
শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে বুধবার মঞ্চস্থ সক্রেটিসের জবানবন্দি নাটকের দৃশ্য
বৈশ্বিক রাজনৈতিক ইতিহাসের এক কালোত্তীর্ণ চরিত্র সক্রেটিস। সত্য ও গণতন্ত্রের পক্ষে অবিচল ভূমিকা রেখে গেছেন এই দার্শনিক। গণতন্ত্রের সপক্ষে এবং স্বৈরতন্ত্রের বিপক্ষে অবস্থা নেওয়ায় জীবন দিতে হয়েছিল তাকে। আর সত্যান্বেষী সেই বিয়োগান্তক গল্পের ধারাভাষ্যময় এক নাটক সক্রেটিসের ‘জবানবন্দি’।
সক্রেটিসেরই ছাত্র আরেক বিশ্বখ্যাত দার্শনিক প্লেটো রচিত ‘আপোলোগিয়া সোক্রাতুস’ অবলম্বনে শিশিরকুমার দাশ নয়া আঙ্গিকে লিখেছেন নাটকটি। নাট্যদল দৃশ্যপট প্রযোজিত প্রযোজনাটির নির্দেশনা দিয়েছেন আলী মাহমুদ। বুধবার সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির নাট্যশালার এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে নাটকটির ১৬১তম মঞ্চায়ন হয়।
খ্রিস্টের জন্মের ৪০০ বছর আগের প্রেক্ষাপটে সজ্জিত হয়েছে নাটকের কাহিনি। পেলোপনেসিয় যুদ্ধে এথেন্স পরাজিত হলে রাজ্যের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস হয়। অথচ এথেন্সের গর্ব ছিল তার গণতন্ত্রে। স্বৈরতন্ত্রের যাঁতাকলে পর্যুদস্ত সেই গণতন্ত্র। স্পার্টার নির্দেশে এথেন্সের শাসন ও রাজ্য পরিচালনার ভার তিরিশজন লোকের ওপর ন্যস্ত করা হয়। তাদেরকে নতুন সংবিধান রচনা ও নতুন আইন প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
তারা প্রথমে স্বৈরতন্ত্রের সমর্থক পাঁচশ ব্যক্তিকে নিয়ে একটি আইন পরিষদ গড়ে। সেই পরিষদ আবার দেশের আইন-শৃঙ্খলার ভার তুলে দেয় এগারোজন লোকের হাতে। একাদশ পরিষদ হিসেবে অভিহিত এই এগারোজন হচ্ছে এক ধরনের গুপ্ত পুলিশ। তাদেরকে প্রদান করা হয় অপরিমিত ক্ষমতা। যাদের কাজ ছিল গণতন্ত্রের গলাটিপে ধরা আর গণতন্ত্র সমর্থকদের শাস্তি দেওয়া। এই একাদশ চক্রের প্রধান সাতুরোস এক ভয়াবহ নৃশংস দুর্বৃত্ত। একাদশ চত্রের কাজ হলো গণতন্ত্রের গলাটিপে ধরা, গণতন্ত্রের সমর্থকদের শাস্তি দেওয়া ও অত্যাচার করা।
ফলে অসংখ্য লোকের বিনা বিচারে প্রাণ যায়। কিন্তু একদিন স্বৈরতন্ত্রের মধ্যেই বিক্ষোভ জাগল। ঘেরামেনেস, যিনি নিজে এই তিরিশজনের একজন ছিলেন, তার মনে জাগল সংশয়, বিবেকের তাড়না। ফলে তিরিশ স্বৈরাচারী তাদের অন্যায় কাজের জন্য নানাভাবে বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন খোঁজা শুরু করল। সেই সুবাদে একদিন সক্রেটিসের ওপর আদেশ জারি করা হলো যে, একজন নিরীহ নাগরিককে ধরে আনতে হবে। কাজটা কঠিন নয়, তারা নিজেরাই লোক পাঠিয়ে ধরে আনতে পারত যাকে খুশি। কিন্তু সক্রেটিসকে দিয়ে কাজটা করাতে পারলে সবাইকে বোঝানো যাবে যে সক্রেটিস তাদের সমর্থক।
স্বৈরশাসকেরা তাদের সমর্থক হিসেবে সক্রেটিসের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন। তবে সক্রেটিস তাদেরকে সমর্থন দিতে অস্বীকৃতি জানান। শাসকগোষ্ঠী শুরু করে অত্যাচার-নিপীড়ন। প্রহরীরা সক্রেটিস ভেবে বিভিন্নজনকে ধরে আনতে শুরু করলে একদিন সক্রেটিস নিজেই এসে উপস্থিত হন একাদশ চক্রের সামনে। পাঁচশ একজন বিচারকের সামনে তার বিচার হয়। তখনকার আথেন্সে উকিলের ব্যবস্থা ছিল না। আসাাম এবং ফরিয়াদী উভয়েই বিচারকের সামনে তাদের বক্তব্য ব্যক্ত করতেন।
বিপুলসংখ্যক বিচারকের মধ্যে অনেকেই দেশের আইন সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিলেন না এবং অনেক রক্ষত্রেই তারা বক্তাদের ভাষণ চাতুর্যে প্রভাবিত হতেন। ভাষণ তৈরি করে দেওয়ার জন্য একশ্রেণির লেখক সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিল। সক্রেটিসকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। রাজনীতিবিদ আনুতুস তার বিরদ্ধে অভিযোগ এনেছিলেন যে, তিনি যুবসমাজকে বিপথে নিয়ে যাচ্ছেন এবং তিনি রাষ্ট্রস্বীকৃত দেবতাদের বিরোধী। তখনকার নিয়ম অনুসারে দ-িত ব্যক্তি নিজেই কোনো লঘুদ-ের প্রস্তাব করতে পারতেন।
বিচারকেরা ইচ্ছে করলে সেই প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারতেন। সক্রেটিসকেও সেই সুযোগ দেওয়া হয় কিন্তু তিনি এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। সক্রেটিস তার জবানবন্দিতে স্পষ্ট বলেছিলেন- তিনি তার বিবেকের দ্বারা চালিত হতে চান। সক্রেটিসের মৃত্যদণ্ড দেওয়ার পরে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করতে হয় প্রায় তিরিশ দিন।
এই অবসরে বন্দিশালা থেকে পলায়নের সমস্ত পরিকল্পনা তিনি দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেন এবং শেষ পর্যন্ত নির্লিপ্তভাবে হেমলক বিষ পান করেন। এভাবেই সক্রেটিসের মৃত্যু তাকে দিয়েছে অমরত্ব আর তার বিরোধীদের জন্য রেখে গেছে অনাগত মানুষের তিরস্কার।