ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

যশোরের বিএনপি নেতা পরিকল্পিত হত্যাকান্ডের শিকার

প্রকাশিত: ০৫:১২, ২৫ নভেম্বর ২০১৮

 যশোরের বিএনপি নেতা পরিকল্পিত হত্যাকান্ডের শিকার

গাফফার খান চৌধুরী ॥ বুড়িগঙ্গা নদী থেকে উদ্ধার হওয়া যশোর বিএনপি নেতা ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশী আবু বকর আবু পরিকল্পিত হত্যাকা-ের শিকার। তাকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়। এরপর লাশ বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দেয়া হয়। হত্যাকা-ের মোটিভ ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দিতে লাশ ফেলে দেয়ার পর তারই পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ হিসেবে কৌশলে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় হত্যাকারীরা। নিহতের পরিবারের দাবি, বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে অথবা বিপুল জনপ্রিয়তার কারণে প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী হত্যাকান্ডের ঘটনাটি ঘটাতে পারে। লাশ পাওয়ার অন্তত আট ঘণ্টা আগে তাকে হত্যা করা হয়। তাকে পরিকল্পিতভাবে অপহরণের পর হত্যা করা হয়। আর লাশ ফেলে দেয়ার পর মুক্তিপণ চাওয়াটা ছিল হত্যাকারীদের বাহানা মাত্র। এমন টার্গেট কিলিংয়ের সঙ্গে কোন জঙ্গী বা সন্ত্রাসী বা সর্বহারা গোষ্ঠী জড়িত কি না তাও গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এমপি বলেছেন, বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী আবু বকর আবুকে অপহরণের পর হত্যার ঘটনার সঙ্গে নির্বাচনের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। তারপরেও বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছে। ঘটনাটির প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। নিহতের চাচাত ভাতিজা হুমায়ুন কবির সুমন জনকণ্ঠকে বলেন, নিহত আবু বকর আবু যশোর জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি। ব্যক্তি জীবনে তিনি অবিবাহিত। এক সময় ভাসানী ন্যাপের রাজনীতি করতেন। পরে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন। রাজনীতির কারণে বিয়ে পর্যন্ত করেননি। বিএনপির বিভিন্ন পদে ছিলেন। বিপুল জনপ্রিয়তার কারণে তিনি টানা চার বার যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার ৩নং মজিদপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। বর্তমানে তিনি ইউনিয়নটির চেয়ারম্যান। তার বাড়ি কেশবপুরের মজিদপুর ইউনিয়নের বাগদাহ গ্রামে। দুই ভাই সাত বোনের মধ্যে তিনি সবার বড় ছিলেন। পিতার নাম মৃত সদর উদ্দিন সরদার। এলাকায় খুবই জনপ্রিয় আবু বকর আবু জনতার চাপের মুখে যশোর-৬ (কেশবপুর) আসন থেকে বিএনপির এমপি প্রার্থী হিসেবে আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোয়নপত্র কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেন। সে সিদ্ধান্ত মোতাবেক তার ইউনিয়নের মেম্বার সাইফুল ইসলাম ও বিএনপি নেতা টিপুকে সঙ্গে নিয়ে তিনি গত ১২ নবেম্বর ঢাকায় আসেন। একই আসনে এমপি হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বিএনপির মনোনয়নপত্র কিনতে একই বাসে করে ঢাকায় আসেন আরেক মনোয়নপ্রত্যাশী কেশবপুর পৌর বিএনপির সভাপতি আবদুস সামাদ বিশ্বাস। তারা পরস্পর ঘনিষ্ঠ। যদিও আসনটিতে লবিংয়ের দিক থেকে এগিয়ে রয়েছেন বিএনপির আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও কেশবপুর উপজেলা সভাপতি আবুল হোসেন আজাদ। ২০০৮ সালের ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আবুল হোসেন আজাদ বিএনপির প্রার্থী ছিলেন। নিহত আবুর সহোদর ছোট ভাই আবুল কাশেমের ছেলে হুমায়ুন কবির জনকণ্ঠকে বলেন, তার চাচা ও আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী আবদুস সামাদ বিশ্বাস একই হোটেলের মুখোমুখি দুই রুমে ওঠেন। তার চাচা ছিলেন ৪১৩ নম্বর রুমে। আর সামাদ বিশ্বাস ছিলেন চাচার ঠিক সামনের ৪০৫ নম্বর রুমটিতে। আমি ঢাকায় থাকি। গত ১৮ নবেম্বর রাত আটটার দিকে আমি চাচার সঙ্গে দেখা করতে হোটেলে যাই। হোটেলে চাচার সঙ্গে দেখা সাক্ষাত হয়। কথাবার্তা বলি। সেখানে যশোর ও কেশবপুর বিএনপির নেতা মোস্তাফিজ এলাহী ও জহুরুল ইসলামসহ অনেকের সঙ্গেই দেখা হয়। ২০/২৫ মিনিট কথাবার্তা বলার পর আমি বিদায় নিয়ে নিচে নেমে যাই। নিচে স্থানীয় আরও লোকজনের সঙ্গে দেখা হয়। নিচে নেমে আবারও জহুরুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। তিনিও আরেকটি রুমে ওঠেছেন। তিনি আমাকে জোর করে তার রুমে নিয়ে যান। সেখানে হাল্কা নাস্তা করি। এরই মধ্যে আমার মোবাইল ফোনে চাচা ফোন করেন। ফোনে তিনি বলেন, আমি রমনা পার্কের কাছে আছি। সাইফুল মেম্বারকে ওরা আটকে রেখেছে। আমাকে মনে হয় মেরে ফেলবে। দ্রুত আমি চাচার রুমে যাই। রুমে গিয়ে