ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাল্টিক সাগর থেকে রকি মাউন্টেন

প্রকাশিত: ০৬:১২, ৬ অক্টোবর ২০১৭

বাল্টিক সাগর থেকে রকি মাউন্টেন

(পূর্ব প্রকাশের পর) রানা শ্রাবণীর আড়াইজনের সংসার ক্যালগেরি বিমান বন্দর থেকে মাত্র দশ বারো মিনিটের দুরুত্ব। ঘরে ঢুকেই অবাক হলাম খাবার টেবিলে খাবারের আয়োজন দেখে। বুঝতে আর বাকি রইল না, তারা দু’জন মহারাণীর কত কাছের। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ছাড়াও চলতিপথে কতজন যে আপন হয়ে যায়, যে আপনজন আত্মীয়স্বজনকেও হার মানায়। এরা সবাই তার এক একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। মহারাণীর সুবাদে আমি অনেক দিন পর আর একজন শ্যালিকা পেলাম তিনি স্বয়ং শ্রাবণী দে। প্রতি নিয়ত তার জামাইবাবু সম্মোধন আটত্রিশ বছর পূর্বে বিয়ের পরপর শ্বশুরবাড়িতে শালিকাদের জামাইবাবুকে নিয়ে রঙ্গ তামাশার কথা মনে করিয়ে দিল। শ্বশুরবাড়িতে জামাইবাবু এবং শ্যালিকাদের নিয়ে একটা রঙ্গ প্রবাদ বাক্যের কথা মনে পড়ে গেল। অর্থাৎ নতুন জামাই, শ্বশুরবাড়িতে সম্পর্কের ভিত্তিতে কেমন তার অবস্থান সেটাকেই বোঝানো হয়েছে। প্রবাদ বাক্যটি বাণী চিরন্তনী থেকে পাওয়া ও জামাই এর বিভাজনটা এইরূপ-’বউ আট আনা, শ্যালি সাত আনা, শ্বশুর শাশুড়ি আধ আনা, আর বাকি যত কানাকড়ি বুড়োবুড়ি তারা মিলে আধ আনা’। তা হলে এবার বুঝে দেখুন শ্যালিকার অবস্থানটা কোথায়। সর্বক্ষণ শ্রাবণীর আদর আপ্যায়ন বেশ তৃপ্তি সহকারেই উপভোগ করলাম। বিশেষ করে তার রান্নার তারিফ না করে পারছি না। খেতে বসে ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমার ডায়াবেটিকস। অনেকদিন পর খাশির মাংস পেট ভরে খেলাম। ল-নে এই নিরীহ প্রাণীটির মাংস পাওয়া বেশ দুষ্কর। খাওয়ার টেবিলে রামকৃষ্ণ দাদাদের পরিবারও যোগ দিয়েছিলেন। বুঝলাম আমাদের আগমন উপলক্ষে একটা পারিবারিক নৈশভোজ ও মিলন মেলাও হয়ে গেল। সে রাতে আমাদের দীর্ঘ ভ্রমণ জনিত ক্লান্তির কথা বিবেচনা করে আড্ডাটা তেমন জমল না। বিদায় নেওয়ার সময় রামকৃষ্ণ দাদা আক্ষেপ করে বললেন আগামীকাল শনি এবং পরশু রবিবার আপনাদের সঙ্গে দেখা হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। কারণ তারা এবং আরো দশ বারোটা পরিবার মিলে দূরে কোথাও বেড়াতে যাবেন। আর আমাদের যেহেতু রবিবার ব্যাম্প যাওয়ার সব ব্যবস্থা শৈলেন করে রেখেছেন তাই এ সপ্তাহের জন্য বিদায় নিতে হবে। হঠাৎ বলে বসলাম আপনাদের সঙ্গে আমরা যেতে পারি না? কথাটা শুনেই মহারাণী বলে বসলেন-তিনি যাবেন না তিনি এতটাই ক্লান্ত যে, কাল শুধু ঘুমিয়েই সময় কাটাবেন। বললাম তুমি যাও আর না যাও আমি কিন্তু যাবই। ইতোমধ্যে রামকৃষ্ণ দাদা আয়োজকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হলেন যে আমরা ইচ্ছা করলে যেতে পারব। দেখলাম এমন একটা সুযোগ হাতছাড়া করা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আর যেহেতু বেড়াতে এসেছি সেহেতু কোন দলের সঙ্গে গেলে দুই দিক