ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসির সিয়াম

ক্যাম্পাস লাইফে ইফতার

প্রকাশিত: ০৯:০২, ১২ মে ২০১৯

ক্যাম্পাস লাইফে ইফতার

রমজান মাসের সবচাইতে প্রত্যাশিত যে মুহূর্তটি, সেটি হলো ইফতারের সময়। সারাদিন না খেয়ে থেকে প্রতিটা রোজাদার ব্যক্তিই এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করে। কখন আসবে সেই ইফতারের সময়! মায়েরা রান্নাঘরে ব্যস্ত থাকেন পায়েস, শেমাই, বিরিয়ানিসহ বিভিন্ন মজার মজার খাবার তৈরির কাজে। বাবা বাইরে থেকে ফেরার সময় হাতে করে কিনে নিয়ে আসেন জিলাপি, বেগুনী, পিঁয়াজু, চপসহ অন্যান্য টুকিটাকি খাবার দাবারগুলো। ছোট ছেলেমেয়েরা ডাইনিং টেবিলের ওপর সেসব খাবার দিয়ে এক এক করে প্লেট সাজাতে শুরু করে। প্রতিবেশীরা নিজেদের তৈরি করা বিভিন্ন খাবার একে অপরের বাড়িতে আদান-প্রদান করেন। ধীরে ধীরে ঘনিয়ে আসে ইফতারের সময়। পরিবারের সকলে একসঙ্গে হরেক রকমের খাবার নিজেদের সামনে সাজিয়ে নিয়ে বসে অপেক্ষা করে মাগরিবের আজানের জন্য। এরপর একটা সময় এসে মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ভেসে আসে মাগরিবের আজান। আর সকলে মিলে সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা আদায় করলে পানি বা শরবত পান করার মাধ্যমে নিজেদের রোজা ভাঙে। ঠিক যেন একটা উৎসবের আমেজ। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস লাইফের ইফতারটা পারিবারিক ইফতারগুলোর চাইতে কিছুটা ভিন্নধর্মী। প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়েই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা এসে ভর্তি হয়। আবাসিক হলে থেকে বা ক্যাম্পাসের আশপাশে বাসা ভাড়া নিয়ে পড়ালেখা করে তারা। নিজের ডিপার্টমেন্ট, অন্যান্য ডিপার্টমেন্টসহ হলে একইসঙ্গে বসবাস করা বন্ধু, সিনিয়র, জুনিয়র সকলে মিলেমিশে কাটাতে শুরু করে ক্যাম্পাস লাইফ। একই সঙ্গে ক্লাসে যাওয়া, খাওয়া দাওয়া করা, পড়ালেখা করা, আড্ডা দেয়া, খেলাধুলা করাসহ নানান কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে সকলের মাঝে এক ধরনের বিশেষ সখ্যের সম্পর্ক গড়ে ওঠে ফলশ্রুতিতে এরাই একটা সময় এসে নতুন আরেকটি পরিবার হিসেবে মনের মাঝে বিশেষ ভাবে জায়গা করে নেয়। আর তাই রমজান মাসের ইফতারের সময়ও এদেরকে একই সঙ্গে বিভিন্নভাবে আয়োজন করে ইফতার করতে দেখা যায়। সারাদিন যে যার কাজে ব্যস্ত থাকতেই পারে। কেউ বা ক্লাস করে, কেউ টিউশন বা অন্য কোন কাজে ব্যস্ত থাকে। দিনশেষে ইফতারের সময়টা ঘনিয়ে আসতে আসতে দেখা যায় সার্কেলের সবাই এসে জড়ো হয়েছে একসঙ্গে ইফতার করার জন্য। ক্যাম্পাস লাইফের ইফতারের আয়োজনগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সমন্বয়ে হতে দেখা যায়। তবে অনেক সময় সিনিয়র, জুনিয়রসহ বিভিন্ন পরিচিত জনদের নিয়েও ইফতার করা হয়। অন্য ধর্মের বন্ধু বা ভাইয়েরাও যুক্ত হয় ইফতারের সময়। এখানে ধর্মীয় দিকটা যতটা গুরুত্ব বহন করে, তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করে ভালবাসা এবং ভাতৃত্ববোধও। দেখা যায়, একই সার্কেলের হওয়ায় প্রতিদিনই তারা একসঙ্গে ইফতার করতে বসেছে। হোক সে অন্য যেকোন ধর্মের। সব সময়ের মতো একই সঙ্গে ভাগাভাগি করে খাবার খাওয়াটাই তাদের জন্য