
ছবিঃ সংগৃহীত
সন্তানের চোখে বাবার আলাদা কোনো পরিচয় থাকে না। বাবা যেন " বাবা"ই। মা যেমন মা, বাবাও তেমনি বাবা। বাবার ইচ্ছে স্বপ্ন শিক্ষায় লালিত হয় সন্তান। বাবার শিক্ষা ও সংস্কৃতিও সন্তানের শিক্ষা ও সংস্কৃতি হয়ে যায়।
আজকের শিশুর মতো একদা আমিও শিশু ছিলাম। আমারো বাবার ভয় ছিলো। শাসন ছিলো। স্নেহ ও মমতা ছিলো। আমরা ভাইবোনেরা বাবাকে খুব ভয় পেতাম শৈশবে। বাবা ভারি কঠোর হতেন তখন, যখন আমরা কোনো নিয়মভঙ্গ করতাম। বাড়ির নিজস্ব রীতি ও রেওয়াজের বাইরে যাওয়া বাবা পছন্দ করতেন না।
বাবা পরিশীলিত, মার্জিত, ভদ্র হতে নানাভাবে শিক্ষা দিতেন। ছোটোবেলায় বাবার শাসনকে খারাপ লাগলেও একটু বড়ো হয়ে বুঝেছি, ওটুকু খুব দরকার ছিলো। নতুবা আমরা বোধ হয়, সুশৃঙ্খলভাবে বড়ো হবার সুযোগ পেতাম না।
বাবার পছন্দ ও রুচি মোতাবেক আমরা পোশাক পরতাম। চলাফেরা করতাম। এমনকি খেলাধুলা পড়াশোনা সবকিছুতেই ছিলো বাবার সজাগ দৃষ্টি।
বাবার স্নেহ অতি-আবেগের উপচে পড়া অতিরঞ্জন নয়। বরং কঠিন এক খোলসের ভিতরে অতি কোমল সেই মমতার আবরণ।
আমার বাবা তাঁর বাবার জ্যেষ্ঠপুত্র ছিলেন। জমিদারি রক্তের কিছু ধারা ছিলো শরীরে। পুরো পরিবারেই তেমনি শিক্ষা সংস্কৃতি আচার বিচার রস ও রুচি বজায় ছিলো।
বাড়ির চৌহদ্দির ভিতরে ছিলো মেয়েদের ওঠাবসা। বাহিরমহলে বেড়ানো একেবারেই চলতো না। মেয়েরা অন্দরমহলে যা খুশি করুক ( পড়া, গান, নাচ, অভিনয় যা খুশি) কিন্তু বাড়ির বাইরে নয়। এমনি দেখেশুনে আমার বাবাও বড়ো হয়েছেন বলে, বাবাও অনেকটা রক্ষণশীল মানসিকতাকে প্রশ্রয় দিতেন।
আমাদের ছোটোবেলা কেটেছে মহা আনন্দে। আমরা বাড়ির ভিতরে পেয়েছি সুসংস্কৃত পরিবেশ। বিশাল লাইব্রেরি ছিলো। আমার পিতামহ ও পিতামহী বইয়ের পোকা ছিলেন। আমরাও খুব বই পড়তাম। রামায়ণ মহাভারতের গল্পগুলো দাদু অভিনয় করে দেখাতেন৷ গানবাজনার চর্চাও ছিলো। আমরা পড়াশুনাতেও মনোযোগী ছিলাম। বাড়ির নিয়মের বাইরে যাওয়ার কল্পনাও করতাম না।
আমার বাবা সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেলেও চাকুরি কন্টিনিউ করেননি। চাকুরিতে স্বাধীনতা হরণ হয় বলে মনে করতেন। অতঃপর দর্জিবিজ্ঞান কলেজ থেকে কাটিং এ শিক্ষা নিয়ে টেইলর্স মাস্টার হয়েছিলেন। বাবার অনেক কর্মচারী ছিলো। তারা শিক্ষা শেষে নিজেরাই আবার টেইলারিং পেশায় চলে যেতো।
আমার বাবা সৎ ও নীতিনিষ্ঠ ছিলেন। ধর্মের নামে বাগাড়ম্বর বা আনুষ্ঠানিকতার আড়ম্বর বিশ্বাস করতেন না। বাবা বলতেন, ধর্ম দেখানোর বিষয় নয়। ঈশ্বর কারো ক্রীতদাস নন। তিনি সকলের অন্তরে বাস করেন। ঈশ্বরকে বিশ্বাস করতে হয়। কিন্তু সেই বিশ্বাসটা কারো কাছে বিশ্বাসযোগ্য করার দায় রাখতে হয় না। তুমি ধার্মিক কিনা তার প্রমাণ মিলবে তোমার কথায়, কাজে, আচরণে, চলাচলে। বাবা অন্যায় করতেন না, কারো অন্যায় রোধ করতে না পারলে তার সঙ্গ পরিত্যাগ করতেন। বাবা বলতেন, সমাজশোধন আমার কর্তব্য নয়। আমি আমাকে শোধন করতে পারি।