থেকে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা আছে। প্রথমত তারা নিশ্চয় কোন ভাল ভাল দর্শনীয় স্থানে যাবেন এবং আর্থিক সাশ্রয়ের বিষয়টাও ফেলনা নয়। রানা ও শ্রাবণীকে ফেলে যাই কি করে। তাই ওদেরকেও সঙ্গি হওয়ার জন্য অনুরোধ করলাম। কিন্তু কাজ ফেলে তাদের যাওয়া সমীচীন হবে না বিধায় সে চিন্তা পরিহার করলাম। ইতোমধ্যে মহারাণীও তার মতো পরিবর্তন করে সঙ্গী হওয়ার বাসনা ব্যক্ত করাতে স্বস্তি পেলাম। সিদ্ধান্ত হলো প্রত্যুষে রাম দাদা আমাদের তুলে নিয়ে যাবেন। যথাসময়ে প্রাতঃরাশ সেরে অপেক্ষা করতে হবে অগ্রবর্তী দলের সঙ্গে যোগ দিতে। আপাতত এই চিন্তা নিয়ে ভ্রমণের ক্লান্তি দূর করতে বিছানায় হাজির হলাম। প্রায় কুড়ি ঘণ্টা ভ্রমণজনিত শারীরিক দুর্বলতায় মুহূর্তেই কোথায় যেন হারিয়ে গেলাম। সকালে ঘুম ভেঙে গেল প্রাকৃকিত তাড়নায় না হলে ঘুম ভাঙা যে খুব সহজে হত না সেটা হলপ করেই বলা যায়। সকালে শ্রাবণী সেদিনের সব থেকে ভাল সুসংবাদটি শুনাল এই বলে যে, সে আমাদের একা ছাড়তে রাজি নয় তাই তার অন্য এক সহকর্মীকে রাজি করাতে পেরেছে শ্রাবণীর কাজে আজকের দায়িত্বটা পালন করাতে। সুতরাং আমার শ্যালিকাটি আমারই সঙ্গী হচ্ছে। এর থেকে সুখবর কানাডার এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের ক্যালগেরি শহরে কি হতে পারে? অন্য রকম একটা উত্তেজনা নিয়ে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন রাম দাদার ডাক আসে। না খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষার প্রহর গুণতে হলো না। তিনি এলেন যথাসময়ে, এবং নিয়ে গেলেন এসেম্বলি পয়েন্টে। এটা কোন রাস্তাঘাট নয় স্বয়ং এই আয়োজনের উদ্যোক্তা এবং বিশিষ্ট সংগঠক মিঃ শংকর বণিকের বাসস্থান। এটাকে বাসস্থান না বলে পান্থশালা বললে অত্যুক্তি হয় না। কারণ এই দুদিনে লোকটি সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি, শুনেছি তার থেকে বহুগুণ। তিনি একাধারে রিয়েলস্টেট ব্যবসায়ী, সমাজকর্মী, রসিক, ভাল রাঁধুনি এবং সামাজিক ও পারিবারিক আড্ডায় আসর জমাতে তার জুড়ি মেলা ভার। প্রথম দেখাতে বুঝতে অসুবিধা হয়নি লোকটি সম্পর্কে। তারপরের দিন দুটি ভ্রমণের সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চয় চলে আসবে। কারণ তিনিই সকলের মধ্যমণি। মণি ছাড়া সকলে চলবে কিভাবে। সেটাই অবশ্য প্রত্যক্ষ করলাম অযাচিত, অপরিচিত সকলের কাছে অনাকাক্সিক্ষত এক প্রমোদ ভ্রমণে সঙ্গী হয়ে। তবে যে যত কথাই বলুক আমাদের পক্ষ থেকে এমন একটা ভ্রমণে অপরিচিত অথচ সকলেই আমার প্রিয় মাতৃভূমির মানুষের সঙ্গে এই বিদেশ বিভূয়ে সঙ্গী হতে পেরে ষোলো কলা পূর্ণ করতে ঝুট্টি জামেলা একটুও পোহাতে হয়নি। অন্যথায় যে উদ্দেশ্যে নিয়ে আমাদের ক্যালগেরি অভিযান তার সামান্যই হয়ত পূরণ হতে পারত কিনা সন্দেহ। তবে নিঃসন্দেহে ভাল লেগেছে দলের প্রত্যেকটা সদস্যের আন্তরিকতা, সহমর্মিতা আর ভালবাসায় পরিপূর্ণ একটা অনাবিল আনন্দঘন পরিবেশে পরিপূর্ণ সফল ও সংক্ষিপ্ত সফরের পরিসমাপ্তিতে। চলবে...
×