আনন্দের। ক্যাম্পাস লাইফের শিক্ষার্থীদের ইফতারগুলো পারিবারিক ইফতারগুলোর মতো অতটা জাঁকজমকপূর্ণ হয় না। তবে বেশ প্রাণবন্ত ও স্বতঃস্ফূর্ত হয়। বেশ কিছু আলাদা আলাদা ধরনের ইফতারের আয়োজন হতে দেখা যায় ক্যাম্পাস জুড়ে। চার পাঁচজন বা তারও বেশি জন মিলে একসঙ্গে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় ইফতারের আয়োজন করে থাকে তারা। ইফতারের সময়টায় দেখা যায় কোন এক খোলা মাঠের মাঝখানে গোল হয়ে বসে আছে কয়েকজন শিক্ষার্থী। ছোলা, মুড়ি, বুন্দিয়া, বেগুনী, জিলাপি, পিঁয়াজু, চপ প্রভৃতি খাবার-দাবার দোকান থেকে কিনে এনে মাঝখানে পেপার বিছিয়ে বা বড় কোন পাত্রে সবগুলো একত্রে মাখাচ্ছে। কিংবা ক্যাম্পাসেরই কোন এক দোকানে বসে কয়েকজন মিলে মুড়ি মাখিয়ে বেশ আড্ডার আমেজে ইফতার করছে। সচরাচর এমন চিত্রই ইফতারের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায় ক্যাম্পাস লাইফের শিক্ষার্থীদের। তবে ছোট খাটো ভিন্নতাও থাকে। হলের ডাইনিং বা ক্যান্টিন থেকেও ইফতার করে অনেক শিক্ষার্থী। রমজানের সময়টায় হলের ডাইনিং বা ক্যান্টিনগুলোতে ইফতারের বিশেষ প্যাকেজ দেয়া হয়। অন্যদিকে, হলে থাকা কিছু ছেলে থাকে যারা বেশ ভালো রান্নাও করতে পারে। বন্ধু মহলে তাদের কদর একটু অন্য মাত্রায় থাকে। বিশেষ করে রমজান মাসে। যারা একসঙ্গে ইফতার করে তারা চাঁদা তুলে বাজার করে নিয়ে আসে। রান্নায় পারদর্শী বন্ধুটি সেগুলো দিয়ে রান্না করে তার জানামতো খাবারের আইটেমগুলো। যেমন- খিঁচুড়ি, বিরিয়ানি, নুডলস, বিভিন্ন ধরনের পিঠা ইত্যাদি। মানে এদের ইফতারের আয়োজনটা একটু ঘরোয়া ধরনেরই হয়। ক্যাম্পাসে পরিবার ছাড়া থাকলেও, পারিবারিক বা ঘরোয়া ইফতারের স্বাদটা এই শ্রেণীর রন্ধন শিল্পে কৃতী বন্ধুদের জন্যই উপভোগ করা যায়। যার জন্যই রান্না জানা বন্ধুদের কদর ক্যাম্পাসে লাইফে একটু বেশিই। মেয়েদের হলগুলোতে প্রায় সকলেই ব্যক্তিগতভাবে রান্না করে খায়। রমজান মাসে ইফতারের সময়ও স্বাভাবিক ভাবেই তারা নিজেদের ইফতারের খাবার দাবারগুলো নিজেরাই তৈরি করে থাকে। এর বাইরে অনেক সময় মেয়েদেরও দেখা যায় ছেলেদের মতই দলবেঁধে একই সঙ্গে কোন এক আড্ডাঘন জায়গা বা দোকানে বসে ইফতার করছে। ক্যাম্পাস লাইফের সবচাইতে বেশি আলোচনায় থাকতে দেখা যায় ছেলে মেয়ের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা গ্রুপ বা সার্কেলগুলোকে। এই সার্কেলগুলো অন্যান্য সার্কেলগুলোর থেকে একটু আলাদা হয়। সবচাইতে বেশি যে ভিন্নতা দেখা যায় এই সার্কেলগুলোতে সেটি হলো ছেলেমেয়ের উভয় বন্ধুদের মাঝে কেয়ারিং- শেয়ারিং মনোভাব। এই সার্কেলগুলোতে সবসময়ই কিছু আলাদা দৃশ্য দেখা যায়, যেগুলো অন্যান্য সার্কেল অর্থাৎ শুধু ছেলে কিংবা মেয়েদের নিয়ে গড়ে ওঠা সার্কেলগুলোতে সেভাবে লক্ষ্য করা যায় না। যেমন- কোথাও বেড়াতে গিয়ে বা আড্ডা দিতে গিয়ে দেরী হয়ে গেলে মেয়ে বন্ধুকে হল পর্যন্ত ছেলে বন্ধুটির পৌঁছে দিয়ে আসা। আবার পড়ালেখার ক্ষেত্রে ছেলেরা একটু অসচেতন বা উড়নচণ্ডী টাইপের হয় বিধায় পরীক্ষার সময় মেয়ে বন্ধুটি বেশ যত্ন করে পড়া বুঝিয়ে দেয় বা নোট করে দেয় তার ছেলে বন্ধুকে। এরকম ছেলে মেয়ে উভয়ের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা সার্কেলগুলো