
ছবি: সংগৃহীত
তেহরানের রাস্তায় এখন শুধু আতঙ্কের চিহ্ন। কারো হাতে স্যুটকেস, কারো কোলে ছোট শিশু— হন্যে হয়ে সবাই খুঁজছে নিরাপদ আশ্রয়। কেউ পাতাল রেলের দিকে দৌড়াচ্ছে, কেউ ট্রাফিক জ্যামের মধ্যে গাড়ির মধ্যে রাত কাটাচ্ছে।
কিন্তু পুরো শহরে নেই কোনো সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র, নেই কোনো আগাম সতর্ক সংকেত বা পরিকল্পিত উদ্ধারব্যবস্থা। তাই ইরানের তরুণ প্রজন্ম— বিশেষ করে জেনারেশন-জি এখন নিরাপত্তার আশ্রয় খুঁজে নিচ্ছে একমাত্র উন্মুক্ত জায়গা, ইন্টারনেট-এ।
জেনারেশন-জি (যারা ১৯৯৫ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে জন্ম নিয়েছে) বেড়ে উঠেছে নিষেধাজ্ঞা, সেন্সরশিপ, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা আর রাজনৈতিক দমনপীড়নের মধ্যে। তবুও তারা প্রযুক্তি আর অনলাইন জগতকে ব্যবহার করে নিজেদের জন্য তৈরি করেছে এক ভিন্ন পৃথিবী— যেখানে তারা মুক্ত, একে অপরের সঙ্গী, আর নিজেদের মত প্রকাশ করতে পারে।
২৪ বছর বয়সী মোমো, একজন আইটি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র, এখনো তেহরানেই আছে। “আমরা জানি না, কোথায় গেলে নিরাপদ থাকব। আশেপাশের বিল্ডিংগুলোতে হয়তো গোপনে সামরিক কার্যক্রম চলছে। কেউ হয়তো গোয়েন্দা সংস্থার লোক। তাই কোথাও যাওয়া মানেই আরও ঝুঁকি,” সে জানায়।
তবুও মোমো শহর ছাড়েনি। শুধু তার দুই বছরের ‘রেস্কিউ ক্যাট’-এর জন্য নয়, বরং নিজের দৃঢ় বিশ্বাস থেকে। “আমার বাড়িই আমার কবর হলেও আমি পালিয়ে যাব না। আমাদের জীবন এখানে, এই শহরে,” সে বলেছে।
মোমো সাত বছর ধরে ডিসকর্ড ব্যবহার করছে। আগে সেটা ছিল গেম খেলার সময় বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য। এখন সেটা হয়ে উঠেছে ‘দ্বিতীয় ঘর’।
“ডিসকর্ডে আমরা শুধু গল্পই করি না, একসাথে সিনেমা দেখি, টিভি সিরিজ দেখি। মাঝেমধ্যে ঘুমিয়েও পড়ি একসাথে— অনলাইনে,” মোমো জানায়।
ডিসকর্ড এখন ইরানের লাখ লাখ তরুণের অনলাইন আশ্রয়। গেম, বিনোদন, মানসিক সহায়তা, এমনকি মৃত্যু বা শোক ভাগাভাগি করাও হয় এখানে।
২৩ বছর বয়সী সামিন জানায়, “আমরা গেম খেলছিলাম। হঠাৎ চারপাশে বিস্ফোরণের শব্দ। প্রথমে বুঝতেই পারিনি এটা গেমের আওয়াজ, না কি বাস্তব বোমা। আমাদের গেমেও তো গুলি-বোমা থাকে, কিন্তু এবার মনে হলো রিয়েল লাইফেই গেম খেলছি।”
২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে ইরানে সরকারিভাবে ডিসকর্ড বন্ধ করে দেওয়া হয়। যদিও সরকার বলেছে, ‘অশ্লীলতা ঠেকাতে’ এটি করা হয়েছে, কিন্তু অনেকেই মনে করে, আন্দোলন সংগঠিত হওয়া ঠেকাতেই এই পদক্ষেপ।
তবুও তরুণরা থেমে যায়নি। নানা পদ্ধতিতে, ভিপিএন দিয়ে, বিকল্প লিঙ্কে তারা আবারও ফিরেছে তাদের ডিজিটাল আশ্রয়ে।
“অনেক সময় শুধু একটি ভিপিএন খুঁজতেই কয়েক ঘণ্টা লেগে যায়,” বলে সামিন। “কেউ যদি অনলাইনে না আসে, সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। কল দিই। মাঝপথে যদি আওয়াজ কেটে যায়, ভয় হয় সে হয়তো বেঁচে নেই।”
তারা একে অপরকে চিনে না অনেক সময়, দেখা হয়নি কখনও। তবুও, তারা জন্মদিন পালন করে, কান্না শোনায়, বোমার শব্দ শেয়ার করে, স্বজন হারানোর যন্ত্রণা ভাগাভাগি করে।
তেহরানের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ, যার নাম ছিল “Yoga for Pregnancy”। একদা এটি ছিল গর্ভবতী নারীদের জন্য অনলাইন ইয়োগার ক্লাস। এখন সেটিই পরিণত হয়েছে যুদ্ধকালীন সংকট মোকাবেলায় এক ধরনের ডিজিটাল সহায়তা কেন্দ্রে।
জোহরেহ ও আমিনেহ দুজনই পিএইচডি ডিগ্রিধারী এবং আমেরিকার গ্রিন কার্ডধারী। কিন্তু দুইজনের সিদ্ধান্ত ছিল ভিন্ন। জোহরেহ সন্তান জন্ম দিতে ইরান ফিরে এসেছেন পরিবারের সাপোর্ট পেতে। আর আমিনেহ থেকে গেছেন সান ফ্রান্সিসকোতে— নিরাপত্তার কথা ভেবে।
জোহরেহ বলছেন, “যখন ইসরায়েলের বোমা পড়ছিল, তখন আমি আট মাসের গর্ভবতী। এক রাতে বিস্ফোরণের শব্দে আমার contractions শুরু হয়ে যায়। তখন গ্রুপের এক বন্ধু আমাকে নিঃশ্বাস কন্ট্রোল করতে বলে। আরেকজন বলল বাচ্চা না নড়লে গান চালাতে, মালিশ করতে, হালকা ইয়োগা করতে।”
অনেকে শহর ছাড়তে চেয়েছিল, কিন্তু যানজট, প্রসব ঝুঁকি, হাসপাতাল না পাওয়া—এসব কারণেই থেকে গেছেন তারা।
যখন বোমা পড়ে, বিদ্যুৎ চলে যায়, সরকার কোনো আশ্বাস দেয় না— তখনও জেনারেশন-জি একে অন্যের খোঁজ রাখছে। প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে তারা তৈরি করেছে একটা মানবিক বৃত্ত—যেখানে ভয়ের মধ্যেও জেগে আছে সাহস, বন্ধুত্ব আর ভালোবাসা।
এই ডিজিটাল সংযোগ শুধু প্রযুক্তির উপহার নয়, এটা একধরনের প্রতিরোধ— যেখানে তরুণরা বলছে, “আমরা একা নই।”
বি.দ্র.: এই প্রতিবেদনটিতে উল্লেখিত নাম ও কিছু পরিচয় নিরাপত্তার কারণে পরিবর্তন করা হয়েছে।
সূত্র: আল জাজিরা
এম.কে.