ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

উচ্চ পর্যায়ে পদের চেয়ে কর্মকর্তা বেশি

প্রশাসন মাথাভারী

তপন বিশ্বাস

প্রকাশিত: ২২:৪৯, ২৩ মে ২০২৩

প্রশাসন মাথাভারী

উচ্চ পর্যায়ে পদের চেয়ে কর্মকর্তা বেশি

সিভিল প্রশাসন মাথাভারী হয়ে উঠেছে। উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে পদের চেয়ে কর্মকর্তা অনেক বেশি। আর নিচের দিকে পদের চেয়ে কর্মকর্তার সংখ্যা অনেক কম। নিচের দিকে কর্মকর্তার স্বল্পতার কারণে মাঠ প্রশাসনে কাজের স্থবিরতা তৈরি হচ্ছে। দেশে এসিল্যান্ডের ব্যাপক স্বল্পতা। সকল উপজেলায় নির্বাহী কর্মকর্তা পদায়ন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এতে উন্নয়ন কাজ ব্যাহত হচ্ছে। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়েও উন্নয়ন কর্মকা- ঠিকমতো চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
প্রশাসনের অর্গানোগ্রাম (সাংগঠনিক বা জনবল-কাঠামো) এখন উপেক্ষিত। পদায়ন ও পদোন্নতি কোনোটিই হচ্ছে না বিদ্যমান সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী। ফলে প্রশাসনের উচ্চ ও মধ্য পর্যায়ে নির্ধারিত পদের দুই থেকে আড়াই গুণ বেশি কর্মকর্তা থাকলেও নিম্নস্তরে আছে কর্মকর্তার সংকট। জনপ্রশাসন মাথাভারী হয়ে উঠেছে। অতীতে অপরিকল্পিতভাবে নিয়োগ প্রদান, পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ৪০ বছর আগের তৈরি জনবল কাঠামোতেই চলছে প্রশাসন। এই দীর্ঘ সময়ে দেশের জনসংখ্যা ও প্রশাসনের কর্মপরিধি ব্যাপকভাবে বাড়লেও হালনাগাদ করা হয়নি জনবল কাঠামো। প্রয়োজন অনুযায়ী কিছু মন্ত্রণালয় ও বিভাগে নতুন পদ সৃজন করে জোড়াতালি দিয়ে চালানো হচ্ছে। সরকারের উচিত বাস্তবতার নিরিখে বিদ্যমান জনবল-কাঠামো হালনাগাদ করা।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, চার দশক আগে ১৯৮৩ সালে এনাম কমিশন গঠন হয়েছিল। ওই কমিশনের তৈরি জনবল কাঠামো অনুযায়ী চলছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তর। প্রয়োজন অনুযায়ী কিছু কিছু দপ্তরে নতুন পদ সৃজনের মাধ্যমে জনবল কাঠামো হালনাগাদ করা হচ্ছে। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। আমরা চেষ্টা করছি, প্রশাসনকে পিরামিড আকৃতিতে ফেরত আনার। এ জন্য কর্মকর্তাদের পদোন্নতি কম দেওয়া হচ্ছে।
বর্তমানে প্রশাসনে সিনিয়র সচিব/সচিব পদ ৬৯টি। অথচ কর্মরত আছেন ৮০ কর্মকর্তা। অতিরিক্ত সচিবের ১৪০টি পদে কর্মরত আছেন ৩১৬ কর্মকর্তা। অর্থাৎ এ পদে ১৭৬ কর্মকর্তা বেশি। যুগ্ম সচিবের ৩৩২টি পদে আছেন ৮৪৭ কর্মকর্তা। এ স্তরেও ৫১৫ কর্মকর্তা বেশি আছেন। ৪৩০টি সুপারনিউমেরারি পদসহ উপসচিবের অনুমোদিত পদ ১ হাজার ৪২৮টি, কর্মরত আছেন ১ হাজার ৭০২ জন। অর্থাৎ এ স্তরেও ২৭৪ কর্মকর্তা বেশি। সিনিয়র সহকারী সচিব পদে ১ হাজার ৮৭৫ কর্মরত থাকলেও অনুমোদিত পদের সংখ্যা ২ হাজার ৯৭৫। অর্থাৎ পদসংখ্যার প্রায় অর্ধেক কর্মরত। আর সহকারী সচিব পদে ১ হাজার ৪৩৮ কর্মরত থালেও পদসংখ্যা ১ হাজার ৩৯৩। অর্থাৎ এ পদে কর্মকর্তার সংখ্যা পদের চেয়ে ৪৫ বেশি।
পর্যালোচনা করে দেখা যায়, উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত প্রতি স্তরে পদের চেয়ে অনেক বেশিসংখ্যক কর্মকর্তা আছেন। উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত তিন স্তরে অনুমোদিত পদ ১ হাজার ৪৭০টি। অথচ কর্মরত আছেন ২ হাজার ৮৬৫ কর্মকর্তা। অর্থাৎ অতিরিক্ত কর্মকর্তা ১ হাজার ৩৯৫ জন, যা অনুমোদিত পদের প্রায় দ্বিগুণ। পদ খালি না থাকায় পদোন্নতি পাওয়ার পরও অনেক কর্মকর্তাকে নিচের পদে কাজ করতে হচ্ছে। এমনকি কোনো কোনো যুগ্ম সচিবকে দিয়ে সিনিয়র সহকারী সচিবের কাজও করানো হচ্ছে।

