
নীল দর্পণ
পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার চৌবাড়িয়া গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে ১৮৩০ সালে দীনবন্ধু মিত্র জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতৃদত্ত নাম গর্ন্ধবনারায়ন। গ্রাম্য পাঠশালায় অধ্যয়ন শেষে পিতার প্রচেষ্ঠায় স্থানীয় জমিদারের সেরেস্তায় মাসিক আট টাকা বেতনে তিনি চাকরি শুরু করেন ১৮৪০ সালে। কিন্তু তাঁর মনে ছিল উচ্চ শিক্ষালাভের তীব্র বাসনা। তাই পাঁচ বছর অত্যন্ত বিশ্বাস ও কর্তব্য নিষ্ঠার সঙ্গে চাকরি করার পর পিতার অমতে গোপনে কলকাতায় পাড়ি জমান। সেখানে পিতৃব্য নীলমণি মিত্রের আশ্রয়ে থেকে শুরু হয় তার উচ্চ শিক্ষালাভের প্রাণান্ত সংগ্রাম।
কলকাতায় পড়াশোনার খরচ জোগাতে তাঁকে গৃহভৃত্যের কাজ করতে হয়েছে। প্রথমে তিনি ইংরেজ রেভারেন্ট জেমস লং-এর অবৈতনিক স্কুলে ভর্তি হন এবং এ সময়েই তিনি দীনবন্ধু নাম গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন। ১৮৫০ সালে সেখান থেকে জুনিয়ার স্কলারশিপ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। কলেজের সকল পরীক্ষায় তিনি বৃত্তি লাভ করেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তিনি বরাবর ক্লাসে সর্বোচ্চ নম্বর পেতেন। ১৮৫৫ সালে দীনবন্ধু পাটনায় পোস্ট মাস্টার পদে চাকরিতে যোগদান করেন। পরবর্তীতে কৃতিত্বের সঙ্গে চাকরি করে পরে তিনি সহকারী পোস্ট মাস্টার জেনারেল পদে উন্নীত হন।
দীনবন্ধু মিত্র কলেজে অধ্যয়নকালেই ঈশ্বর গুপ্তের সংস্পর্শে এসে সংবাদ প্রভাকর, সাধুরঞ্জন প্রভৃতি পত্রিকায় কবিতা লিখতে শুরু করেন। তবে বাংলা সাহিত্যে নাটক ও প্রহসন লিখেই তিনি সর্বাধিক খ্যাতি অর্জন করেন। দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকটি তৎকালীন সমাজে এক অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং অবহেলিত কৃষকদের নীল বিদ্রোহে ইন্ধন জোগায়। সমকালীন নীল চাষ ও নীলকর সাহেবদের প্রজাপীড়ন এবং শাসক শ্রেণির পক্ষপাতমূলক আচরণ নাটকটির মূল বিষয়বস্তু।
সম্ভবত মাইকেল মধুসূদন দত্ত নাটকটির ইংরেজি অনুবাদ এবং পাদ্রি জেমস লং তা’ প্রকাশ করে আদালত কর্তৃক অর্থ দ-ে দ-িত হন। বিচারে হাজার টাকা জরিমানা ও এক বছরের সশ্রম কারাদ-ে দ-িত হন। সেই কারাদ-ের টাকা দিয়েছিলেন ‘হুতুম প্যাচার নকশা’ রচয়িতা কালীপ্রসন্ন সিংহ। ‘হিন্দু পেট্রোইয়েটে’র সম্পাদক হরিশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় সে সময় মারা যান। বাংলার আকাশে বাতাসে তখন দুর্যোগের ঘনঘটা। তৎকালীন বাউল কবিরা সে সময় গান লিখেছিলেন- ‘নীল বানরে সোনার বাংলা, করলে এবার ছাড়ে খার। অসময়ে হরিশ মোলো, লঙের হলো কারাগার।
