ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৪ জুন ২০২৫, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বিলুপ্তির পথে দেশি আম: ভবিষ্যৎ কি হারাবে আমাদের ঐতিহ্যবাহী স্বাদ?

মোঃ সুজা উদ্দিন,কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার,রংপুর

প্রকাশিত: ২৩:২২, ১০ জুন ২০২৫

বিলুপ্তির পথে দেশি আম: ভবিষ্যৎ কি হারাবে আমাদের ঐতিহ্যবাহী স্বাদ?

ছবি: জনকন্ঠ

গ্রামের মেঠো পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে আজও কানে বাজে ঝড়ের দিনের আম কুড়ানোর কলরব। প্রতিটি বাড়িতে শোভা পেত দু-চারটি করে দেশি আমের গাছ-আঁটির আম গাছ। একেক গাছের আমে ছিল একেক রকম স্বাদ, আর তাদের নামও ছিল হরেক রকম-নাইয়া, গান্ধী, মনিয়া, লাল সিঁদুর, কলা সোয়াদি, ল্যাংড়া, কালিয়া আরও কত কী! ভোরে ঘুম ভাঙতেই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে ছুটত আম কুড়াতে। সে এক অন্যরকম আনন্দ, যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
কিন্তু সময়ের স্রোতে সেসব এখন শুধুই স্মৃতি। গ্রামের পর গ্রাম ঘুরলেও দেশি আমের গাছ তেমন চোখে পড়ে না। যে আম একসময় ছিল বাঙালির নিত্যসঙ্গী, গ্রামীণ অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ, তা আজ বিলুপ্তির পথে। নতুন প্রজন্ম হয়তো জানবেও না, দেশি আমের স্বাদ কেমন ছিল, কিংবা শৈশবের আম কুড়ানোর সেই অফুরন্ত আনন্দ।

বিলুপ্তির কারণ: হাইব্রিড ও কলমের আগ্রাসন
দেশি আমের বিলুপ্তির প্রধান কারণ হলো হাইব্রিড ও কলমের জাতের আমের বিস্তার। বর্তমানে কৃষকরা দ্রুত ফলন এবং বেশি ফলনের আশায় বিদেশি ও উন্নত জাতের হাইব্রিড আমগাছ রোপণ করছেন। এসব আম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লাভজনক হলেও, দেশি আমের সেই অনন্য স্বাদ ও গন্ধ থেকে বঞ্চিত হয় মানুষ। দেশি আমের গাছ প্রাকৃতিকভাবে জন্মাতো এবং বেড়ে উঠতো, যেখানে হাইব্রিড জাতের জন্য নিয়মিত পরিচর্যা ও সার প্রয়োগের প্রয়োজন হয়।

স্মৃতির সিন্দুকে দেশি আম
নাইয়া, গান্ধী, মনিয়া, লাল সিঁদুর-এই নামগুলো এখন যেন জাদুঘরের প্রদর্শনীতে থাকা কোনো দুর্লভ বস্তুর নাম। এই আমগুলো শুধু ফল ছিল না, ছিল আমাদের সংস্কৃতির অংশ। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে গ্রামবাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে তৈরি হতো আমের আচার, আমসত্ত্ব, আমের টক ডাল। এসবই ছিল দেশি আমের অবদানে। ঝড়ের দিনে গাছ থেকে পড়া কাঁচা আমে লবণ-মরিচ মেখে খাওয়ার স্মৃতি আজও অনেকের মনে টাটকা। এসব স্মৃতি এখন কেবলই আফসোস জাগায়।

ঐতিহ্য রক্ষায় করণীয়
দেশি আমের এই বিলুপ্তি রোধ করতে হলে আমাদের এখনই সচেতন হতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দেশি আমের চারা রোপণের কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে। কৃষকদের দেশি আম চাষে উৎসাহিত করতে হবে এবং এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। এছাড়াও, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশি আমের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন।

আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশি আম শুধু একটি ফল নয়, এটি আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং শৈশবের প্রতিচ্ছবি।যদি আমরা এখনই পদক্ষেপ না নিই, তবে অদূর ভবিষ্যতে দেশি আম কেবল বইয়ের পাতায় বা পুরোনো গল্পে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে। আর তখন নতুন প্রজন্ম হয়তো শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলবে, "এইতো সেদিনের কথা, গ্রামে কত দেশি আমের গাছ ছিল!"

Mily

×