বাবা খুব মানবিক ও দয়ালু ছিলেন। যেকোনো মহিলা মানুষকে খুব সম্মানের চোখে দেখতেন।
বাবা অপরিচিত মেয়েমানুষের সাথে কথা বলতেনই না পারতপক্ষে। আমরা এমনো দেখেছি, বাড়িতে পাড়াপ্রতিবেশি মেয়েমানুষেরা বেড়াতে এলে বাবা ঘর থেকে বের হতেন না। এ নিয়ে মজা করতেন মা কাকিমা।
বাবা খুব কম কথা বলা পছন্দ করতেন। অতি উচ্চরবে কথা বলা, উচ্চস্বরে হাসা, জোরে জোরে পা ফেলে হাঁটা, অতি উগ্র সাজগোজ এগুলো একদম পছন্দ করতেন না।
বাবার এ হলো একদিক। আরেকদিকে বাবার নরম কোমল মমতাভরা বিশাল মনের পরিচয় রয়েছে।
ছেলেমেয়েদের জীবনে দিয়ে আগলে বড়ো করেছেন। এতটুকু কারো শরীর খারাপ করলে বাবা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তেন। বাচ্চাদের খাওয়াদাওয়ার প্রতিও বাবা সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন।
আমি প্রথম সন্তান বলেই হয়তো বাবা আমাকে সর্বোচ্চ স্নেহ করতেন। মুখ দেখেই বাবা ধরে নিতেন আমার মন কেমন।
বাবার এমন উদার ও স্নেহময় মনের পরিচয় পেয়েছি একটু বড়ো হয়ে। বাবা নিজের হাতে আমাদের জামা কাটতেন। সেলাই করতেন। এনে পরিয়ে দেখতেন আমরা কেমন খুশি হয়েছি।
বাবা যে এত কঠোর শাসক ছিলেন, তথাপি কোনোদিন একটা আঙুলের টোকাও বাবা দেননি আমাকে। আমার বাবা আমাদের বিশ্বাস করতেন। এটা আমাদের বিশাল প্রাপ্তি। বাবা মেয়েদের ছোটোবয়সে বিয়ে দিয়েছেন। কারণ বাবা মেয়েদের ' কোএডুকেশন ' বিষয়টাকে ভয় পেতেন। অথচ বিয়ের পরে বাবার মেয়েরা সবাই পড়াশোনা করে বড়ো হয়েছি, তাতে বাবার আপত্তি ছিলো না।
বাবার কথা তো বলে শেষ করা যায় না। আদরে যত্নে বড়ো করেছেন। পাঁচ মেয়ে বলে বাবা কখনো মেয়েদের কিম্বা মেয়েদের মা'কে কটাক্ষ করেননি। বরং বাবা বলতেন, " আমার পাঁচ মেয়ে। পঞ্চকন্যা। এ কম সৌভাগযের নয়। সকালবেলা ' অহল্যা দ্রৌপদী.. ওদের নাম নেয়ার দরকার হয় না। আমি আমার পঞ্চকন্যার নাম স্মরণ করে দিন শুরু করি।
বাবা পাঁচমেয়ের গ্রুপ ছবি বাঁধিয়ে মাথার কাছে রাখতেন। এখনো ছবিটা মায়ের ঘরে রয়েছে। এতো আমাদের কম পাওয়া নয়।
বাবা ছেলেমেয়েদের উজার করে ভালোবাসেন। এতটুকু কার্পণ্য থাকে না।
বাবা আমাকে আগুনের কাছে যেতে দিতেন না। দা বটিতে বসতে দিতেন না। আমার জন্য নির্দিষ্ট বসার টুল, আমার বাড়িতে পরা জুতা এসব যত্ন করে তুলে রাখতেন৷ আমি গেলে বের করে দিতেন। তারজন্য বাবার জামাই কত তামাশা করতেন।
আমি শ্বশুরবাড়িতে আগুন জল মাটি নিয়ে রাতদিন খেটে মরতাম, বাবা সেটা জানলে ভারি কষ্ট পেতেন বলে, ভুল করেও জানাতাম না। বাবার আদরের বড়োমেয়ে সবসময় ভালো আছে, এটুকু জানলেই বাবা শান্তি পেতেন।
