ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

জাদুঘরে গণহত্যার সংবেদনশীল উপস্থাপনা

ভাস্কর্যের দিকে তাকিয়েও গা শিউরে ওঠে, চোখ জলে ভিজে যায়

প্রকাশিত: ২২:৩৭, ২১ মে ২০২২

ভাস্কর্যের দিকে তাকিয়েও গা শিউরে ওঠে, চোখ জলে ভিজে যায়

মোরসালিন মিজান ॥ একাত্তরের নির্মম গণহত্যা ও নিষ্ঠুর নির্যাতনের ইতিহাস তো কারও অজানা নয়। এর পরও ভাস্কর্যগুলো দেখে গা কেমন শিউরে উঠছে! চোখ ভিজে যাচ্ছে জলে। রিয়্যালিস্টিক ও ডিটেইল কাজ পুরনো প্রাচীন ব্যথা-ক্ষতগুলোকে জাগিয়ে তুলছে। জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারি ঘুরে দেখতে দেখতে ইতিহাস অনুসন্ধিৎসুরা নিজের অজান্তেই ফিরে যাচ্ছেন একাত্তরে। আর এ সুযোগটি করে দিয়েছে গণহত্যা জাদুঘর। খুলনার জাদুঘর সম্পর্কে এখন অনেকেই অবগত। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন আছেন এর মূলে। ফলে প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে আলাদাভাবে একাত্তরের গণহত্যা ও নির্যাতনের ইতিহাস যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা সম্ভব হচ্ছে। ২০১৪ সালের ১৭ মে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের এ জাদুঘর যাত্রা শুরু করে। সে অনুযায়ী, কদিন আগে অষ্টম বছর পূর্ণ করল। এ উপলক্ষেই ভাস্কর্য প্রদর্শনীর আয়োজন। শুক্রবার বিকেলে প্রদর্শনীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। তার আগে জাদুঘরের পক্ষ থেকে ভাস্করদের জন্য ফেলোশিপের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এর আওতায় পাঁচজন ভাস্কর তিন মাস কাজ করেন। এ তালিকায় ছিলেন রবিউল ইসলাম, ফারজানা ইসলাম মিলকি, মুক্তি ভৌমিক ও সিগমা হক অঙ্কন। মেটাল টেরাকোটাসহ কয়েকটি মাধ্যমে কাজ করেন তারা। জাদুঘরের ট্রাস্টি দেশের বরেণ্য শিল্পী হাশেম খানের পরামর্শ সহযোগিতা ছিল। আর ইতিহাসের জ্ঞান ও অহর্নিশ চর্চা নিয়ে ভাস্করদের পাশে ছিলেন মুনতাসীর মামুন। বুঝতে বাকি থাকে না শিল্পবোধ ও ইতিহাস চেতনা- এ দুয়ের সমন্বয় সৃষ্টিগুলোকে বিশিষ্টার্থক করে তুলেছে। ভাস্কর্য সাধারণত আকারও আকৃতিতে বড়সড় হয়। কিন্তু এ প্রদর্শনীর বেলায় বেছে নেয়া হয়েছে ছোট ফর্ম। তবে স্পেসের ভাল ব্যবহার ডিটেইলস লক্ষ্য করার মতো। প্রায় সবই ফিগারেটিভ কাজ। এসব কাজের মধ্য দিয়ে গণহত্যা ও নির্যাতনের অনেক ধরন স্পষ্ট করা হয়েছে। লক্ষণীয় যে, সব ধরনই ইতিহাস সমর্থিত। একাত্তরের খুব উল্লেখযোগ্য দলিল, নথিপত্র ও আলোকচিত্রের আশ্রয়ে ভাস্কর্যগুলো গড়া হয়েছে। দেশের নানা প্রান্তে আছে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য। সঙ্গত কারণেই এসবে বাঙালীর যুদ্ধ জয় ও বীরগাথা প্রাধান্য পেয়েছে। অন্যদিকে গণহত্যা ধর্ষণ অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনাবলী সেভাবে আসেনি। সাধারণের মনের প্রশান্তির কথা ভেবেই হয়ত নিষ্ঠুরতাকে শিল্পকর্মে রূপ দিতে