প্রচার কর। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সর্বপ্রকার কৃশকায় উটের পিঠে সাওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে। যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থান পেঁৗঁছ এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করে তাঁর দেওয়া চতুষ্পদ জন্তু জবেহ করার সময়। অতঃপর তোমরা তা থেকে আহার কর এবং দুস্থ-অভাবগ্রস্তকে আহার করাও। এরপর তারা যেন দৈহিক ময়লা দূর করে দেয়, তাদের মানত পূর্ণ করে এবং এই সুসংরক্ষিত গৃহের তাওয়াফ করে। এটা শ্রবণযোগ্য। আর কেউ আল্লাহর সম্মানযোগ্য বিধানাবলির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলে পালনকর্তার নিকট তা তার জন্য উত্তম। উল্লিখিত ব্যতিক্রমগুলো ছাড়া তোমাদের জন্য চতুষ্পদ জন্তু হালাল করা হয়েছে। সুতরাং তোমরা মূর্তিদের অপবিত্রতা থেকে বেঁচে থাক এবং মিথ্যা কথন থেকে দূরে সরে থাক; আল্লাহর একনিষ্ঠ হয়ে, তার সঙ্গে শরিক না করে। এবং যে কেউ আল্লাহর সঙ্গে শরিক করল; সে যেন আকাশ থেকে ছিটকে পড়ল, অতঃপর মৃতভোজী পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল অথবা বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে কোনো দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করল। এটা শ্রবণযোগ্য। কেউ আল্লাহর নামযুক্ত বস্তুসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলে তা তো তার হৃদয়ের আল্লাহভীতি প্রসূত। চতুষ্পদ জন্তুসমূহের মধ্যে তোমাদের জন্যে নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত উপকার রয়েছে। অতঃপর এগুলোকে পৌঁছাতে হবে মুক্ত গৃহ পর্যন্ত। আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কোরবানি নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেওয়া চতুষ্পদ জন্তু জবেহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। (সূরা হজ : ২৫Ñ৩৪)।
আজ ২ জিলহজ ॥ পবিত্র জিলহজ মাসের আজ দ্বিতীয় দিবস। এ মাস নবী-রাসূলদের নানা পুণ্য স্মৃতিকথার, শিক্ষা ও আত্মোদ্দীপনার। কুরআন ও হাদিসের বিভিন্ন স্থানে মহামানবদের পদধুলিতে ধন্য বহু পাহাড়-পর্বতকে আল্লাহপাক খোদ নিজের স্মৃতি বলে উল্লেখ করেছেন এবং সেগুলোকে সম্মান করার জন্য তাগিদও দিয়েছেন। পাহাড়-পর্বত ধর্মীয় অনুষঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। হজরত মুহাম্মদ (স.) হেরা পর্বতের গুহায় ওহি হিসেবে আল্লাহর নিকট থেকে পবিত্র কুরআন শরীফ পান। সিনাই পর্বতে মহান আল্লাহ হজরত মুসাকে (আ.) দর্শন দেন এবং পবিত্র দশটি নির্দেশনা দান করেন।
শ্রীলঙ্কায় আদম শৃঙ্গ হলো একটা পবিত্র পাহাড়। তিনশ মিটার উঁচু এই পাহাড়টি দেশের সবচেয়ে উঁচুস্থানে অবস্থিত। কলম্বো থেকেও এই শৃঙ্গ দেখা যায়। আদম শৃঙ্গে শীর্ষস্থানে একটা বড় ধরনের পদচিহ্ন আছে। যা দৈর্ঘ্যে দুই মিটার, প্রস্থে এক মিটার। এই পদচিহ্ন মহামতি বুদ্ধের সিংহল সফরের প্রতœ-স্বাক্ষর বলে বৌদ্ধদের বিশ্বাস। মুসলিম ও আদি খ্রিস্টানদের বিশ্বাস, এটা প্রথম মানব আদমের (আ.) পায়ের