
.
রাজধানীর একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন সঞ্চিতা। স্কুলপড়ুয়া তিন ছেলে আর স্বামীর সঙ্গে থাকেন রাজধানীর শান্তিনগরে। গত তিনদিন আগে প্রথমে জ্বর আসে বড় ছেলের। ভাইরাল মনে করে ওই দিনটা অপেক্ষা করেন। কিন্তু পরেরদিন ভোর রাতে ছোট দুই ছেলের গায়েও আসে জ্বর। তাও ১০২-১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইটের ওপর।
ডেঙ্গু আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে সকাল হতে না হতেই পার্শ্ববর্তী পপুলার ডায়াগনস্টিকে নিয়ে যান পরীক্ষা করাতে। ডেঙ্গু পরীক্ষায় নেগেটিভ আসে। কিন্তু লক্ষণ সব ডেঙ্গু রোগের। তাই এখন বাচ্চাদের বাসায় রাখবেন না হাসপাতালে নিয়ে যাবেন এই উদ্বেগে পার করছেন দিন। বলেন, দুশ্চিন্তায় মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এত এত ‘প্রোটেকশন’ সুরক্ষা দিয়েও যদি ডেঙ্গু হয় তাহলে কি করব ? মশারি, কয়েল, ওডোমস সব ব্যবহার করছি আতঙ্কে। একমাসে চারটা ওডোমস শেষ করছি। আরও বাসায় দুইটা এনে রাখছি। যাতে বাজারে পাওয়া না গেলেও সমস্যা না হয়। রোল অন লাগাই যখনই বাইরে যাই। অল্প সময়ের জন্য হলেও। এমন আতঙ্কে থাকলে পাগল হওয়া ছাড়া কোনো উপায় আছে? নগরকর্তাদের আর কি তাদের তো আর ডেঙ্গুও হয় না জ্বরও হয় না।
ক্ষোভ ঝড়ে পরছে মগবাজার এলাকার বাসিন্দা রিফাত চৌধুরীর কণ্ঠেও। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একমাত্র মেয়েকে ঘিরেই তার দুনিয়া। সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামী মারা যাওয়ার পর মেয়েকে অবলম্বন করে বেঁচে আছেন। সম্প্রতি দেশজুড়ে ডেঙ্গুর তীব্রতা বাড়ার পর থেকেই মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে আতঙ্কে অস্থির হয়ে থাকেন। ঘরদোর তো নিজে পরিষ্কার রাখা যায়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে যদি মশা কামড়ায়? শেষটায় তাই হলো, তিনদিনের জ্বরে আক্রান্ত মেয়ের পরীক্ষায় ডেঙ্গু পজিটিভ ধরা পড়ে। দেরি না করে রাজধানীর ডিএনসিসি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে ভর্তি করান। আর কোনো আত্মীয়-স্বজন না থাকায় একা একাই মেয়ের দেখাশোনা, চিকিৎসা সব করতে হচ্ছে। হাসপাতালের করিডোরে কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলেন, মেয়েটি হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে। কিন্তু কেউ নেই যে তার পাশে রেখে নিচে ওষুধ আনতে যাব। ওয়ার্ড বয়দের মাঝে মাঝে অনুরোধ করে পাঠাই এটা সেটা আনতে। বিনিময়ে দিতে হয় বাড়তি টাকা। কিন্তু প্রতিবার তো আর তা করা যায় না। তাই মেয়েকে একলা বিছানায় রেখেই নিচে নেমেছিলাম খাবার কিনতে।
এমন গল্প এখন রাজধানীর ঘরে ঘরে মায়েদের। নিজের সন্তানকে ডেঙ্গু থেকে বাঁচাতে মশারি, কয়েল, গুডনাইট, ওডোমস যে যা পারছে সব প্রয়োগ করছে। চেষ্টা করছে বাড়িঘর যথাসম্ভব পরিষ্কার রাখার। কিন্তু ‘গ্রামে আগুন লাগলে কি আর দেবালয় রক্ষা পায়’ এমন উক্তি করে বাড্ডার বাসিন্দা স্কুল শিক্ষিকা শর্মী আচার্যী বলেন, আমার স্বামী ব্যাংকে চাকরি করেন। একমাত্র ছেলে ইশানের বয়স ৩ বছর। ও যখন পেটে ছিল তখন আমি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১ সপ্তাহ হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। কি যে কষ্ট তখন হয়েছিল। এখন আবার যেভাবে ডেঙ্গু বাড়ছে ছেলের যদি ডেঙ্গু হয় সেই আতঙ্কে দিন-রাত চোখের পাতা এক করতে পারি না। এমন শহরে কতদিন সুস্থ থাকব আমরা? ডেঙ্গু না হউক আতঙ্কে আতঙ্কেই একদিন অসুস্থ হয়ে যাব। সরকারের উচিত এখন সমন্বিতভাবে এমন একটা পদক্ষেপ নেওয়া যাতে আর কোনো মায়ের কোল খালি না হয়।