যাননি শিল্পীরা। তবে একাত্তরে এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটেছিল। জাদুঘরকে সে সত্য তুলে ধরতে হয়। জাদুঘরের দায় তাই কাঁধে তুলে নিয়েছেন শিল্পীরা। সচেতন প্রয়াসের ফলে বিমূর্ত কোন উপস্থাপনা চোখে পড়ে না বললেই চলে। বরং পাকিস্তানীদের বর্বর কর্মকান্ডের চিত্র হুবহু উঠে আসতে দেখা যায়। গলায় ছুরি চালানোর মতো নৃশংস ঘটনা টেরাকোটা মাধ্যমে কে কবে দেখেছে? কিংবা অর্ধেক কুকুরে খাওয়া মরদেহ? ভাস্কর রবিউল ইসলাম অবলীলায় এই নিষ্ঠুর সত্যকে শিল্পকর্মে ধারণ করেছেন। টেরাকোটা মাধ্যমে চমৎকার কাজ করেছেন রেহানা ইয়াসমিন। প্রাণ বাঁচাতে ছুটে চলা মানুষ, ছুটতে ছুটতে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হওয়া মানুষদের বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন তিনি। তার টেরাকোটা ভাস্কর্যে গণকবরের উপস্থাপনা দেখে মন ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। একইভাবে আঁতকে উঠতে হয় সিগমা হক অংকনের বধ্যভূমি দেখে। ফারজানা ইসলাম মিলকির ভাস্কর্যে খুঁজে পাওয়া যায় ধর্ষিতা নারীকে। একাত্তরে পত্রিকায় প্রকাশিত একটি বিখ্যাত ছবি থেকে বীরাঙ্গনাকে তুলে এনেছেন মুক্তি ভৌমিক। খুঁটিতে হাত বাঁধা নগ্নপ্রায় নারীমূর্তি বাঙালীর আত্মত্যাগের ইতিহাসটিকে জোরালোভাবে তুলে ধরে। সব মিলিয়ে অনবদ্য প্রদর্শনী। গণহত্যার ওপর এ ধরনের আলাদা প্রদর্শনী দেশে আগে হয়েছে বলে জানা যায় না। প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কথাও কিছুটা বলতে হবে। অনুষ্ঠানে এদিন উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, বরেণ্য শিল্পী হাশেম খান, ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন, কবি তারিক সুজাত, চৌধুরী শহীদ কাদের প্রমুখ। এ ছাড়াও ভাস্কররা সবাই উপস্থিত হয়েছিলেন। ছিল সংক্ষিপ্ত আলোচনা। আলোচনা পর্বে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে একাত্তরের গণহত্যার মর্মস্পর্শী বিবরণ তুলে ধরেন কে এম খালিদ। নিজ জেলা ময়মনসিংহের নদীতে অসংখ্য মরদেহ ভেসে যেতে দেখেছেন তিনি। সেসব মরদেহ জলে ভাসতে ভাসতে বটগাছে এসে আটকে থাকত। বাঁশ দিয়ে সেগুলো ছাড়িয়ে দিতেন স্থানীয়রা। প্রতিমন্ত্রীর মুখে শোনা এ বিবরণ প্রদর্শনীকে যেন আরও যৌক্তিক করে তুলে। অনুষ্ঠানে হাশেম খান মুক্তির যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। আর মুনতাসীর মামুন ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষণায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারীদের প্রতি। বিশেষ করে আমলাতন্ত্রের সমালোচনা করেন তিনি। তবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বাঁচিয়ে রাখার পক্ষে জোরালো অবস্থানের কথা জানান অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলেই। ‘গণহত্যা ১৯৭১ পঞ্চ ভাস্করের যাত্রা’ শীর্ষক প্রদর্শনী চলবে ২৭ মে পর্যন্ত।
×