
ডিএনএ দিচ্ছেন শোকাহত পরিবার ,ছবি: সংগৃহীত
আহমেদাবাদ বিমানবন্দরে গতকালও সানজিতা গৌস্বামী তাঁর ১৯ বছর বয়সী একমাত্র সন্তান সংকেতকে জড়িয়ে ধরে ছিলেন। লন্ডনের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়া এই তরুণকে বিদায় জানানোর মুহূর্তে মায়ের বুক ছিল গর্বে ভরা। কিন্তু আজ, মাত্র ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে, একই পোশাকে বসে আছেন তিনি - এবার শোক আর হতাশায় কুঁকড়ে। তাঁর সন্তান সংকেত ছিলেন এয়ার ইন্ডিয়ার এআই১৭১ ফ্লাইটের যাত্রী, যা উড্ডয়নের মাত্র কয়েক সেকেন্ড পরেই মাটিতে আছড়ে পড়ে। ২৪২ জন যাত্রী-ক্রুর মধ্যে বেঁচে আছেন মাত্র একজন, আর পিছনে ফেলে গেছেন শতাধিক ভগ্নহৃদয় পরিবার।
ভারতের জাতীয় দুর্যোগ মোকাবেলা বাহিনীর তিন কর্মকর্তা সিএনএনকে নিশ্চিত করেছেন, বিধ্বস্ত বিমানের ফ্লাইট রেকর্ডার উদ্ধার করা হয়েছে। এই ব্ল্যাক বক্স দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বোয়িং ড্রিমলাইনার বিমানটি একটি মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে আঘাত হানে, যেখানে ভূমিতে থাকা অনেকে নিহত হয়েছেন। এটি গত কয়েক দশকের মধ্যে ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনাগুলোর একটি।
সানজিতা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে আশায় বুক বেঁধেছিলেন যে তাঁর ছেলে হয়তো বেঁচে আছেন। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাতে সেই আশায় ছেদ পড়ে যখন তাঁকে ডিএনএ নমুনা দিতে হয় একমাত্র সন্তানের মরদেহ শনাক্ত করার জন্য। "আমাদের কোনো খবর দেওয়া হচ্ছে না," কান্নায় ভেঙে পড়া সানজিতা বলেন তাঁর বোনের কাঁধে হেলান দিয়ে, যিনিও অঝোরে কাঁদছেন।
৩৮ বছর বয়সী সানি কাকাডিয়ার দীর্ঘদিনের বন্ধু জাভেদ আলি সাইদ ও তাঁর স্ত্রী মরিয়ম, ৬ বছরের জায়ান ও ৪ বছরের আমানিকে নিয়ে ছিলেন ওই অভাগা ফ্লাইটে। মুম্বাইতে একসাথে বড় হওয়া, কলেজে পড়া ও একে অপরের বিয়েতে যোগ দেওয়া এই বন্ধুটি লন্ডনে হোটেল ম্যানেজমেন্টের চাকরি করতেন। তিনি মায়ের হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য ভারতে এসেছিলেন। কাকাডিয়া সিএনএনকে বলেন, "আমরা রাত ২টায় হাসপাতালে পৌঁছাই। জাভেদের ভাই ডিএনএ নমুনা দিয়েছেন। আমাদের বলা হয়েছে রবিবারের আগে ফলাফল মিলবে না।"
আহমেদাবাদ সিভিল হাসপাতালে ১৯০ জনের বেশি আত্মীয়ের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে, যা দুর্ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা দেহাবশেষের সাথে মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। রাজ্য কর্মকর্তা হর্ষিত গোসাভি জানান, এই মর্মান্তিক প্রক্রিয়া ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় নিতে পারে।
হাসপাতালের করিডোর জুড়ে শোকের ছায়া। এক কোণে এক বয়স্ক মহিলার করুণ ক্রন্দন অন্যান্যদের মৃদু কান্নাকে ডুবে দেয়। গতকালের সেই বিশৃঙ্খল দৃশ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত আজকের করুণ অবস্থা, যখন আত্মীয়রা প্রিয়জনদের জীবিত অবস্থায় পাবার আশায় হাসপাতালে ছুটে এসেছিলেন।
পাটনা থেকে দ্রুততম ফ্লাইটে ছুটে এসেছেন মানিশা থাপার পরিবার। ২৭ বছর বয়সী এই এয়ার হোস্টেস ছিলেন ওই ফ্লাইটের ক্রু সদস্য। তাঁর মা কাঁপা গলায় বলেন, "আমি গতকালই তাঁর সাথে কথা বলেছি। তিনি জানিয়েছিলেন দীর্ঘ ফ্লাইটে থাকায় কিছুক্ষণের জন্য কথা বলতে পারবেন না।" মানিশার বাবা শুক্রবার সকালে ডিএনএ নমুনা দেওয়ার পর থেকেই অঝোরে কাঁদছেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শুক্রবার আহমেদাবাদে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং একমাত্র জীবিত ব্রিটিশ নাগরিক বিশ্বাস কুমার রমেশের সাথে দেখা করেন। রমেশের বেঁচে যাওয়ার ঘটনাকে অলৌকিক হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে। রক্তাক্ত শার্টে দুর্ঘটনাস্থলে আহতদের সাহায্য করতে দেখা গেছে তাঁকে। তিনি ডিডি নিউজকে বলেন, "প্রথমে ভেবেছিলাম আমি মারা যাব... তারপর বুঝলাম আমি বেঁচে আছি। আমার সিটের কাছে একটি খোলা জায়গা দেখে পা দিয়ে ঠেলে বেরিয়ে আসি। আমার চারপাশে সবাই মারা গেছে বা মরতে বসেছে। আমি এখনও বুঝতে পারছি না কিভাবে বেঁচে গেলাম।"
মৃত ও নিখোঁজদের তালিকা চূড়ান্ত করা ও পরিবারগুলোকে সহায়তা করাই এখন কর্তৃপক্ষের প্রধান লক্ষ্য। তবে শীঘ্রই নজর দেওয়া হবে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে। মার্কিন জাতীয় পরিবহন নিরাপত্তা বোর্ড ও যুক্তরাজ্যের বিমান দুর্ঘটনা তদন্ত শাখা ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করার প্রস্তাব দিয়েছে।
সাব্বির