
বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী আইন থাকলেও, অনেক পুরুষ বলছেন তাদের জন্য এমন কোনো নির্দিষ্ট আইন নেই। অভিযোগ করছেন, ঘর-সংসারে তারা মানসিক ও কখনো কখনো শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, অথচ আইন তাদের পাশে দাঁড়ায় না। দীর্ঘদিন ধরে পুরুষরা দাবি জানিয়ে আসছেন একটি পৃথক ‘পুরুষ নির্যাতন প্রতিরোধ আইন’-এর। কিন্তু আসলেই কি আইন নেই? নাকি প্রচলিত আইনের ভুল ব্যাখ্যায় পুরুষরা বঞ্চিত হচ্ছেন ন্যায্য বিচার থেকে? চলুন জেনে নিই বাংলাদেশের প্রচলিত চারটি আইনে কীভাবে পুরুষরা আইনি সহায়তা পেতে পারেন বা পাচ্ছেন না।
আইন অনুযায়ী পুরুষ নির্যাতনের চিত্র ও ব্যাখ্যা:
১. দণ্ডবিধি, ১৮৬০:
এই আইনে নারী বা পুরুষ উভয়েই শারীরিক নির্যাতনের শিকার হলে মামলা করতে পারেন। বিশেষ করে ৩২৩, ৩২৪, ৩২৫ ও ৩২৬ ধারাগুলো অনুসারে যদি কারও দেহে আঘাত লাগে বা শারীরিক ক্ষতি হয়, তবে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মামলা করা যায়। অর্থাৎ, স্ত্রী কর্তৃক স্বামী নির্যাতনের ঘটনাও এ ধারায় বিচারযোগ্য।
২. নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০:
এই আইন শুধুমাত্র নারী ও শিশুদের সুরক্ষার জন্য প্রণীত। এখানে নির্দিষ্ট করে বলা আছে, যৌতুকের জন্য নারীরা নির্যাতনের শিকার হলে তারা এই আইনে মামলা করতে পারবেন। কিন্তু পুরুষদের এই আইনের আওতায় কোনো সুরক্ষা নেই। যদিও দণ্ডবিধিতে একই ধরনের সুরক্ষা থাকলেও নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে আবারও আলাদাভাবে নারীদের জন্য আইনি সুযোগ রাখা হয়েছে।
৩. যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮:
এই আইনটিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এখানে নারী-পুরুষ উভয়েরই সমান অধিকার রয়েছে। যদি বিবাহিত জীবনে কোনো পক্ষ যৌতুক দাবি করে, তবে অপর পক্ষ এই আইনে মামলা করতে পারে। অর্থাৎ, স্বামী যৌতুকের দাবিতে নির্যাতিত হলে তিনিও এই আইনে আইনি প্রতিকার চাইতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো বেশিরভাগ বিচারক, আইনজীবী এমনকি সাধারণ মানুষের মাঝেও এই আইনের ব্যাখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। ফলে পুরুষদের অনেক সময় এ সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হতে হয়।
৪. পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০:
এই আইনে কেবলমাত্র নারী ও শিশুদের পক্ষ থেকেই মামলা করার সুযোগ রয়েছে। পুরুষদের জন্য কোনো সুরক্ষা রাখা হয়নি। তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো এই আইনে অভিযুক্তকে সাধারণত সাজা দেওয়া হয় না, বরং আদালত তাকে সহিংসতা বন্ধে আদেশ দেন। সেই আদেশ অমান্য করলে তবেই শাস্তির বিধান আছে। আইনটি মূলত পারিবারিক সম্পর্ক বজায় রেখে সহিংসতা ঠেকানোর উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছিল।
পুরুষদের অভিযোগের বড় একটি অংশ মানসিক নির্যাতনের ঘিরে। স্ত্রী কর্তৃক অপমান, অসম্মান, চাপ সৃষ্টি কিংবা সামাজিক হুমকি অনেক সময় পুরুষদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, বাংলাদেশের কোনো আইনেই মানসিক নির্যাতনের নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই এবং নেই প্রতিকার ব্যবস্থাও। তবে কোনো পুরুষ যদি মনে করেন, এই মানসিক নির্যাতন সংসার অযোগ্য করে তুলেছে, তাহলে তিনি তালাকের মাধ্যমে সম্পর্ক শেষ করার অধিকার রাখেন।
অন্যদিকে, যদি স্ত্রী কর্তৃক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন, তাহলে দণ্ডবিধির ৩২৩, ৩২৪, ৩২৫ ও ৩২৬ ধারা অনুযায়ী মামলা করা এবং আইনি প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে পুরুষ নির্যাতনের সরাসরি উল্লেখ না থাকলেও একাধিক আইনের ভেতর দিয়ে তারা কিছুটা হলেও সুরক্ষা পান। তবে মানসিক নির্যাতন, সামাজিক অসম্মান কিংবা প্রতীকী সহিংসতার বিচারপ্রাপ্তির জায়গা এখনো শূন্য। সময় এসেছে আইনবিদ, সমাজবিদ ও রাষ্ট্রকে এই ইস্যুতে নতুন করে ভাবার। কারণ নির্যাতন যেই করুক, ভুক্তভোগী হলে সে বিচারপ্রার্থী হতেই পারে সেটি নারী হোক বা পুরুষ।
আফরোজা