আবার নিচের দুই স্তরে (সিনিয়র সহকারী সচিব ও সহকারী সচিব) অনুমোদিত পদের চেয়ে কর্মকর্তা অনেক কম থাকায় জনপ্রশাসনের সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে পড়ার পাশাপাশি কাজেও ব্যাঘাত ঘটছে। এ দুই স্তরের অনুমোদিত ৪ হাজার ৩৬৮টি পদে কর্মরত আছেন ৩ হাজার ৩১৩ জন। এ দুটি স্তরে শূন্য পদের সংখ্যা ১ হাজার ৫৫ জন। ফলে জনপ্রশাসনের পরিকল্পিত বা প্রচলিত পিরামিড আকৃতি ভেঙে মাথাভারী আকার ধারণ করেছে।
জানা গেছে, বিদ্যমান জনবল কাঠামো অনুযায়ী জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ২ জন অতিরিক্ত সচিব থাকার কথা।

সেখানে আছেন ৮ জন। ৫টি যুগ্ম সচিব পদে আছেন ২৫ জন। ২৩ জন উপসচিবের জায়গায় কর্মরত ৪৭ জন। অর্থাৎ অতিরিক্ত সচিবের অনুমোদিত পদের চার গুণ, যুগ্ম সচিব পদে পাঁচ গুণ, উপসচিব পদে দ্বিগুণ কর্মকর্তা আছেন। অন্যদিকে সহকারী সচিব বা সিনিয়র সহকারী সচিবের ৪৭টি পদের বিপরীতে কাজ করছেন মাত্র ২৯ কর্মকর্তা। অর্থাৎ নিচের দিকে অনুমোদিত পদের অর্ধেক কর্মকর্তা কর্মরত। প্রায় অভিন্ন চিত্র মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে ৩ জন অতিরিক্ত সচিবের জায়গায় আছেন ৬ জন, ৫ যুগ্ম সচিবের স্থলে কাজ করছেন ২৫ জন। আর সহকারী সচিব/সিনিয়র সহকারী সচিবের ৫৪টি পদের বিপরীতে কাজ করছেন মাত্র ১০ জন।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে অতিরিক্ত সচিবের অনুমোদিত ২টি পদে কাজ করছেন ৮ কর্মকর্তা। ৬ যুগ্ম সচিবের জায়গায় আছেন ১৪ জন। একইভাবে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের ৪ যুগ্ম সচিব ও ১৩ উপসচিবের পদে কাজ করছেন যথাক্রমে ১৪ ও ২২ জন কর্মকর্তা। অন্যদিকে সহকারী সচিব/সিনিয়র সহকারী সচিবের ২৯টি পদের বিপরীতে আছেন মাত্র ১০ জন।
অতীতে অপরিকল্পিতভাবে অতিরিক্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেয় তৎকালীন সরকার। যে কারণে প্রশাসন বিকৃত আকার ধারণ করে। সে ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ধরে রাখতে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া শুরু হয়। এই ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। আর এই কারণেই প্রশাসনের এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন প্রশাসনবিষয়ক কলামিস্ট ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার। তিনি বলেন, ‘পিরামিড আকৃতিতে ফেরাতে হলে পদ ছাড়া পদোন্নতি বন্ধ করতে হবে। উপসচিব পর্যায়ে পদোন্নতি ২৫ শতাংশের বেশি দেওয়া যাবে না। ওপরের দিকে পদসংখ্যা কম, তাই পদোন্নতির সংখ্যাও কমাতে হবে।
এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব (বিধি) ও প্রশাসনবিষয়ক বেশ কিছু গ্রন্থের প্রণেতা মো. ফিরোজ মিয়া বলেন, এনাম কমিশনের পর প্রশাসনিক সংস্কারের কোনো কমিশন গঠন করা হয়নি। গত চার দশকে দেশ অনেক দূর এগিয়েছে। লোকসংখ্যার পাশাপাশি প্রশাসনের কর্মপরিধিও বেড়েছে। জোড়াতালি দিয়ে ৪০ বছর আগের জনবল দিয়ে বর্তমান প্রশাসন বা মন্ত্রণালয় চালানো সম্ভব নয় না। তাই পদোন্নতির জন্য নয়, জনস্বার্থেই প্রশাসনের সাংগঠনিক কাঠামো দ্রুত হালনাগাদ করা উচিত।

×