
স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বৈরী সাক্ষীদের মধ্যে সর্বশেষ যিনি বেঁচে ছিলেন সেই আবুল হোসেনও চলে গেলেন। রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রবিবার দিবাগত রাত দেড়টায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি (ইন্না... রাজেউন)। তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। সোমবার বিক্রমপুরের কামারগাঁওয়ের গ্রামের বাড়িতে সমাহিত করা হয় তাকে। আবুল হোসেনের ছয় সন্তান। মেঝ ছেলে শফিকুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, তার বাবা অনেকদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। হঠাৎ শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে গত ২৪ ডিসেম্বর জরুরী ভিত্তিতে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হৃদরোগ ছাড়াও কিডনিতে জটিলতা ছিল। পানি জমেছিল ফুসফুসে। এ অবস্থায় একাধিক হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। সর্বশেষ গেন্ডারিয়ার আলী আজগর হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
নিভৃতে জীবন কাটালেও, আবুল হোসেন ছিলেন বিরাট এবং গৌরবোজ্জ্বল এক ইতিহাসের অংশ। বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের একেবারে প্রাথমিক পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। স্বায়ত্ত শাসনের দাবিতে ১৯৬৬ সালে ছয়দফা কর্মসূচী ঘোষণা করেন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৬৭ সালের দিকে বিদেশী একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অবস্থায় আবুল হোসেন ছয়দফা কর্মসূচীর পক্ষে কাজ শুরু করেন। পাকিস্তানীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে গোপনে ছদ্মবেশে জরুরী তথ্য সংগ্রহ ও সরবরাহ করার দায়িত্ব ছিল তার। শেখ মুজিবসহ অন্যান্য নেতাদের কাছে নিয়মিতভাবে এসব তথ্য সরবরাহ করতেন তিনি। কিন্তু মুজিবের পরিকল্পনা সম্পর্কে একসময় ঠিকই জেনে যায় পাকিস্তানীরা। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে সেনাবাহিনীর কয়েকজন কর্মরত ও প্রাক্তন সদস্য এবং উর্ধতন সরকারী অফিসারদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। এ মামলাটিই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত। একই মামলায় গ্রেফতার করা হয় আবুল হোসেনকে।
আবুল হোসেনের এক সাক্ষাতকার থেকে জানা যায়, গোয়েন্দারা দীর্ঘদিন ধরেই তার গতিবিধি নজরদারিতে রেখেছিলেন। এক পর্যায়ে সব নিশ্চিত হয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়। প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় মালিবাগের ডিবি অফিসে। সেখানে রিমান্ডের নামে চলে নির্যাতন। পরে তাকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। ফোরটিন ডিভিশনের পেছনে একটি ব্যারাকে রেখে চলে নির্মম নির্যাতন। রাজবন্দীদের ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ প্রমাণ করতে তাকে রাজসাক্ষী করে পাকিস্তান সরকার। কৌশলগত কারণে প্রথমে তিনি সব তথ্য আদালতে প্রকাশ করবেন বলে জানান। কিন্তু আদালতের সামনে হাজির হয়ে বাংলাদেশের পক্ষেই অবস্থান স্পষ্ট করেন তিনি। এ কারণে এই সাক্ষীদের ‘বৈরী’ সাক্ষী বলা হয়। আবুল হোসেন ছিলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ২৫ নম্বর বৈরী সাক্ষী। জীবিত সর্বশেষ সাক্ষীর মৃত্যুতে ইতিহাসের তাৎপর্যপূর্ণ একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ইতি ঘটল। তবে তিনি চলে গেলেও, তার দেশপ্রেমের বোধ আত্মত্যাগ আগামীর বাংলাদেশকে নিশ্চয়ই পথ দেখাবে।