গত ২৯ এপ্রিল মুক্তি পেয়েছে রেদোয়ান রনি পরিচালিত ২ ঘণ্টায় নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংরক্ষিত থাকা বাংলা চলচ্চিত্র ‘আইসক্রিম’। সিনেমাটি মুক্তির আগে থেকেই দর্শকদের এবং চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষদের কলরবে ছিল এ চলচ্চিত্র। সিনেমাটি নিয়ে ভণিতা না বাড়িয়ে বলতে গেলে বলা যায়, সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার পর এটা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের যে ধারা, তার বাইরে গিয়ে মাঝে মধ্যে কিছু সিনেমা তৈরি হয় তেমনি একটি সিনেমা হলো ‘আইসক্রিম’। মানুষের মধ্যে ভাষাভেদে পার্থক্য দেখা যায় কেউ বাংলা ভাষাভাষী, কেউ ইংরেজী ভাষাভাষী, এভাবে অন্য ভাষাভাষীরাও আছে। কিন্তু চলচ্চিত্রের ভাষা সর্বজনীন। সব ভাষার চলচ্চিত্রকে একইভাবে ক্যামেরা, আলো, শব্দ ও সম্পাদনা নিয়ে কাজ করতে হয়। তাই চলচ্চিত্রের ভাষায় ধারার ভিন্নতা বলে কোন কথা না থাকলেও আমাদের দেশে তেমন একটি ব্যাপার দাঁড়িয়ে গেছে। সেই দিক থেকে আইসক্রিম সিনেমাটি কোন ধারার এই বিবেচনা যারা চলচ্চিত্রের মধ্যে ধারার ব্যবধান রাখতে ব্যতিব্যস্ত তাদের হাতে ছেড়ে দিয়ে আসল কথায় আসা যাক।
আগেই বলা হয়েছে চলচ্চিত্রে ক্যামেরা, আলো, শব্দ, সম্পাদনা প্রভৃতি নিয়ে কাজ করা হয়। এই কাজগুলো করতে হয় একটা গল্পের ওপর। বাংলা সিনেমার উৎকর্ষতা সাধনের জন্য প্রথম ধাপ হিসেবে ভাল গল্প দরকার। একটি ভাল সিনেমার প্রথম শর্ত একটি ভাল গল্প, যদি সেটা মৌলিক হয় তাহলে তো কথাই নেই। আইসক্রিম সিনেমায় কি দর্শক তেমন কোন গল্প পেয়েছে? আমার মনে হয় পেয়েছে। রেদোয়ান রনি আসলে আমাদের বর্তমান শহুরে জীবনে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা অসাধারণভাবে তুলে ধরেছেন। গল্পটা আমাদের শহুরে উঠতি তরুণ-তরুণীদের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা। এই গল্পটা চলচ্চিত্রে নাফিজা, উদয় ও রাজের না বরং আমাদের অধিকাংশের গল্প। বিশ্বায়ন পরবর্তী সমাজে যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে আমাদের সম্পর্কগুলোর ধরন বদলে যাচ্ছে। সম্পর্কের গাড়ত্বের জায়গা দখল করে নিচ্ছে সম্পর্কের ব্যাপ্তি। কাছের মানুষ দূরে সরে যাচ্ছে, দূরের মানুষ কাছে। সম্পর্কের গভীরতার জায়গা দখল করে
নিয়েছে সম্পর্কের তারল্য। এই সিনেমাতে সম্পর্কের দ্বন্দ্ব এবং সম্পর্কের ক্ষেত্রে অঙ্গীকারের প্রয়োজনীয়তাটা তুলে ধরা হয়েছে। এবার দেখা যাক গল্প বলার ধরনটা। গল্পটা বলা শুরু“ হয়েছে প্রতীকীভাবে একটা মাটির টবে চারা গাছ রোপণের মাধ্যমে যেটা দ্বারা উদয়-তুষির সম্পর্কের গোঁড়াপত্তন বোঝানো হয়েছে। তারপর আলো, বাতাস, পানি দিলে গাছটি বড় হয়। যার দ্বারা সম্পর্কের যতœ নেয়ার প্রয়োজনীয়তা বুঝানো হয়েছে। ফলস্বরূপ উদয় আর তুষির সম্পর্ক পরিণতির দিকে এগোয়। একটা সময় দেখা যায় বেখেয়ালবশত সম্পর্কে সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে যা আগাছার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। একটা সময় পুরো গাছটাকে আগাছা ঘিরে ফেললে গাছ দেখা যায় না। দেখা যায় শুধু আগাছা। এভাবেই দেখা যায় তিল তিল করে গড়ে ওঠা কোন সম্পর্ক যতেœর অভাবে বা বিশ্বাসের অভাবে সন্দেহের চোরাবালিতে হারিয়ে যায়। তাই বলা যায় সিনেমাটিতে প্রতীকীভাবে সম্পর্ক কাঠামোর বয়ান একটি কাব্যিক রূপ। তেমনি আরও ছোট ছোট কাব্যিক রূপ দেখা যায়। যেমন- শাওয়ারের নিচে বসে উদয়ের কান্না যেখানে শাওয়ারের পানি আর উদয়ের চোখের পানি একাকার, পার্থক্য করা যায় না।
ক্যামেরার কাজ বলতে গেলে এক কথায় ভাল ছিল। সেন্টমার্টিনে দৃশ্য ধারণ, নীলাভ সমুদ্র, সেখানে সূর্যাস্ত, সূর্যোদয় সবই ছিল দেখার মতো। লঞ্চ ভ্রমণ, শহরের দৃশ্য ধারণ সব মিলিয়ে ভাল।
ক্যামেরার প্রতিটি ফ্রেম বাই ফ্রেম না ধরে বললেও আলাদা কিছু শর্ট ছিল যা বলতেই হয়। বিশেষ করে নৌকার ওপর বসে উদয় আর তুষির ঝুলন্ত পাগুলো এঙ্গেল থেকে ধারণ, গাড়ির ভিতরে তাদের অন্তরঙ্গ দৃশ্যের প্রতীকী উপস্থাপন আলাদাভাবে বলা যায়।
অভিনয়ে উদয়, নাফিজা তুষি ও রাজ তিনজন নবাগত। তবে ক্যামেরার সামনে দেখে দর্শকের কাছে ঠিক তেমনটা মনে হবে না। তিনজনই মোটামুটি ভাল করলেও রাজ তার জায়গাতে একটু বেশি সাবলীল ছিল।
গল্পের ক্ষেত্রে আপত্তি না থাকলেও গল্পের গাঁথুনির ক্ষেত্রে কিছু দুর্বলতা আছে বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। খুব সিরিয়াস একটা গল্প বিনোদনমূলকভাবে উপস্থাপন করায় বা শেষের দিকে রাজের বাসায় তুষির যাওয়া নিয়ে দুটি গল্প সাজিয়ে দর্শকের মস্তিষ্কে ঝড় তোলায় হয়তো সেটা তেমন চোখে পড়েনি। কিন্তু তুষির দুইবার ধরা খাওয়ার প্রক্রিয়াটা নিয়ে গল্পে আরও ভাবা যেত, বিশেষ করে শেষবার ওমর সানির বয়ানে তুষির রাজের ফ্ল্যাটে যাওয়ার কাহিনী আমার কাছে দায়সারা মনে হয়েছে। পার্শ্ব চরিত্রগুলো দুর্বল ছিল। ঐ চরিত্রগুলো আর শক্তিশালী ও কার্যকরী করে উপস্থাপন করা যেত। দুই একজন আবহ সঙ্গীতের ক্ষেত্রে কিছুটা দুর্বলতার কথা প্রকাশ করেছে।
সর্বোপরি, এই সিনেমাটির প্রথম নাম ছিল ‘মরিচীকা’। পরবর্তীতে ‘আইসক্রিম’ নামে মুক্তি দেয়া হয়। এই দুটা নামের একটা ও আমার কাছে মানানসই মনে হয়নি। আমার মতে সিনেমার নামকরণ আরও ভাবা যেত। তবে যাই হোক রেদোয়ান রনির ‘আইসক্রিম’ গলে যায়নি। পরিচালক তার জায়গা থেকে সফলই বলা যায়।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: