
সিঙ্গাপুরের হৃদয়ে, পুরনো শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত কাম্পং গ্ল্যাম একটা এলাকা যা শুধু ইতিহাস নয়, বহুসংস্কৃতির গাঢ় ছোঁয়ায় গড়া এক সমাজচিত্র। এই অঞ্চলের মধ্যমণি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক অনন্য স্থাপনা সুলতান মসজিদ। আজ এটি শুধুমাত্র একটি উপাসনালয় নয়, বরং সিঙ্গাপুরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ধর্মীয় সহনশীলতা এবং সামাজিক সংহতির এক অবিচ্ছেদ্য প্রতীক।
১৮২৪ সালে, সিঙ্গাপুরের প্রথম সুলতান হুসেইন শাহের উদ্যোগে এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সহযোগিতায় যাত্রা শুরু করে সুলতান মসজিদ। প্রাথমিক কাঠের গঠন ছিল সরল, তবে সময়ের চাহিদা আর স্থাপত্যের বিবর্তনে ১৯৩২ সালে এটি পূর্ণাঙ্গ রূপে আত্মপ্রকাশ করে। দায়িত্বে ছিল ব্রিটিশ স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান Swan and Maclaren, যারা ইন্দো-সারাসেনিক স্থাপত্যরীতিতে মসজিদটিকে নতুন প্রাণ দেন।
মসজিদের কেন্দ্রীয় গম্বুজের নিচে থাকা কালো কাচের বেল্টটি শুধু সৌন্দর্যের অনুষঙ্গ নয়—এটি এক গভীর সামাজিক বার্তা বহন করে। ইতিহাস জানায়, ১৯৩০-এর দশকে পুনর্নির্মাণের সময় দরিদ্র মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যরা দান করেছিলেন কালো সসের কাচের বোতল। সেই কাচ দিয়ে নির্মিত হয় এই বেল্ট। প্রতীকীভাবে এটি বলে দেয়—এই মসজিদ সবার, এই ঐতিহ্য সবার।
রেডিও বা টেলিভিশনের যুগের আগের কথা। তখন সুলতান মসজিদের শুক্রবারের খুতবা ছিল স্থানীয় মুসলিমদের জন্য সপ্তাহব্যাপী খবর, দিকনির্দেশনা ও সামাজিক বার্তা পাওয়ার প্রধান উৎস। মসজিদটি ছিল ধর্মীয় নেতৃত্বের পাশাপাশি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি গঠনেরও কেন্দ্র।
আজকের সুলতান মসজিদ আগের চেয়ে আরও বিস্তৃত ভূমিকা পালন করছে। ধর্মীয় কার্যক্রম ছাড়াও এটি এখন এক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র—যেখানে চলতে থাকে আন্তঃধর্ম সংলাপ, তরুণদের শিক্ষা কর্মসূচি, দাতব্য কার্যক্রম ও সম্প্রদায়ের অংশীদারিত্বমূলক নানা উদ্যোগ।
বিশেষ করে ডিজিটাল যুগে এর ভূমিকা নতুন মাত্রা পেয়েছে। এখন মসজিদে রয়েছে ডিজিটাল রিসোর্স, অনলাইন খুতবা, ভার্চুয়াল ট্যুরের ব্যবস্থা, এমনকি মানসিক স্বাস্থ্য ও কর্মজীবন সংক্রান্ত পরামর্শ সেবার পরিকল্পনাও আছে।
সুলতান মসজিদ এখন আর কেবল ইতিহাস নয়—এটি বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্যও এক নিরাপদ আশ্রয় ও অনুপ্রেরণার জায়গা। ধর্ম, সংস্কৃতি, সমাজ—তিনের মিলনে গড়ে উঠা এই স্থাপনাটি আজও বলছে, ভিন্নতা থাকুক, কিন্তু বন্ধন ছিন্ন না হোক।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, মসজিদের এই রূপান্তর সিঙ্গাপুরের অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের পথকে যেমন সুদৃঢ় করেছে, তেমনি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের আধুনিকায়নের এক উদাহরণ হিসেবেও এটি অনন্য।
সুলতান মসজিদ শুধু ইট-পাথরের স্থাপত্য নয়, এটি একটি চলমান ইতিহাস। এটি এমন এক জায়গা, যেখানে ধর্মীয় পরিচয়ের সঙ্গে সাংস্কৃতিক সহাবস্থান এবং সামাজিক দায়িত্বের মেলবন্ধন ঘটেছে সফলভাবে। সিঙ্গাপুরের বৈচিত্র্যময় সমাজে এটি এক অমূল্য প্রতীক—প্রেরণার, ঐক্যের ও সম্ভাবনার।
আঁখি