চিহ্ন। মুসলিমরা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ হজরত আদমকে (আ.) বেহেশত থেকে সিংহলে অবতরণ করান এবং তার (আল্লাহ) নির্দেশ না মানার পরীক্ষা হিসেবে এক পায়ে খাড়া করে রাখেন। সেই থেকে কঠিন শিলায় হজরত আদম (আ.) ‘পদছাপ’ বসে যায়। শ্রীলঙ্কা বৌদ্ধদের নিকট আদম শৃঙ্গ সবসময়ে ‘শ্রীপদ’ বলে আদরণীয় ও পূজনীয়। রাজা/শ্রীপতিরা এই শৃঙ্গে ওঠার জন্য এবং অল্প আয়েশে ভ্রমণের সুবিধার্থে পথ নির্মাণ করে দেন।
আদম শৃঙ্গের উচ্চতা সাত হাজার তিনশ ষাট ফুট। শৃঙ্গটির আকৃতি উপবৃত্তাকার এবং পাঁচ ফুট উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। শত শত বছর ধরে এই শৃঙ্গে ওঠার বিরাম নেই। তবুও বৈদ্যুতিক বাতির বাহার ছাড়া এই পাঁচিলের স্থানিক কোনো পরিবর্তন হয়নি।
পাঁচিলের ভেতরের সমতল জায়গাটির (যাকে মালোভা বলা হয়) ঠিক মধ্যখানে নয় ফুট উঁচু একটা বেদি। এটাই চূড়ান্ত শৃঙ্গ। এই পাথর খ-টির সামান্য পশ্চিমের অংশটিতে একটা ছোট গুহা আছে। সম্প্রতি এটাকে প¬াস্টারিং করা হয়েছে। এই গুহার ভেতর পাঁচ ফুট দীর্ঘ একটা পদচিহ্নের নমুনা আছে। আদম শৃঙ্গের ঐতিহ্য হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাও ধারণ করতে চান। তাদের বিশ্বাস শিব কোনো এক সময় তার ধ্যানের জন্য এই শৃঙ্গটি বেছে নেন। তার অবস্থানের প্রমাণ তিনি এই পদচিহ্ন রেখে গেছেন এটা বিশ্বাস করেন শিবভক্তরা। (তথ্যসূত্র: দৈনিক আজাদী/ ২৩ সেপ্টেম্বর ৯৮)। সে যাই হোক, হজের মাসে মানবজাতির ইতিহাস ঐতিহ্য চর্চা করতে গেলে প্রথমেই আসে দুনিয়ার প্রথম মানব ও নবী মানবজাতির পিতা হজরত আদমের (আ.) কথা। সঙ্গে তার মহিয়সী স্ত্রী হাওয়ার (আ.) কথা, হজরত আদমকে যেমন শ্রীলঙ্কায় অবতরণ করিয়েছিলেন, তেমনি হাওয়াকে অবতরণ করিয়েছিলেন আরবের জেদ্দায়। হজরত আদম এবং তার স্ত্রী হাওয়া (আ.) একে অপরকে পাওয়ার জন্য প্রায় দুই থেকে আড়াইশ বছর কান্নাকাটি করতে করতে এদিক-ওদিক খোঁজাখুঁজি করতে থাকেন। অবশেষে হজরত আদম আল্লাহতায়ালার নামে হজের নিয়তে আরব দেশে পেঁৗঁছলে আদম হাওয়ার সাক্ষাৎ ঘটে। দুজনে মিলে মানবজাতির পক্ষ থেকে শোকরিয়া স্বরূপ হজ সম্পাদন করেন। রেখে যান আমাদের হজ করার নানা বরকতময় স্থানের ব্যবস্থাপনা। যে প্রান্তরে এ আদি মানব-মানবীর বহু কাক্সিক্ষত সাক্ষাৎ ঘটেছিল সে প্রান্তরের নাম আজ ‘আরাফা’। পবিত্র আরাফার ময়দান। নবীজী হজরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন, হজ মানেই তো আরাফায় অবস্থান করা। আর আরাফা শব্দের অর্থ পরস্পর পরিচিতি ও মিলন। যেখানে পরিচয় ঘটেছিল আদম হাওয়ার। দুজনে অশেষ আনন্দ ও শোকরিয়া লাভের মাধ্যমে একপর্যায়ে এ প্রান্তর অতিক্রম করে রজনী যাপন করেন মুযদালিফা উপত্যকায়। আজ সেটি হাজিদের একটি ওয়াজিব ইবাদত পালনের, বিনিদ্র রজনী খোদাতায়ালার নামে উপহার দেওয়ার পুণ্যস্থান।
আল্লাহপাক যেভাবে আদম হাওয়ার আঁখিজলের বারিধারায় তাদের গুনাহ মাফ করে মর্যাদার সর্বোচ্চ আসন দান করেছেন, আসুন আমরাও আদম সন্তানরা সে মন ও চোখ সৃষ্টি করি যা দিয়ে খোদার সন্তুষ্টি লাভ করা যায়।
প্যানেল