বাবা খুব হাসাতে পারতেন। গল্প বলে মজায়ে রাখতেন। নাতিনাতনি নিয়ে গোল হয়ে বসতেন আসরে। আমরাও বসতাম। বাবার গল্প বলার স্টাইল আর ভাষা.. কাঠখোট্টা লোকও না হেসে পারতো না। বাবা শৌখিন ছিলেন৷ বেড়াতে পছন্দ করতেন। আমাকে পেলেই বেড়ানোর পরিকল্পনা করতেন। বাবা আমাদের কখনো কষ্ট পেতে দেননি।
বাবার আদর্শ আমাদের নিজস্ব আদর্শে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাবার বিশ্বাসের গাঁথুনি আমাদের অস্তিত্বে স্থায়ী হয়ে থেকে গেছে। বাবা শাসনে সোহাগে আদরে যেভাবে যে শিক্ষা ও নীতিতে আমাদের বড়ো করেছেন,আমরা আজীবন তাই ধর্ম মনে করে পালন করছি।
বাবাদের কোনো আলাদা পরিচয় হয় না। জাত ধর্ম দেশ দিয়ে বাবার মনের ভেদ করা যায় না। বাবা তো বাবা-ই।
বাবা নিরাপদ আশ্রয়। মাথার উপরে বিশাল বটবৃক্ষ। বাবার দুহাত যেন সন্তানের লক্ষ্মণরেখা।
বাবাকে চিনতে বুঝতে অনেকটা সময় লাগলেও যখন থেকে বুঝেছি, আমার বাবা একজন আদর্শ ও সৎ মানুষ, সরল ও সোজা মানুষ, উদার ও মানবিকগুণসম্পন্ন মানুষ, দয়া, বিনয়, সততা, সত্যবাদিতা প্রভৃতি গুণের পালক তখন থেকে আমার বাবা আমাদের কাছে একজন সেরা বাবা হয়ে উঠেছেন।
ছোটোবেলায় বাবাকে যতোটা কঠোর ও আপসহীন পেয়েছি, বড়োবেলায় তার চারগুণ পেয়েছি বাবার সদাসরস প্রাণখোলা একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে। বাবা সহ্য করতেন না গোপনীয়তা, অভদ্রতা, অশ্লীলতা, অকথ্য অশ্রাব্য উচ্চারণ, মিথ্যাচার। তাহলেই বাবা হতেন কঠোর অনমনীয়।
আমরা আজো এইসব মনে গেঁথে রেখেছি। একটা অতিক্ষুদ্র অশ্রাব্য শব্দও আমরা মুখে আনতে শিখিনি, বাবার জন্য। সকলের দুঃখে এগিয়ে যাওয়ার শিক্ষাও বাবার কাছে পাওয়া।
মানুষকে ধর্ম ও জাত দিয়ে বিবেচনা করা অন্যায়, বাবা-ই শিখিয়েছেন।
আমার বাবা ২০২১ এ আমাদের সকলকে রেখে মৃত্যুর হাত ধরে অক্ষয়লোকে চলে গেছেন।
যেতে যেতেও বাবার হাত ছিলো আমার মাথায়। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। চেয়ে চেয়ে দেখলাম, বাবা চলে গেলেন। এই চলে যাওয়া বড়ো সত্য অবধারিত।
বাবা দিবস আসে, যায়। বাবাকে প্রতিদিন বিভিন্নসময় বিভিন্ন কাজে মনে পড়ে যায়। বাবাহীন বাবারবাড়িটাও কেমন প্রাণহীন! আত্মার বাঁধন হয়েছে শিথিল।
বাবা প্রতিদিন কল দিয়ে হাসাতেন, গল্প করতেন। সেগুলো মিস করি। বাবা ডাকতেন, আসো। সব মেয়েকে একসাথে ডাকতেন। সবাই একসাথে যেতাম। হৈ-হুল্লোড় হতো। ঘুরতা বেড়াতাম। বাবার মনভরা খুশি আমাদের অসীম আনন্দে ভরিয়ে দিতো। এখন মা আছেন। কিন্তু বাবা তো বাবা-ই। বাবার সেই আহবান, আদর, কোথায় পাবো?
যেখানে আছেন বাবা, ভালো আছেন এই বিশ্বাস রাখি।
জগতের সকল বাবার জন্য শুভকামনা সবসময়।
লেখাঃ ড. ফাল্গুনী রানী চক্রবর্তী, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক (সরকারি কলেজ)
আলীম