
নদীর পাশে দাঁড়িয়ে আছি। বাতাসে এক ধরনের নিঃশব্দ শব্দ—যেনো দূর অতীত থেকে ভেসে আসছে কুলি-মজুরের হাঁক, চায়ের কাপে ঠোকাঠুকি, আর রেলের সিটি। গাইবান্ধার ফুলছড়ির তিস্তা মুখ ঘাট—যা একসময় উত্তরাঞ্চল থেকে রাজধানীর পথযাত্রার প্রাণকেন্দ্র ছিল—আজ এক নির্জন ইতিহাস। তবুও, ইতিহাসেরা তো কখনও একেবারে হারায় না; তারা থেকে যায় মাটির গন্ধে, বাতাসের ভাঁজে, পুরনো লোহার মরিচায়।
১৯৯৮ সালের আগ পর্যন্ত এ ঘাট ছিল রংপুর-ঢাকা রেলপথের এক অনিবার্য যাত্রাবিরতি। ট্রেন এসে থামত এখানে। তারপরে শুরু হতো ফেরির যাত্রা, যমুনা নদী পার হয়ে বাহাদুরাবাদ ঘাট পর্যন্ত। ফেরিতে উঠত মানুষ, নামত মানুষের ঢল। কেউ হাতে ব্যাগ, কেউ কোলে শিশু। ঘাটে ছিল দোকান, খুদের হোটেল, মোড়ের চায়ের কাপে ঠোঁট রেখে তৈরি হতো পরবর্তী যাত্রার প্রস্তুতি।
এখন আর নেই সেই দৃশ্য। যমুনা সেতুর সৌজন্যে বদলে গেছে পথের ব্যাকরণ। কুলির হাঁক এখন শুধুই স্মৃতির শব্দ। দোকানের জায়গায় গজিয়েছে ঘাস, ট্রেনের শব্দ মুছে গেছে শীতল নীরবতায়।
তবু সব হারায়নি। এখনও সপ্তাহে দুদিন এখানে বসে হাট। কুড়িয়ে পাওয়া জৌলুসে টিকে আছে কয়েকটি দোকান। আর পাশে নতুন করে উঠে এসেছে একটি টি-বাঁধ, যেখানে এখনকার তরুণরা বেড়াতে আসে, ছবি তোলে, আকাশের নিচে নদীর গল্প শোনে।
মজার ব্যাপার হলো, মরচে ধরা ট্রেন লাইন এখনও দাঁড়িয়ে আছে। যেন লোহার হাড়গোড় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রাচীন জীবাশ্ম, যার শরীরে জেগে আছে হাজারো মানুষের পায়ের চিহ্ন, ক্লান্তি, ব্যস্ততা আর অপেক্ষা।
২৪ বছর পর এ ঘাটে এসে দাঁড়ানো একজন পুরনো যাত্রী বললেন, "সবকিছু বদলে গেছে, শুধু এই বাতাসটা একই আছে। এখানে দাঁড়ালেই মনে হয়, সময় থেমে গেছে কোথাও।"
তিস্তা মুখ ঘাট হয়তো আর আগের মতো বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র নয়, কিন্তু সে এখন ইতিহাসের একজন সম্মানিত প্রহরী। আর যারা একবার এখানে এসেছেন, তাদের মনে গেঁথে গেছে একরাশ শীতল, নষ্টালজিক ভালোবাসা।
আঁখি