কিন্তু ডেঙ্গুর কবলে কোল খালি হয়ে যাওয়া মায়ের দিন যে আর কাটে না। রাজধানীর শিশু হাসপাতালের বারান্দায় অসহায় দিন কাটাচ্ছেন বাংলাদেশ চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সিনিয়র স্টাফ নার্স রাহেনা খাতুন। দুই মেয়ে আর ঠিকাদার স্বামীকে নিয়ে সাজানো সংসার এক মুহূর্তে তছনছ হয়ে গেছে ডেঙ্গুর ছোবলে। ঘর আলো করে রাখা আট বছরের মেয়ে আফিয়া আঞ্জুমের মৃত্যুর পর একই শয্যায় চিকিৎসা নেওয়া ছয় বছরের ছোট মেয়ে তাসনিয়া তাসনিমের সুস্থতার আশায় দিন-রাত হাসপাতালেই পরে থাকছেন স্বামী-স্ত্রী।
কোনো রকমে কান্না থামিয়ে রাহেনা খাতুন বলেন, গত ৯ সেপ্টেম্বর হঠাৎ করেই জ্বর আসে বড় মেয়েটার। সঙ্গে অনেক বেশি ঠান্ডা আর দুর্বলতা দেখা দেওয়ার পরের দিনেই হাসপাতালে নিয়ে আসি। কিন্তু একদিন পরেই সে ডেঙ্গুর শক সিনড্রোমে চলে যায়। নেওয়া হয় পিআইসিইউতে (পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট)। কিন্তু সেখান থেকে আর সুস্থ হয়ে মেয়েটা আমার বুকে ফিরে আসল না। এরইমধ্যে ছোট মেয়েটারও ওঠে জ্বর। এখন শিশু হাসপাতালে বড় মেয়ে যে বিছানায় চিকিৎসা নিচ্ছিল সেই বিছানায় চিকিৎসা চলছে তার। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, সে সুস্থ হয়ে উঠছে। কিন্তু যে ধন আমরা হারালাম তা ফিরে পাবো কোথায় গেলে? পাশে থাকা আফিয়া-তাসনিয়ার বাবা আলমগীর হোসেন বলেন, ছোট মেয়ে ভর্তি ছিল হাসপাতালের ওয়ার্ডে। তারও শরীরে প্লাটিলেট কম ছিল। হাসপাতালে বলেছি এক মেয়েকে হারিয়েছি, সেই বেডেই আমার ছোট মেয়েকে রাখার ব্যবস্থা করে দিন। এরপর থেকে বড় মেয়ের সেই পিআইসিইউ বেডেই চিকিৎসা নিচ্ছে তাসনিয়া। তার শারীরিক অবস্থা এখন আগের চেয়ে ভালো। প্লাটিলেট বাড়ছে। চিকিৎসকরা আশা দিয়েছেন।
সাম্প্রতিক ডেঙ্গুর এই ঊর্ধ্বগতি আসন্ন অক্টোবরে আরও খারাপের দিকে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, ডেঙ্গুর ছোবলে মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি এবং আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না ডেঙ্গু। ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমরা সফল হচ্ছি না কেন? এটি নিয়ন্ত্রণে আদৌ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে কি? এ রকম বহু প্রশ্ন এখন নানাদিক থেকে উচ্চারিত হচ্ছে। তিনি বলেন, যে কোনো শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার কতগুলো মৌলিক নীতি রয়েছে। তার অন্যতম হচ্ছে শত্রুর সামর্থ্য, বিস্তৃতি, স্বভাব চরিত্র, আঘাত হানার ক্ষমতা ইত্যাদি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করা।
বিষয়টি ডেঙ্গু প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত ভাইরাসজনিত রোগ। এর বাহক হলো এডিস মশা। এর দুটি প্রজাতি দ্বারা ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমিত হয়। এগুলো হচ্ছে এডিস ইজিপ্টাই বা গৃহবাসী এডিস মশা এবং অন্যটি হলো এডিস অ্যালবোপিকটাস বা বুনো এডিস (এটাকে এশিয়ান টাইগার নামেও ডাকা হয়)। সাধারণভাবে গৃহবাসী এডিস ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক হিসেবে কাজ করে। কিন্তু মহামারির সময়ে বুনো এডিস মশাও ডেঙ্গুর বাহকে রূপান্তরিত হয়। ডেঙ্গুপ্রবণ দেশ বা অঞ্চলে ডেঙ্গু প্রতিরোধ পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য থাকে এডিস মশা নির্মূল করা। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে মশা মারার ওষুধ কেনা হচ্ছে, ছিটানো হচ্ছে কিন্তু মশা মরছে না। কারণ ওষুধগুলো মোটেই কার্যকর নয়। মাঝখান থেকে শুধু জনগণের করের শত শত কোটি টাকা খরচ হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা জানি পরিবেশ ও প্রতিবেশের প্রভাবে অন্যান্য প্রাণীর মতো মশার আচরণেও পরিবর্তন আসতে পারে। এজন্য মশা, বিশেষ করে এডিস মশার বাসস্থান, প্রজনন স্থল, আচরণ ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মিত গবেষণা করতে হয়। বাংলাদেশে এই কাজটি একেবারেই হচ্ছে না।
