ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২

চারণ কবি মুকুন্দ দাস

একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি, হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে...

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১৪ নভেম্বর ২০১৭

একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি, হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে...

খোকন আহম্মেদ হীরা ॥ ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি, হাসি হাসি পরব ফাঁসি, দেখবে জগতবাসী।’ ক্ষুদিরামের ফাঁসি উপলক্ষে রচিত এই অমর গানের স্রষ্টা কবি মুকুন্দ দাস। ব্রিটিশবিরোধী জাগানিয়া এমন সব গণসঙ্গীত আজও প্রাণ ছুঁয়ে যায় মুক্তচিন্তার মানুষের। মুকুন্দ দাস এমন অনেক গান বানিয়ে, গান শুনিয়ে যেমন আন্দোলিত করেছিলেন স্বদেশীদের, বিপ্লবের ঝাণ্ডায় রসদ জুগিয়েছিলেন কবিতা, নাটক ও যাত্রাপালায়। তেমনি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। উপ-মহাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে তার খ্যাতি। অন্ধ-কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে দেশ মাতৃকার সাধনায় জাতিকে উদ্বুদ্ধ করা চারণ কবি মুকুন্দ দাসের জাগরণের গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-‘ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে, মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে।/ তাথৈ তাথৈ থৈ দ্রিমী দ্রিমী দং দং, ভূত পিশাচ নাচে যোগিনী সঙ্গে।/ দানব দলনী হয়ে উন্মাদিনী, আর কি দানব থাকিবে বঙ্গে।/ সাজ রে সন্তান হিন্দু মুসলমান, থাকে থাকিবে প্রাণ না হয় যাইবে প্রাণ।/ লইয়ে কৃপাণ হওরে আগুয়ান, নিতে হয় মুকুন্দরে নিওরে সঙ্গে।’ এসব জাগরণের গানে উত্তাল হয়েছিল পুরোবাংলা। মুকুন্দ দাসের পূর্বপুরুষেরা বিক্রমপুরের হলেও তিনি (মুকুন্দ দাস) শৈশব থেকেই বেড়ে ওঠেন বরিশালে। কুড়ি বছর বয়সে কোনরকম সার্টিফিকেট ছাড়াই পড়ালেখার ইতি টানেন মুকুন্দ দাস। তার পারিবারিক নাম ছিল যজ্ঞেশ্বর দে। পড়ালেখায় মন ছিল না। তার বাবা তাকে বলে কয়ে দোকানদারিতে বসিয়ে দেয়ার পর পরিচয় হয় এক গানের দলের সঙ্গে। যুক্ত হন ওই দলের প্রধান সহায়ক হিসেবে। কীর্তনিয়া হিসেবে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে তার নামডাক। কীর্তন গানের পাশাপাশি নিজে গান লিখে গাইতে শুরু করেন। এভাবেই বেড়ে ওঠে মুকুন্দ দাস। তখনও ‘মুকুন্দ’ নাম প্রচারিত হয়নি। সবাই ডাকে ‘যজ্ঞা’। কীর্তনের আসরে, গানের আসরে ডাক পড়ে। এরমধ্যেই ১৯০০ সালে ২২ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেন। এর পরপরই রামানন্দ ঠাকুরের কাছে দীক্ষা নেন। তিনিই তার নাম রাখেন মুকুন্দ দাস। ১৯০৩ সালে বরিশাল আদর্শ প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় মুকুন্দ দাসের প্রথম বই ‘সাধন-সঙ্গীত’। বরিশালের অশ্বিনী কুমার দত্তের সংস্পর্শে রাজনীতিতে আকৃষ্ট হন মুকুন্দ দাস। ওইসময় থেকে বিপ্লবী অশ্বিনী কুমার দত্তের সঙ্গে তার সম্পর্ক গুরু-শিষ্য পর্যায়ে উন্নীত হয়। স্বদেশিকতার চর্চা এখান থেকেই শুরু হওয়ার পর মুকুন্দ দাস ক্রমেই বৈষ্ণব ধারণা থেকে সরে আসতে থাকেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বরিশালে তুমুল ইংরেজবিরোধী বিক্ষোভ দেখা দেয়। মুকুন্দ দাস নিজে এই বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করে ইংরেজ বিরোধী বক্তব্য প্রকাশ করেন এবং একের পর এক গান, কবিতা ও নাটক রচনা করে বাঙালীর জাতীয় জীবনে নতুন উদ্দীপনার সঞ্চার করেন। ১৯০৪ সালের দিকে কালীসাধক সোনাঠাকুর দ্বারা প্রভাবিত হন মুকুন্দ দাস। ১৯০৫ সালে রচনা করেন প্রথম পালাযাত্রা ‘মাতৃপূজা’। যাত্রার মধ্যদিয়ে স্বদেশী আন্দোলনের ধারাকে আরও জাগরিত করেন। ওই যাত্রাপালার পা-ুলিপি বাজেয়াপ্ত করে তৎকালীন পুলিশ। যাত্রাদল গড়ে সারাদেশ ঘুরে বেড়াতে থাকেন মুকুন্দ দাস। যাত্রা থামিয়ে তিনি মাঝেমধ্যেই বক্তৃতার ঢঙ্গে সমকালকে তুলে ধরেন। মুকুন্দ দাসের যাত্রাপালা ও গান ব্রিটিশ শাসকের ভীতির কারণ হয়ে ওঠে। তাই ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়ে ১৯০৮ সালে গ্রেফতার হন মুকুন্দ দাস। ১৯১১ সালের প্রথমভাগে দিল্লী কারাগার থেকে তিনি মুক্ত হন। এর মধ্যেই তার স্ত্রী সুভাষিণী দেবী মৃত্যুবরণ করেন। জেলফেরত মুকুন্দ অল্প ব্যবধানে আবার বেরিয়ে পড়েন গান-যাত্রাপালা নিয়ে মুক্তিকামী মানুষের সঙ্গে বিপ্লবীর বেশে। ভারতবর্ষের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে পড়ে তার নাম। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, প্রিয়ম্বদা দাস, স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু ও সুভাষ চন্দ্র বসু তার গান ও যাত্রাপালায় মুগ্ধ হন। মুকুন্দ দাসের রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-মাতৃপূজা, সমাজ, আদর্শ, পল্লীসেবা, সাথী, কর্মক্ষেত্র, ব্রহ্মচারিণী, পথ ইত্যাদি। এক সময়ে বিভিন্নভাবে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে মুকুন্দ দাস বরিশালের কাশীপুরে কালী মন্দিরের জায়গা ক্রয় করেন। যা এখন বরিশালের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল নথুল্লাবাদ এলাকায় ‘চারণকবি মুকুন্দ দাসের কালীবাড়ি’ নামে পরিচিত। বাস টার্মিনালের কাছেই হালকা সবুজ রঙের দেয়ালঘেরা জায়গাটির বহিঃভাগে বেশ কয়েকটি দোকানের সন্নিবেশ। কেন্দ্রভাগে একটি সুউচ্চ প্রবেশ তোরণ। অনলঙ্কৃত সেই তোরণের উপরিভাগে লেখা ‘চারণ কবি মুকুন্দ দাস প্রতিষ্ঠিত কালী বাড়ি’। বিকানীর রাজার সহযোগিতায় নথুল্লাবাদে যে কালীবাড়িটি গড়ে তোলেন মুকুন্দ দাস, এটাই সেই কালীবাড়ি। ঐতিহাসিক গুরুত্বে সমৃদ্ধ কালীবাড়িটির জায়গা ছিল ৮৭ শতক, এখন আছে মাত্র ১৯ শতক। বাকিটা বেহাত হয়ে গেছে। বর্তমান স্থানটুকু ঘিরে আছে ছাত্রাবাস, লাইব্রেরি, দাতব্য চিকিৎসালয় এবং পূজামন্দির। সামনের কিছু অংশে আছে একসারি স্টল। মুকুন্দ দাসের স্মৃতিরক্ষায় এখন ওইটুকুই নীলমণি হয়ে আছে। এছাড়া মুকুন্দ দাসের গান এবং সৃষ্টিকর্ম নিয়ে বিছিন্নভাবে কিছু কাজ হচ্ছে বরিশাল ও ঢাকায়। কেউ কেউ তাকে নিয়ে গবেষণার কাজেও হাত দিয়েছেন। কয়েক বছর মুকুন্দ মেলা হলেও এখন তা পুরোপুরি বন্ধ। উদীচী-বরিশাল থিয়েটারের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনায় ১৯৮৬ সালে প্রকাশ করেছিল মুকুন্দ দাসের গানের একটি ক্যাসেট। মুকুন্দ দাস বিষয়ে বইও দুষ্প্রাপ্য। যা পাওয়া যায় সেগুলোও গতানুগতিক। চারণকবি মুকুন্দ দাসের ভাষায়-‘আয়রে বাঙালি/ আয় সেজে আয়/আয় লেখে যাই/ দেশের কাজে’ কিংবা ‘রাম রহিম জুদা কর ভাই/মনটা খাঁটি রাখো জী/ দেশের কথা ভাবো ভাইরে-দেশ আমাদের মাতাজী...’। ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগণার বানরী গ্রামের গুরুদয়াল দে ও শ্যামাসুন্দরী দেবীর দাম্পত্য জীবনে ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের ২২ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার জন্মগ্রহণ করেন মুকুন্দ দাস। তার বাবার দেয়া নাম ছিল যজ্ঞেশ্বর দে এবং ডাক নাম ছিল যগা। বরিশালের দেশব্রতী অশ্বিনী কুমার দত্তের সঙ্গে কিশোর বয়সেই মুকুন্দের পরিচয় হয়। অশ্বিনী কুমার দত্তের সংস্পর্শে মুকুন্দ দাস রাজনীতিতে আকৃষ্ট হন। তার আগ্রহে মুকুন্দ দাস মাতৃপূজা নামে একটি নাটক রচনা করেন। দুর্গাপূজার মহাসপ্তমীতে নবগ্রামে ওই নাটকের প্রথম প্রকাশ্য যাত্রাভিনয় হয়। মুকুন্দ দাস স্বদেশী ও অসহযোগ আন্দোলনের সময় বহু স্বদেশী বিপ্লবী গান ও নাটক রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি ছিলেন স্বদেশী যাত্রার প্রবর্তক। ১৯০৫ সালের অক্টোবর মাসে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন চলার সময় বরিশালের টাউন হলে অশ্বিনী কুমার দত্ত তার বক্তব্যে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনকে জোরদার করার উপলব্ধির কথা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা যে সব বক্তৃতা করে বেড়াচ্ছি, যদি কেউ তা যাত্রাপালা আকারে গ্রামে গ্রামে প্রচার করে, তাহলে তা আমাদের এরূপ সভা বা বক্তৃতার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর হবে।’ অশ্বিনী কুমার দত্তের সেই বক্তব্য মুকুন্দ দাস খুবই গুরুত্বসহকারে নিয়ে মাত্র তিন মাসের মধ্যে রচনা করেন অসাধারণ যাত্রাপালা ‘মাতৃপূজা’। যার মূল বিষয় ছিল দেশপ্রেম। দেশের সন্তানরা প্রয়োজনে জীবন দিয়ে ভারতমাতাকে ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্ত করবে। পুলিন দাস, অশ্বিনী কুমার দত্ত, মুকুন্দ দাস দেশপ্রেমের উন্মাদনা সৃষ্টি করলেন তরুণ সমাজের মধ্যে। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে জন্ম নেয় স্বদেশী আন্দোলন। যে আন্দোলনে সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে ছাত্ররা। বঙ্গভঙ্গবিরোধী ও স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন ক্ষুদিরাম বসু। এ সময় ক্ষুদিরাম সত্যেন বসুর নেতৃত্বে গুপ্ত সংগঠনে যোগদান করেন। এখানে তিনি শারীরিক শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক ও রাজনৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গান রচনায় মুকুন্দ দাসের সহজাত দক্ষতা দেখে তাকে (মুকুন্দ) ‘চারণকবি’ বিশেষণে ভূষিত করেন। মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম জাগাতে, দেশের পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার প্রেরণা জোগাতে মুকুন্দ দাস গান গেয়ে ও যাত্রাভিনয় করে স্থানে স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছেন সে জন্যই তাকে বলা হয় ‘চারণকবি’। আসামের একটি প্রতিষ্ঠান মুকুন্দ দাসকে ‘চারণ সম্রট’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ১৮ মে শুক্রবার রাতে ঘুমের ঘোরে মুকুন্দ দাস মৃত্যুবরণ করেন। বরিশালের অন্যতম নাটকের দল খেয়ালি গ্রুপ থিয়েটার প্রতিবছরই মুকুন্দ দাসের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে আলোচনা-পর্যলোচনার মাধ্যমে স্মরণসভার আয়োজন করে নতুন প্রজন্মের মাঝে মুকুন্দ দাসকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
×