
জমির মালিকানা নিয়ে জটিলতা ও প্রতারণা নতুন কিছু নয়। অনেকেই মনে করেন, দলিল ও খতিয়ানের বাইরে জমির মালিকানা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। তবে বাস্তবে এমন দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে আপনি শুধু বর্তমানেই নয়, ভবিষ্যতেও জমির মালিকানা নির্ভেজালভাবে ধরে রাখতে পারবেন দলিল বা খতিয়ান ছাড়াই।
দেশের ভূমি অফিসগুলোতে দুর্নীতির প্রকোপ দীর্ঘদিনের অভিযোগ। ভূমি খাতে আধুনিকায়নের নানা উদ্যোগ চললেও ঘুষ, দালালচক্র এবং অসৎ কর্মকর্তাদের কারণে সাধারণ মানুষের জমি সংক্রান্ত সমস্যা দিনকে দিন বেড়েই চলছে। ফলে দলিল থাকা সত্ত্বেও অনেকেই নির্ভরযোগ্য মালিকানা থেকে বঞ্চিত হন।
এই পরিস্থিতিতে যদি আপনার হাতে দুটি নির্ভরযোগ্য প্রমাণ থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে কারও চক্রান্তে জমি হারানোর আশঙ্কা থাকবে না।
১. ক্রয়সূত্রে মালিকানা: সঠিক দলিল ছাড়া মালিকানা অনিশ্চিত
জমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে শুধু দলিল থাকলেই চলবে না, দলিলটি হতে হবে ‘সাফ কাওলা’ বা ‘বিক্রয় কাওলা’। এটি একটি পরিষ্কারভাবে সম্পাদিত বিক্রয় দলিল, যেখানে জমির মালিকানা হস্তান্তরের আইনগত প্রক্রিয়া নির্ভুলভাবে সম্পন্ন হয়। যদি আপনি রক্তের সম্পর্কহীন কারও কাছ থেকে জমি কিনে থাকেন, তাহলে অবশ্যই এই দলিল দেখাতে হবে। না হলে ভবিষ্যতে কেউ এসে সেই মালিকানা বাতিল করতে পারে।
অনেকে কর ফাঁকির উদ্দেশ্যে হেবা দলিল করে থাকেন, যা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট ১৪টি রক্ত সম্পর্কের মধ্যে বৈধ। সেই সম্পর্কের বাইরে হেবা দলিল কার্যকারিতা হারায় এবং ভবিষ্যতে বাতিল হয়ে যেতে পারে। এতে জমির উপর আপনার অধিকার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
২. উত্তরাধিকার সূত্রে মালিকানা: ওয়ারিশান সনদের গুরুত্ব
আপনি যদি উত্তরাধিকার সূত্রে জমির মালিক হয়ে থাকেন, তাহলে অবশ্যই একটি বৈধ ওয়ারিশান সনদ সংগ্রহ করতে হবে। এই সনদে পরিবারের সব সদস্যের নাম থাকা আবশ্যক। ভুল বা ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে বাদ দিলে ভবিষ্যতে সেই সদস্য বা তার উত্তরসূরিরা মামলা করে জমির মালিকানা দাবি করতে পারে।
ওয়ারিশান সনদ আপনি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র বা সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন। তবে এটি তৈরির সময় সততা ও নির্ভুল তথ্য নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
খাজনা, রেকর্ড ও নামজারি: মালিকানা রক্ষার আইনি অস্ত্র
আপনি যদি জমি ক্রয় করে থাকেন, তাহলে দলিল হাতে নিয়েই থেমে গেলে চলবে না। দলিল অনুযায়ী নামজারি বা মিউটেশন করে নিতে হবে। উপজেলা ভূমি অফিসে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়ে এখন ঘুষ ছাড়া নামজারি করানো সম্ভব। নামজারির পর একটি হোল্ডিং খুলে প্রতি বছর খাজনা প্রদান করতে হবে এবং তার রসিদ (দাখিলা) সংরক্ষণে রাখতে হবে।
উত্তরাধিকারসূত্রে জমি পেলে অবশ্যই যার পক্ষ থেকে আপনি ওয়ারিশ হয়েছেন, তার সর্বশেষ রেকর্ড সংগ্রহ করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী প্রতি বছর খাজনা দিতে হবে। তবেই আপনার মালিকানা থাকবে নির্ভেজাল ও নিরাপদ।
জমির মালিকানা রক্ষা: সচেতনতা ও আইনি প্রস্তুতি জরুরি
এই দুটি প্রমাণ একটি সঠিক দলিল এবং একটি সঠিক ওয়ারিশান সনদ আপনার জমির মালিকানা নিশ্চিত করতে যথেষ্ট। এগুলোর সাথে খাজনার দাখিলা, হোল্ডিং এবং মিউটেশন নিশ্চিত করলে কেউই আপনার জমি অবৈধভাবে দখল করতে পারবে না।
আর যদি কেউ তা করার চেষ্টা করে, তাহলে আপনি আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেন এবং জমির দখল পুনরুদ্ধার করতে পারেন। আপনার পরবর্তী প্রজন্মও এসব আইনি ভিত্তির ওপর নির্ভর করে জমির মালিকানা সুরক্ষিতভাবে ধরে রাখতে পারবে।
জমির মালিকানা শুধু দলিল নয়, এর সাথে সঠিক আইনি প্রস্তুতি ও দলিলের বৈধতা নিশ্চিত করাই আপনাকে চিরস্থায়ীভাবে মালিকানা ধরে রাখার উপায় করে দেবে। সচেতন থাকুন, দলিল যাচাই করুন, আইনি প্রক্রিয়া মেনে চলুন তাহলেই আপনার জমি থাকবে নিরাপদ, সুরক্ষিত এবং আপনার উত্তরাধিকারীদের কাছে পৌঁছাবে নিঃবিঘ্নে।
আফরোজা