ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৭ জুন ২০২৫, ৪ আষাঢ় ১৪৩২

লজ্জাবতী গাছ: প্রাকৃতিক ঔষধি শক্তিতে ভরপুর এক বিস্ময় বনজ উদ্ভিদ

রফিকুল ইসলাম রফিক, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, কুড়িগ্রাম

প্রকাশিত: ০০:৩৯, ১৭ জুন ২০২৫

লজ্জাবতী গাছ: প্রাকৃতিক ঔষধি শক্তিতে ভরপুর এক বিস্ময় বনজ উদ্ভিদ

ছবিঃ জনকণ্ঠ

বাংলার গ্রামগঞ্জে হেঁটে গেলে ধানক্ষেতের পাশ, রাস্তার ধারে কিংবা পতিত জমিতে সহজেই চোখে পড়ে, একটি লতায় জড়ানো ছোট ঝোপ জাতীয় উদ্ভিদ। 

পাতায় হাত লাগলেই সঙ্গে সঙ্গে মুছে যায় তার প্রসারিত পত্রপল্লব, যেন নিজেই নিজেকে আড়াল করতে চায়। উদ্ভিদটির নাম লজ্জাবতী (বৈজ্ঞানিক নাম: Mimosa pudica)—লোকজ সমাজে একে ‘লজ্জা লতা’ বা ‘ছুঁইনাছুঁই’ নামেও চেনা হয়।

লজ্জাবতী একটি গুল্মজাতীয় লতানো উদ্ভিদ। এর পাতা যৌগিক এবং সংবেদনশীল। সামান্য স্পর্শে বা বাতাসের ধাক্কায় পাতাগুলো সঙ্কুচিত হয়ে যায়। গাছটির উচ্চতা গড়ে ৩০-৬০ সেন্টিমিটার হয়। ফুল গোলাপি বা বেগুনি রঙের এবং তুলার মতো গোলগাল। এটি মূলত ট্রপিক্যাল ও সাবট্রপিক্যাল অঞ্চলে জন্মে এবং বাংলাদেশে স্বভাবিকভাবে বেড়ে ওঠে।

লজ্জাবতী গাছ দীর্ঘদিন ধরেই আয়ুর্বেদ ও লোকজ চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এর মূল, পাতা, ডাঁটা ও ফুল—সবই কোনো না কোনোভাবে উপকারী। নিচে এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ গুণ তুলে ধরা হলো: 

কাটা-ছেঁড়ায় লজ্জাবতীর পাতা বেটে ক্ষতস্থানে প্রয়োগ করলে রক্তপাত বন্ধ হয় এবং দ্রুত নিরাময় হয়।

জ্বর নিরাময়ে: শুকনো লজ্জাবতীর শিকড় গুঁড়া করে গরম পানিতে সিদ্ধ করে খেলে ভাইরাল জ্বর, টাইফয়েডে উপকার পাওয়া যায়।

অর্শ্বরোগে (পাইলস): লজ্জাবতীর পাতা ও মূল বাটা মধুর সঙ্গে মিশিয়ে খেলে অভ্যন্তরীণ ও বহিঃস্থ পাইলসে উপশম মেলে।

রোগ প্রতিরোধে: এতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টিফাঙ্গাল উপাদান রয়েছে, যা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

নারীস্বাস্থ্য: ঋতুস্রাবের অনিয়ম, শ্বেতপ্রদর ইত্যাদি সমস্যা কমাতে লজ্জাবতী ব্যবহার করা হয়।

লোকজ বিশ্বাস অনুযায়ী, বিষাক্ত সাপের কামড়ে লজ্জাবতীর পাতা ও মূল বেটে আক্রান্ত স্থানে লাগানো হলে বিষের ক্রিয়া হ্রাস পায়। কিছু অঞ্চলে বিষাক্ত পোকার কামড়েও এটি প্রাথমিক প্রতিকার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

ভারতের তামিলনাড়ু, আসাম ও বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে প্রথাগত ও আয়ুর্বেদ চিকিৎসকরা এখনো লজ্জাবতীকে সাপের বিষ প্রতিরোধে সহায়ক ভেষজ হিসেবে বিবেচনা করেন। তবে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এখনো বিষয়টি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ গবেষণা চালাচ্ছেন এবং এটি প্রচলিত চিকিৎসার বিকল্প নয়।

লজ্জাবতী গাছের ব্যবহার অবশ্যই অভিজ্ঞ আয়ুর্বেদ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে করা উচিত। অতিমাত্রায় গ্রহণে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যেমন—অতিরিক্ত নিদ্রাচক্র, হজমে সমস্যা বা মস্তিষ্কে প্রভাব পড়তে পারে।

প্রাকৃতিক এই লতা শুধু লজ্জার প্রতীক নয়, বরং প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্রের একটি সম্ভাবনাময় উপাদান। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতায় গড়ে ওঠা এই উদ্ভিদ আজও প্রাসঙ্গিক, তবে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও আধুনিক চিকিৎসার সঙ্গে সংযোগ ঘটিয়ে এর ঔষধি সম্ভাবনাকে আরও কার্যকর ও নিরাপদভাবে ব্যবহার করাই এখন সময়ের দাবি।

আলীম

×