কেয়ারিং-শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে খুব সুন্দরভাবে চালিত হয়। একইভাবে কেয়ারিং-শেয়ারিং ব্যাপারটা রমজান মাসের ইফতারের সময়ও লক্ষ্য করা যায় এদের ক্ষেত্রে। প্রায়ই দেখা যায় সবাই মিলে একসঙ্গে কোথাও বসে ইফতার করছে তারা। মেয়েরা হল থেকে নিজেদের হাতে রান্না করে নিয়ে এসেছে কিছু খাবারের আইটেম যেমন- সেমাই, পায়েস, নুডলস, বিরিয়ানি প্রভৃতি। অন্যদিকে ছেলেরা দোকান থেকে জিলাপি, পিঁয়াজুর মতো জিনিসগুলো কিনে নিয়ে এসেছে। এরপর একসঙ্গে ইফতার করতে বসেছে তারা। এই সার্কেলগুলোর ইফতারের আয়োজন তুলনামূলক নিজেদের সার্কেলের মতই ভিন্নধর্মী হয়। একই সঙ্গে ঘরোয়া পরিবেশ এবং দোকান থেকে কেনা খাবারের স্বাদ মেলে এইসব ইফতার আয়োজনে। এর বাইরেও ক্যাম্পাস লাইফে শিক্ষার্থীদের বেশ কিছু আনুষ্ঠানিক পর্যায়ের ইফতারের আয়োজনেও অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। প্রতিটা ক্যাম্পাসেই বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক এ্যাসোসিয়েশন, ক্লাব, অর্গানাইজেশনসহ বিভিন্ন সংগঠন রয়েছে। প্রতিটা শিক্ষার্থীই অবধারিত ভাবেই কোন না কোন ক্লাব বা অর্গানাইজেশন কিংবা এলাকাভিত্তিক এ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হয়ে থাকে। সেইসব সংগঠন থেকেও নির্দিষ্ট দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে বেশ আয়োজনের সঙ্গে ইফতারের ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া প্রতিটা ডিপার্টমেন্ট থেকেও আয়োজন করা হয় ইফতারের। সেখানেও ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র, জুনিয়র, বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষকম-লীদের প্রাণবন্ত উপস্থিতির মধ্য দিয়ে ইফতার কার্য সম্পন্ন হয়ে থাকে। কারণ, ইফতারের পাশাপাশি ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক আয়োজিত ইফতার পার্টি বা মাহফিলগুলো সকলের জন্য একটা মিলনমেলার জায়গাও হয়ে থাকে। এখানে বর্তমান শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি প্রাক্তন শিক্ষার্থীদেরও নিজ নিজ কর্মস্থল থেকে এসে উপস্থিত হতে দেখা যায়। এছাড়াও ক্যাম্পাসভিত্তিক সাহায্য সহযোগিতামূলক সংগঠনগুলোকে প্রায়ই দেখা যায় নিজেদের সঙ্গে সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের নিয়ে ইফতার করতে বসেছে। প্রতিটা শিক্ষার্থীর কাছেই তার ক্যাম্পাস লাইফটা অন্যরকম আবেগ-অনুভূতির। তাই ব্যক্তি জীবনে অর্জিত অসংখ্য টুকরো টুকরো গল্পের মাঝে ক্যাম্পাস লাইফের খন্ড খন্ড গল্পগুলো অন্যান্য গল্পের চাইতে একটু বেশিই রঙিন হয়ে থাকে প্রতিটা মানুষের কাছেই। সেই গল্পগুলোর মাঝে ক্যাম্পাস লাইফে করা ইফতারগুলো আরও বেশি আবেগ পূর্ণ। যার জন্যই কর্মস্থল ফেলে প্রতিবছরই নিজেদের ডিপার্টমেন্ট বা এ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক আয়োজিত ইফতার পার্টি বা মাহফিলে অংশগ্রহণ করার জন্য ছুটে আসতে দেখা যায় প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের। যেন পুরনো বন্ধু-বান্ধব, সিনিয়র, জুনিয়র, শিক্ষকমণ্ডলীসহ বিভিন্ন পরিচিতজনদের দেখে আবারও ক্যাম্পাস লাইফের আয়োজন করা পুরনো ইফতারের গল্পগুলো মনের গহীনে সতেজ হয়ে উঠতে পারে খুব সহজেই।
×