
ছবি আলজাজিরা
একটি অন্ধকার, গুমোট তাপে ভরা তাঁবুর মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন আসীল (৫১) ও আফাফ (৩৩)। দুই বোনই মস্তিষ্কজনিত প্রতিবন্ধিতা ও সিলিয়াক রোগে আক্রান্ত। কথাবার্তা, আচরণ, এমনকি নিজেদের আবেগ প্রকাশেও যাঁদের সীমাহীন কষ্ট। তাদের পাশে ছায়ার মতো রয়েছেন বড় বোন রনিম আবু আল-ঈশ (৩০), যিনি শুধু তাদের সেবাযত্নই করছেন না—একই সঙ্গে লড়ছেন যুদ্ধ, অভাব, অনাদর আর সমাজের নির্মমতা।
রনিম বলেন, তারা নিজেরা বোঝাতে পারে না কী চায়, কী লাগবে। চারপাশের শব্দ, লোকজনের ভিড়, হঠাৎ চিৎকারে তারা বিচলিত হয়ে পড়ে। কখনও চিৎকার করে, কান্না করে, আবার কখনও অপ্রত্যাশিতভাবে আচরণ করে।
এই দুই বোন কেবল যে বাক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবন্ধিতা নিয়ে লড়ছেন তা-ই নয়, তাদের দেহ সহ্য করতে পারে না গ্লুটেনজাতীয় খাদ্য। কিন্তু গাজার বর্তমান পরিস্থিতিতে গ্লুটেন-মুক্ত খাবার পাওয়া তো দূরের কথা, সামান্য খাবার জোটানোই কঠিন হয়ে পড়েছে।
বাস্তুচ্যুতির ভয়াবহ স্মৃতি ও নির্মম বাস্তবতা
তারা একসময় বাস করতেন জাবালিয়া ক্যাম্পের ব্লক ২-এ। আট মাস আগে ইসরায়েলি হামলায় তাদের বাড়ি ধ্বংস হয়। সেই থেকে এক আশ্রয়স্থল থেকে আরেকটিতে, আত্মীয়ের ঘর, জাতিসংঘ পরিচালিত স্কুল, শেষ পর্যন্ত ঠাঁই হয়েছে এই গুমোট তাপধারী তাঁবুতে।
এই তাঁবুতে ঠাসাঠাসি করে থাকেন সাতজন—রনিম, তার দুই প্রতিবন্ধী বোন, বৃদ্ধ মা-বাবা এবং এক বোন ও তার স্বামী। রনিমের মা বেশ দুর্বল আর বাবা এখনও ইসরায়েলি হামলায় পাওয়া আঘাতের পুনর্বাসনে। পুরো পরিবারের দায়িত্ব তাই একাই কাঁধে তুলে নিয়েছেন রনিম।
মানুষ হাসে, আর ওদের মন ভেঙে যায়
আসীল ও আফাফ প্রতিনিয়ত চরম সামাজিক বঞ্চনার শিকার হন। প্রতিবন্ধিতার কারণে অনেক সময় আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে আশেপাশের মানুষ—বিশেষ করে শিশুরা—তাদের উপহাস করে, কটু মন্তব্য করে।
প্রতিবার টয়লেটে গেলে মানুষ তাকিয়ে থাকে, হাসে, মন্তব্য করে। ওদের জন্য এটা অসম্মানের, আর আমার জন্য অজস্র লজ্জার, বলেন রনিম।
যার ছিল দায়িত্ব, তাকেই ধরে নিয়ে গেছে ইসরায়েল
এই পরিবারের সবচেয়ে বড় ভরসা ছিলেন রনিমের ছোট ভাই মোহাম্মদ (২২)। ওষুধ সংগ্রহ, হাসপাতালের দেখা-শোনা, ত্রাণ সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ—সবই সামলাতেন তিনিই। কিন্তু গত ২৫ অক্টোবর কমাল আদওয়ান হাসপাতালে হাতের অস্ত্রোপচারের জন্য গেলে ইসরায়েলি সেনারা সেখান থেকে তাকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর থেকে তার আর কোনো খোঁজ মেলেনি।
সে ছিল ওদের রক্ষাকর্তা, কাঁপা গলায় বলেন রনিম, তারপর থেকেই আমরা একেবারে একা।
যুদ্ধের মধ্যে প্রতিবন্ধীরা সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত
২০২৫ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজায় বাস্তুচ্যুত জনগণের অন্তত ১৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী। অথচ যেসব অস্থায়ী আশ্রয়—যেমন শিবির, স্কুল, এমনকি হাসপাতালগুলো—তাতে নেই প্রতিবন্ধীদের জন্য পর্যাপ্ত র্যাম্প, শৌচাগার, বা অন্য কোন সহায়ক ব্যবস্থা।
স্নায়ু ও মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞ ডা. সারা আল-ওয়াহিদি বলছেন, যুদ্ধকালে প্রতিবন্ধীদের সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়। অনেক সময় তারা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, কেউ নিখোঁজ হয়, কেউ পরে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
ভুলে গেছে বিশ্ব, বারবার কেবল করুণা চাইতে হয়
রনিম বলেন, আমাদের বারবার নতুন জায়গায় গিয়ে শুরু করতে হয়—তাদের অবস্থা বুঝিয়ে বলতে হয়, দয়া চাইতে হয়। এরা কেবল যুদ্ধের শিকার নয়, এরা এমন মানুষ যাদের ভুলে গেছে বিশ্ব।
যুদ্ধ, দারিদ্র্য, সমাজের অবজ্ঞা আর চিকিৎসা-সহযোগিতার অভাবে আসীল ও আফাফের লড়াই এখন কেবল আর বেঁচে থাকার। এমন নিঃসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে আমরা কেউ কি প্রস্তুত?
ফরিদ