প্রজা আর প্রাণ বাঁচানো হলো ভার।’ নাটকটি রচনাকাল থেকে আজ অবধি জাতীয় চেতনার পথিকৃৎ হয়ে আছে। এটিই বিদেশী ভাষায় অণুদিত প্রথম বাংলা নাটক, ১৮৬০ সালে মুদ্রিত ‘কস্যচিৎ পথিকস্য’ ছদ্মনামে নাটকটি প্রথম ঢাকা থেকে প্রদর্শিত হয়। এবং ১৮৭২ সালে ৭ ডিসেম্বের এটি দিয়েই শুরু হয় সাধারণ রঙ্গালয়ের অভিনয়। নীলকর সাহেবদের অকথ্য অত্যাচারের কাহিনী তখন গ্রাম বাংলার জীবনকে ভয়াবহ ও দুবির্ষহ করে তুলেছিল। সমাজ চিন্তার মধ্যেই রাষ্ট্র চিন্তার খোরাক আছে, সেই সমাজ ও রাষ্ট্রের সংযুক্ত বোধ দেখতে পাই আমরা সর্বপ্রথম দীনবন্ধু মিত্রের নীল দর্পণ নাটকে। দীনবন্ধু মিত্রকে বস্তুতান্ত্রিক শিল্পের একজন শ্রেষ্ঠ পথিকৃৎ হিসেবে গণ্য করা যায়।
বঙ্কিম চন্দ্র লিখেছেন- ‘এই গ্রন্থের জন্য পাদ্রী লং সাহেব কারারুদ্ধ হয়েছিলেন বলেই হোক অথবা এর কোনো বিশেষ গুণ থাকার নিমিত্তেই হোক নীল দর্পণ ইউরোপের অনেকভাষায় অনুবাদ ও পঠিত হয়েছিল। এই সৌভাগ্য অন্য কোনো গ্রন্থেরই ঘটেনি। দীনবন্ধু মিত্র সমকালীন হিন্দু সমাজের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে প্রহসন রচনা করেও বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। সমাজের সাধারণ মানুষ সম্বন্ধে বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং তাঁদের প্রতি সহানুভূতিই তাঁর রচনার প্রধান উৎস।
চাকরি সূত্রে দেশ বিদেশের বহু অভিজ্ঞতা তাঁর নাটকের চরিত্র সৃষ্টিতে বিশেষভাবে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নাটক ও প্রহসন হলো নীল দর্পণ (১৮৬০ খ্রি), নবীন তর্পাস্বনী (১৮৬৩ খ্রি) বিয়ে পাগলা বুড়ো (১৮৬৬খ্রি), সধবার একাদশী (১৮৬৬খ্রি), লীলাবতি (১৮৭৩খ্রি), জামাই বারিক (১৮৭২খ্রি) ও কমলে কামিনী (১৮৭৩খ্রি) নাটক। ‘সধবার একাদশী’ ও ‘লীলাবতি’ উচ্চাঙ্গের সামাজিক নাটক। ‘বিয়ে পাগল বুড়ো’ও ‘জামাই বারিক’ তাঁর দুটি সার্থক প্রহসন।
দীনবন্ধু মিত্রের দু’খানি কাব্য গ্রন্থের রাম দ্বাদশ কবিতা (১৮৭২খ্রি) ও সুরধনী (২য় ভাগ ১৮৭১, ১৮৭৩খ্রি)। দীনবন্ধু মিত্র ছিলেন মানবদরদী। যদিও তিনি সরকারি কর্মচারী ছিলেন, যদিও ইংরেজদের নিকট থেকে ‘রায় বাহাদুর’ খেতাব পেয়েছিলেন, তবুও নীল করদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন চিরদিন। যদি এ টুকু তিনি না করতেন তাহলে তাঁর পোস্ট মাস্টার জেনারেল এবং পরে ডাইরেক্টর জেনারেল হওয়া মোটেই অস্বাভাবিক ছিল না।
দীনবন্ধু মিত্র ছিলেন মাটির কাছাকাছি মানুষ এবং সমাজ কল্যাণে নিবেদিত একনিষ্ঠ শিল্পী, তিনি ছিলেন কৃতিমতার ঘোর বিরোধী এবং সত্যের অনুসন্ধানী। তীক্ষè সমাজ দৃষ্টি, জীবন্ত চরিত্র সৃষ্টি এবং প্রচ- মানবিক মূল্যবোধ ও সহানুভূতি তাঁর সৃষ্টিকে অমর করে রেখেছে। ১৮৭৩ সালের ১ নভেম্বর মাত্র ৪৩ বছর বয়সে এই নিবেদিতপ্রাণ, একনিষ্ঠ কর্মী, মানব দরদী দীনবন্ধু মিত্রের অকাল মৃত্যু হয়।
তাঁর ১৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকীতে (মৃত্যু ১৮৭৩সালের ১ নভেম্বর) তাঁকে জানাই হৃদয়ের অফুরন্ত ভালোবাসা। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি।