
মহীতলী হাটের ভাঙা সাঁকোটার কাছে এসে দাঁড়ায় বদি
মহীতলী হাটের ভাঙা সাঁকোটার কাছে এসে দাঁড়ায় বদি। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে এখন। তুলোধোনা চৈত্র-বৈশাখ মাসের তাপদাহ শরীরের চামড়া ফাটিয়ে দিচ্ছে নির্মমভাবে। চোখ যেদিক যায় আগুনের তাপ লাগে। আগুনের জ্বলন্ত ফুলকি যেন ছুড়ে মারে শরীরে। বদি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। সাঁকোটার কাছাকাছি টানা বেঞ্চে বসা ভাতের হোটেলের সামনে বাঁশের মাঁচার ওপর বসে ধপাস করে। হোটেলের ভেতর দিকে তাকিয়ে পেটে যেন ক্ষুধার ছুঁচো ডেকে ওঠে। সকাল গেছে দুপুর পেরিয়ে বিকেলও চলে গেছে কিন্তু পেটে যে এখনো দানাপানি পড়েনি সে কথা স্মরণ হয়ে যায় মুহূর্তে।
সেই সাঁঝ থাকতে-থাকতে বাড়ি থেকে দুমুঠো মুড়ি খেয়ে বের হয়। তারপর মাইলকে মাইল হেঁটে পেটে কি আর মুড়ির কোনো অবশিষ্ট থাকে। বুকটাও হাপড়ের মতো উঠানামা করছে এখন। শরীর আর স্থির থাকতে পারে না। ধপ করে কোথাও শুয়ে পড়তে পারলে মন্দ হতো না। মহীতলী হাটের মানুষজন যেন কেমন। চোখ থেকেও নেই কারও। মন বলে কি কিছুই নেই এদের। বদি একসময় শুয়ে পড়ে মাচার টানা টঙে। চোখ বুজে আসে, পেটের ভেতর ক্ষুধা নামের রাক্ষশ চোঁ-চোঁ করে ডেকে উঠলেও শরীর আর সইতে পারে না। মহীতলীর হাট আজ বদির কাছ থেকে অনেক কিছু ছিনিয়ে নিয়েছে। যা ছিল ওর নিজের বলতে তা আর নেই। নেই মানে নিঃস্ব সে, পথের ভিক্ষারির চেয়েও নিঃস্ব।
পদ্মকে নিয়ে বদির অনেক স্বপ্ন-সাধনা। কাজলদীঘির জলে ফুটে থাকা পদ্ম আজ মহীতলীর নামকরা আড়ৎদার পবন ঘোষের ছেলেবৌ হয়ে এসেছে। গগন তেমন যে খুব ভালো ছেলে, তাও নয়। মাতাল-জুয়াড়ি যাত্রা-সার্কাস চড়ানো ছেলে। বাপের আছে বলে সে উড়িয়ে বেড়ায় যত্রতত্র। মেয়ে মানুষের মতো কাঁচা মাংসের নেশা তো ওর রক্ত-শরীরের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে আছেই। ওই গগনই সাতপাঁকে বেঁধে ঘরে তুলেছে পদ্মকে। অগ্নিসাক্ষী করা বউ বলে কথা। বদি তো সেখানে কোন্ ছাড়। ঘর-সংসার নেই।
জীবনে যার কোনো কুল নেই কিনারা নেই। সে আবার মানুষ হলো। তার মূল্য তো সমাজের কাছে নেই। পদ্মর কাছে থাকলেও তা শুধু চোখের বিভ্রমে অর্থাৎ স্বপ্নবিলাশে। বদি জীবনভর শুধু পদ্মর জন্য হা-হাপিত্যাশ করে যাবে। নিজের ধন হারালে মানুষ পাগল হয়, কিন্তু শরীর থেকে প্রাণটাকে কেড়ে নিলে কি থাকে তার। মল্লিক বাড়ির মেয়ে পদ্মর সঙ্গে সেই শৈশব থেকে একটু-একটু বেড়ে ওঠা। ভালোবাসা-মমতার একটু সড় কি পড়েছিলো ওই স্পটিক জলে। হয়তো পড়েছিলো কিংবা সবই মনের ভুল। তা ভুল বললে তো হবে না। একটা অমন স্মৃতিকে কেউ কি দুমড়ে-মুচড়ে ফেলতে পারে। পারে না কখনো, তাই তো মনের ভুলে এসেছে গহনে গোপনে-গোপনে।
বদি একটু বড় হতেই একদিন ওর বাপটা ফট করে মরে গেল। মানুষটা সহজ-সরল ছিল। সাত গাঁয়ের লোকের গাছ-গাছাড়া আগান-বাগান পরিষ্কার করে দিত। তেঁতুলগাছ থেকে তেঁতুল পেড়ে পরিষ্কার করে বিনিময়ে যে যা খুশি মনে করত তাই নিয়েই সুখের সংসার। কিন্তু একদিন তালুকদার বাড়ির খেঁজুরবাগানের একটা ডাল থেকে আচমকা পড়ে মাজায়-বুকে বেশ চোট পায়। তারপর কয়েকদিন ঘরে বসে কঁকিয়ে মরে, হারান কবিরাজ শেকড়-বাকর বেঁটে খাইয়ে দিলেও স্পষ্ট জানাই, গতিক ভালো লয়, আঘাত বেশ মারাত্মক বটে।
বদিকে নিয়ে মফস্বল শহরের ডাক্তারের কাছে যায়। ডাক্তার রোগী দেখে টাকা গুনে নেয় এবং ফটো তুলতে বলে। আরও সব পরীক্ষা তো আছেইÑ এক্স-রে রিপোর্ট দেখে তো হতবাক। মাজার হাড় ভেঙে গেছে, বুকের হাড় বেঁকে এবড়ো-থেবড়ো অবস্থা। অনেক টাকা-কড়ির ব্যাপার, নয়তো জীবন শেষ। বাড়ি এসে সেই যে চিৎ হলো তো আর উপুর হতে পারল না মানুষটা। এভাবে কয়েক মাস কাটে, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যায়, পেটে কোনো দানাপানি আর যেতে চায় না। ক্রমে-ক্রমে মানুষটা শুকিয়ে যেতে থাকে। তারপর একদিন চোখ বন্ধ করে দেয়। তারপর কলুর বলদের দায়িত্ব পড়ে বদির ঘাড়ে। সেই ঘানি আজও টেনে চলছে সে। টানছে-টানছে তো টানছেই ঘরে মা-ছোটভাই এবং বোন রয়েছে।
বদি বাপের পেশা ধরেছে। মানুষজনের বাড়ির খেজুরগাছ কাটা, সে তো অগ্রহায়ণ-পোষ-মাঘের দিকে। তালগাছের মাথা থেকে রস নামাতেও শিখেছে। আরও শিখেছে ঘরামির কাজটা। তাই তাকে সারা মাস-বছর বেকার থাকতে হয় না। কাজ লেগেই থাকে, কাজ করতে বদির মোটেও মন্দ লাগে না। বাপের মতো খাটতে পারে সে। বাপ বলত, শরীরকে খাটাবি পয়সা রোজগার করবি। ভাতের অভাব হবে না আর যদি শরীরকে আরামে রাখিস, অনাহারে থাকবি, অভাবে স্বভাব নষ্ট হবে।
বাপের কথা বদি হাড়ে-হাড়ে টের পায়। সত্যই জীবনে বড় কিছু পেতে হলে পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নাই। ছোট থাকতে কয়েক মাস আকুল মুন্সির ওই স্কুলটায় গিয়েছিল। নদীর পাড়ের যে আদ্দিকালের অশ্মথগাছ নদীর দিকে হেলে পড়েছে, সেখানেই টিনের ছাপড়া তোলা স্কুল ছিল। কিন্তু একবার কালবৈশাখী ঝড়ে টিনসহ স্কুলঘরের বাঁশবাঁকারি বেড়া চৌহদ্দি উড়িয়ে নিয়ে যায়। তারপর থেকে খোলা আকাশের নিচে স্কুলটা চালিয়ে যাচ্ছিল মুন্সি। মানুষটা বেশ ভালো ছিল। কিন্তু বেশি ভালো মানুষের আবার ভালো থাকা! একদিন মানুষটা চোখ বুজলো, তারপর স্কুলটা বন্ধ হলো।
বিনা পয়সার স্কুলের দায়িত্ব কে নেবে সংসারে। বদির আর পড়াশোনা হলো না। বাপ চেয়েছিল দূরের ওই বকখালির দিকের স্কুলে ভর্তি করাবে বদিকে কিন্তু সেও আর হলো না। চলে গেল বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো। এখন বোঝে মানুষ হারিয়ে যায়, কিন্তু রেখে যায় স্মৃতি এবং ভালোবাসা। সেই টুকরো-টাকরা জিনিসগুলো সারাজীবন যন্ত্রণা দেয়। বদি সে যন্ত্রণায় জ্বলছে এবং জ্বলতে-জ্বলতে একটা কঠিন গহ্বরের মধ্যে হারিয়ে ফেলে নিজেকে।
বদি জানত না মেয়েমানুষ জিনিসটা কি! কি কারণে মানুষ ওমন হয়। মল্লিকবাড়ির মেয়ে পদ্মর শূন্যতা তাকে আজ বেদুইন করেছে। হয়তো কিছুটা উদাসিনও। মল্লিকবাড়ির সঙ্গে বিনাসুতোর মালার মতো একটা অদৃশ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই বাপের আমল থেকেই। পদ্মর বাড়িতে যখন গাছ কাটার ছুতোয় বা শীতের সময় খেজুরগাছ কাটার পর, সন্ধ্যার সময় রসের জন্য মাটির হাঁড়ি বেঁধে দেওয়ার ছলে পদ্মকে দেখে নিতো বদি। পদ্ম একটু হাসি ছড়িয়ে চোখ ছোট-ছোট করে তাকাতো। সেই চোখের ভাষা বুঝতে এতটুকু বেগ পেতে হতো না কখনো।
সে’ বার ধর্মতলা মহাশ্মশানের ওদিকে রাঁধব প-িতের আশ্রমের প্রায় দুশত-আড়াই’শ ডাবগাছ ঝুরবার দায়িত্ব পড়ে বদির ওপর। বেশ কাঁচা টাকার হাতছানি। কয়েকদিনের বাধা কাজ। বদি আশ্রমে দিনরাত্রি থেকে কাজ করেছিল। ধর্মতলা থেকে কাঞ্চনপুরের দূরত্ব দশ ক্রোশ। বদির স্বপ্ন ছিল, এতোগুলো গাছ কাটার টাকা হাতে পেলে বটগাছি হাটের ওদিকে একটা চালা তুলে দোকান দিয়ে ছোটভাইটাকে বসাবে। সমিতির কাছে কিছু ঋণ পেলে তো একটা পুঁজি হবে। সংসারে অভাবটাকে তাড়াতে পারলে পদ্মকে নিয়ে ভাবাটা বেশ জুতসই হবে তখন।
আশ্রমের গাছ কাটা শেষে পারিশ্রমিক পেতে দেরি হবে শুনলে মনটা বিগড়ে যায়। মুখে কিছু না বললেও শরীর জ্বলে ওঠে। ঠিক তার কয়েকদিনের মাথায় আশ্রমে যে চুরি হয়, তার দায় বদির ঘাড়ে গিয়ে পড়ে। থানা-পুলিশ কেসে বদি ফেঁসে যায়। বদির তিন বছর জেল হয়। কারাগারের কঠিন দুনিয়ায় বদি দিন-যাপন করতে থাকে।
এক জেল থেকে আরেক জেল তারপর সাজা শেষে ছাড় পায়। গাঁয়ে এসে শোনে পদ্মর ঠিকানা মহীতলী হাটের দিকে। নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। তারপরও রাত্রি শেষে পথে নামে পদ্মর খোঁজে। সব পাখি বাসা বাঁধে কিন্তু সব পাখি কি নীড়ে ফেরে। নাকি ফিরতে পারে না, বদি কোন্ বাসায় ফিরবে। তিন তিনটে বছর, মা-বোন-ভাই কোথায় হারিয়ে গেছে। বাড়িটা ভুতুড়ে বাড়ি হয়ে গেছে। কেউ থাকে না, শিয়াল-সাপ-ইঁদুর-বাদুড়-বেঁজির আশ্রয় হয়েছে। আশপাশের মানুষগুলোও কেমন পালটে গেছে। হয়তো এভাবেই মানুষ নিজেকে পালটাতে ভালোবাসে রংধনুর মতো। রক্তচোষা গিরগিটি যেমন তার শরীরের রং পরিবর্তন করতে পারে। মানুষও কি সেভাবে ইচ্ছেমতো সব পারে? পারে তো অবশ্যই, বদির চোখে কেমন ধাঁধা লাগে। মানুষ কত কিছু পারে, কিন্তু সে তো কিছুই পারে না। পদ্মকে ধরে রাখতে পারেনি। পারেনি মা-বোন-ভাইকে ধরে রাখতে। কোথায় গেল সব, তিন তিনটে বছরে এতোকিছু বদলে গেল!