আর তাই ডেঙ্গুতে দেশ ভয়াবহ সময় পার করছে উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা আরও বলছেন, গত আগস্ট মাসে আক্রান্ত এবং মৃত্যুতে পূর্বের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে সেপ্টেম্বরেও। মাসের প্রথম ২০ দিনে মৃত্যু হয়েছে ২৭৪ জনের। আর আক্রান্ত হয়েছে ৫৩ হাজার ২ জন। থেমে থেমে বৃষ্টি সঙ্গে ভাদ্র মাসের গরমের তীব্রতা মশার প্রজননের জন্য খুবই উপযুক্ত হওয়ায় চলতি মাসে রোগীর সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর অন্যতম কারণ শুধু রাজধানী নয় দেশের সব জেলা-উপজেলায়ই ছড়িয়েছে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা। কিন্তু শুধু সিটি করপোরেশনে মশা মারার ওষুধ, যন্ত্রপাতি থাকলেও জেলা-উপজেলা বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে নেই কোনো ব্যবস্থা। ফলে এডিস মশার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করা ছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দাদের আর কোনো উপায় নেই।
এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই জানিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলেই খাবার পানির সংকট রয়েছে। ফলে ঢাকায় যেমন অনেক বাড়িতে পানি জমিয়ে রাখা হয় তেমনি ঢাকার বাইরেও অনেক এলাকায় বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখা হয় রান্না করার জন্য। আমরা সরেজমিনে এমন অনেক এলাকা দেখেছি যেখানে সিটি করপোরেশন কোনো সংস্থার পক্ষেই গিয়ে মশা মারা সম্ভব নয়। আবার এমনও অনেক এলাকা রয়েছে যেসব বাড়িতে এডিসের লার্ভা আমরা পেয়েছি যারা কোনোভাবেই এগুলোকে ডেঙ্গুর লার্ভা বলে স্বীকার করে নিতে নারাজ। এগুলোকে পানির পোকা বলে আমাদের তাচ্ছিল্যও করেছেন অনেকে। সিটি করপোরেশনের বাইরে মশা মারার পর্যাপ্ত কোনো ব্যবস্থা নাই ঠিক আছে। কিন্তু এসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে কে কিভাবে গিয়ে মশা মারবে? তিনি বলেন, বর্তমানে এডিস মশা যেভাবে ছড়িয়েছে তাতে ব্যক্তির সচেতনতা ছাড়া এটি নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসম্ভব।
তিনি বলেন, আমাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সুপরিকল্পিত নয়। রাস্তায় আবর্জনার স্তুপ। ছোট ছোট অনেক প্লাস্টিকের পাত্রে পানি জমে থাকতে দেখবেন। আমাদের অসংখ্য বহুতল ভবন রয়েছে, যার বেজমেন্টে রয়েছে কার পার্কিং। মানুষজন সেখানে গাড়ি ধুয়ে থাকে। যেসব পানি পরে জমে থাকে। যা মশার জন্য আদর্শ।
সরকারি হিসাবেই ৬৪ জেলায় ছড়িয়েছে ডেঙ্গু। কিন্তু ১২টি সিটি করপোরেশন এলাকা ছাড়া জেলা-উপজেলা শহর ও গ্রামে মশকনিধন কার্যক্রম খুব একটা চোখে পড়ছে না। সিটি করপোরেশন এলাকায় মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চললেও জনবল ও যন্ত্রপাতির অনেক ঘাটতি রয়েছে। তবে পৌর এলাকার পরিস্থিতি অনেকটাই নাজুক। উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে মশক নিয়ন্ত্রণের কোনো কার্যক্রমই নেই। কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া সব ইউনিয়ন পরিষদই মশা নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র, ওষুধ ও জনবলশূন্য।