চাচার কিছুই পাইনি। শুধু একটি গামছা ছিল। রুমে দেখি কেউ নেই। পরে রুমে থাকা টিপু চাচার সঙ্গে অন্য রুমে দেখা করে ঘটনা বলি। টিপু জানান, আমার কাছে মোবাইল ফোনের চার্জার চেয়েছিল। পরে তিনি নিজেই চার্জার নিয়ে আসেন। আমি অন্য পরিচিতদের রুমে যাই। এরপর আর কোন খবর জানি না। এরপর অনেকবার ফোন এসেছে। কিন্তু হ্যালো হ্যালো ছাড়া আর কিছুই শোনা যায়নি। পরে আমরা সিএনজি নিয়ে রমনা পার্কসহ আশপাশের এলাকায় খুঁজি। কোন হদিস নেই। সবার সঙ্গে পরামর্শ করতে করতে অনেক রাত হয়ে যায়। ওই রাতে আর থানায় যাওয়া হয়নি। পরদিন আমরা থানায় যাই। থানায় গিয়ে মৌখিকভাবে বিষয়টি বলি। তার চাচার বিষয়ে হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করে ঘটনা জানতে চাইলে তারা বলেন, তিনি স্বেচ্ছায় সবকিছু নিয়ে চলে গেছেন। ততক্ষণে বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ হয়। বাড়ি থেকে জানানো হয়, চাচা অপহৃত হয়েছে। অপহরণকারীরা প্রথমে দেড় লাখ টাকা চেয়েছে। রাতে আর টাকা দেয়া সম্ভব হয়নি। পরদিন সকালে অপহরণকারীদের দেয়া বিকাশ নম্বরে দেড় লাখ টাকা দেয় আমার এক ফুপাতো ভাই হুমায়ুন কবির পলাশ। দেড় লাখ টাকা দেয়ার পর অপহরণকারীরা আবার ৫০ হাজার টাকা দাবি করে। পরে আরও ২০ হাজার মোট ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা বিকাশ নম্বরে দেয়া হয়। টাকা পাওয়ার পর চাচাকে হোটেলের সামনে সকালেই ছেড়ে দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে যায়। চাচার কোন হদিস মিলছিল না। এরপর মোবাইল নম্বরগুলো বন্ধ করে দেয় অপহরণকারীরা। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, হোটেলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ জব্দ করা হয়েছে। জব্দকৃত ফুটেজ মোতাবেক গত ১৮ নবেম্বর রাত ৮টা ৩৪ মিনিটে আবু বকর আবু হোটেল ছেড়ে চলে যান। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি শাহ জামান জানান, গত ১৯ নবেম্বর বুড়িগঙ্গা নদীর চর খেজুরবাগ বেবী সাহেব ডকইয়ার্ড সংলগ্ন পানিতে ভাসমান অবস্থায় আবু বকর আবুর লাশ অজ্ঞাত হিসেবে উদ্ধার করা হয়। লাশটি উদ্ধারকালে বিভিন্ন জন মোবাইল ফোনে ছবি তুলে ফেসবুকে দেয়। পুলিশের তৈরি সুরতহাল রিপোর্টে শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন মেলেনি। লাশের সঙ্গে তার লাগেজ বা মোবাইল ফোনও উদ্ধার হয়নি। তাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে কি না তা রাসায়নিক পরীক্ষার পর জানা যাবে। নিহতের ভাতিজা হুমায়ুন কবির সুমনের দাবি, তিনি ফেসবুকে ছবি দেখেই স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে গিয়ে লাশ শনাক্ত করেন। লাশ পাওয়ার অন্তত আট ঘণ্টা আগে তার চাচাকে হত্যা করা হয়েছে বলেও চিকিৎসকদের দাবি। যদিও নিহতের শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন মেলেনি। তার চাচাকে হত্যার জন্যই পরিকল্পিতভাবে অপহরণ করা হয়েছিল। হত্যার পর অপহরণকারীদের টাকা চাওয়ার বিষয়টি ছিল বাহানা। মূলত ঘটনাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতেই এমন কৌশল নিয়েছে হত্যাকারীরা। দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল বা জনপ্রিয়তার কারণে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে তার চাচাকে অপহরণ করার পর হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দিয়েছে। কারণ তার ওইদিন বুড়িগঙ্গা নদীর কাছে যাওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না। কারণ নিখোঁজের পরদিন ১৯ নবেম্বর দুপুর আড়াইটায় বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়ে তার সাক্ষাতকার অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। বিষয়টি সম্পর্কে ডিএমপির রমনা বিভাগের উপকমিশনার মারুফ হোসেন সরদার জনকণ্ঠকে বলেন, হোটেলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ জব্দ করা হয়েছে। ফুটেজ নানাভাবে পর্যালোচনা করা হয়েছে। সার্বিক পর্যালোচনায় আবু বকর আবু হোটেল থেকে স্বেচ্ছায় বের হয়ে গেছেন বলে মনে হয়েছে। তবে কি প্রয়োজনে বা কারও ফোন পেয়ে বেরিয়ে গেছেন কি না তা জানা যায়নি। তা জানার চেষ্টা চলছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কেশবপুর উপজেলা বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে চলে আসা দ্বন্দ্বের আবু বকর আবু বলি হতে পারেন বলে স্থানীয়দের মধ্যে আলোচনা আছে। সেখানে বিএনপির দুটি কার্যালয়। একটিতে উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সদস্য আবুল হোসেন আজাদ এবং অপরটিতে পৌর বিএনপির সভাপতি সাবেক মেয়র আবদুস সামাদ বিশ্বাস ও নিহত আবু বকর আবু নেতৃত্ব দিতেন। স্থানীয় বিএনপির মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে আবু বকর আবু হত্যার ঘটনা ঘটতে পারে।
×