পদ্মরা চলে যায় দেশ ছেড়ে ভিন দেশে। কিন্তু বদির পদ্ম তো দেশ ছাড়েনি। গ্রাম ছাড়েনি। বুকের ভেতর হালকা-পাতলা কেমন একটু উড়ুউড়ু বাতাস লাগে। ক্লান্ত শরীর আর কিছু চায় না। দীর্ঘসময় জেলে থেকে নিজেকে কেমন স্থির গাছের মতো মনে হচ্ছে। মানুষ তো এভাবেই নিজেকে শেষ করে ফেলে। মাধব প-িতের আশ্রমের চুরিতে তার নাম জড়িয়ে পদ্মর বাবা রমেশ মল্লিকের সাধ পূরণ হয়েছে। বদির স্বপ্ন ভেঙে গেছে। এভাবেই দেশ ভাঙে, হাতের চুড়ি ভাঙে, সংসার ভাঙে, বিধবার শাঁখা ভাঙে, বাড়ি-ঘর ভাঙে, মন ভাঙে, নদীর পাড় ভাঙে, ভাঙতে-ভাঙতে মানুষ একদিন উদোম নিত্য করতে-করতে মরে যায়। মরতে-মরতে স্বপ্নটাকে চিমটি কেটে দেখে সেখানে কোনো ভুল আছে কি নেই। যদি ভুল থাকে তো বেশ হয়েছে কিন্তু ভুল না থাকলে, সবই ধোঁয়াটে আবরণ।
দূর থেকে সাইকেলে চেপে আসছে গুপ্তিপাড়ার নিত্যরঞ্জন প্রামাণিক। বদির ঘুমটা কেটে যায়। চোখ খুলে নিত্যকে এভাবে দেখতে পারবে ভাবেনি। সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। দোকানে-দোকানে লাইট জ্বলছে। অনেকদিন পর নিত্যকে দেখে মনটা বেশ উৎফুল্ল হয়ে ওঠে।
নিত্যও বদিকে দেখে কুশল বিনিময় করে জানায়, তোর মা-বোন-ভাই কাজের সন্ধানে সেবার শহরে চলে গেল, ওই নদীর খেয়াঘাটেই দেখেছিলাম।
বদি কোনো কথা বলে না, নিত্য ওর বাল্যকালের বন্ধু। আবার নিত্য বললো, আমি বললাম, মাসিমা এভাবে বাড়ি-ঘর ফেলে চলে যাবে কোথায়?
তোর মা তখন বললো, বদির অপেক্ষায় গাঁয়ে পড়ে থাকলে আমাদের আর বাঁচতে হবে না, শহরে গিয়ে খুঁদ-কুঠোর ব্যবস্থা তো হবে।
বদি থেমে যায়, নদীতে অনেক খেয়া। খেয়া পারাপারের দৃশ্য সবসময় একরকম হয় না। কেউ যায় কেউ আসে, এর ভেতর অনেক না বলা কথা থেকে যায়। কেউ জানে কেউ বা জানে না। পদ্মর সঙ্গে দেখা হবে কি হবে না জানে না। তবে পদ্মরা দেশ ছেড়ে যায়নি। পাখিচরা কোনো গ্রামে আছে। পাখির দেশে পাখির মতো। বদির চোখের আড়াল হয়েছে। সেই আড়ালের অনেক দূরে বদি দাঁড়িয়ে। সাপে চলা সরু সড়ক ধরে বদি হেঁটে যাবে। হয়তো পাবে অথবা পাবে না দেখা। কিন্তু দেখার জন্য মন ওর ছটফট করছে, কিন্তু দেখা তো পাচ্ছে না। সীমান্তরেখার রক্তচক্ষু নিয়ে পদ্ম অদৃশ্য এখন।