ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

রাহুল শর্মা

অগ্রযাত্রার ১৩ বছর ॥ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ০৭:১৩, ৪ নভেম্বর ২০১৮

অগ্রযাত্রার ১৩ বছর ॥ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্যতার প্রতীক। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে এ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীদের ভূমিকা স্মরণযোগ্য। এই অঞ্চলে শিক্ষার প্রসারে এই বিদ্যাপিঠের শুরুটা হয়েছিল ছোট পরিসরে। ছোটদের বর্ণমালা শেখানোর স্কুল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। কালের ধারাবাহিকতায় এটি স্কুল থেকে এখন বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের উচ্চশিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর ঐতিহ্যবাহী এই বিদ্যাপীঠটি ১৪ বছরে পর্দাপণ করেছে। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে শিশুদের বর্ণমালা শেখানোর লক্ষ্যে জমিদার জগন্নাথ রায় ১৮৬৮ সালে একটি পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৬০ বছরের গৌরবময় ইতিহাস নিয়ে সে সময়কার সোনামণিদের পাঠশালাটি এখন বিশ্ববিদ্যালয়। বলছি বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। ব্রাক্ষ্ম স্কুল হিসেবে রাজধানীর আরমানিটোলায় যার যাত্রা শুরু। ইতিহাস থেকে জানা যায়, নানা সংকটের কারণে স্কুলটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে মানিকগঞ্জের বালিয়াদির জমিদার কিশোরী লাল চৌধুরী ১৮৬৮ সালে স্কুলটি পরিচালনার দায়িত্ব নেন। তখন তিনি স্কুলটিকে বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থানে স্থানান্তর করেন। সেই সঙ্গে তিনি তার পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে স্কুলটির নামকরণ করেন। নাম দেন জগন্নাথ স্কুল। মূলত বাঙালী ছেলে-মেয়েদের শিক্ষিত করে তুলতে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। তাঁর প্রচেষ্টাতেই ১৮৮৪ সালে স্কুলটি কলেজে রূপান্তরিত হয়। সময়ের তৃষ্ণা নিবারণে কলেজটি ২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ে হিসেবে ঘোষিত হয়। নবযাত্রার হলো শুরু আধুনিক জ্ঞানচর্চা ও পঠন-পাঠনের সুযোগ সৃষ্টি ও সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যেÑ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত ২০০৫ সালের ২৮নং আইনের মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ সরকারী কলেজটি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। ২০০৫ এর ২০ অক্টোবর একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০০৬ তারিখে উপাচার্য নিয়োগের মধ্য দিয়ে কার্যক্রম শুরু হয়। বিলুপ্ত সরকারী জগন্নাথ কলেজ ক্যাম্পাসের প্রায় ৭ একর জমির ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাস অবস্থিত। খ্যাতিমানদের আবাসস্থল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে ছিলেন অনেক খ্যাতিমান। তাদের পদভারে গৌরবান্বিত হয়েছে এ বিদ্যাপীঠটি। তাদের মধ্যে ছিলেন শিক্ষক ভবতোষ দত্ত, শওকত ওসমান, অজিত গুহ, শওকত আলী, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আক্তারুজ্জামান ইলিয়াশ, দার্শনিক সাইদুর রহমান, লেখক হাবিবুল বাশার, নাট্যজন মমতাজউদদীন আহমদ, ডক্টর মোহাম্মদ জুনায়েদ প্রমুখ। পড়েছি প্রভাতবাসে জগন্নাথ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে রূপান্তরিত হওয়ার পর উচ্চশিক্ষার গুণগতমান উন্নয়নের লক্ষ্যে অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ একাডেমিক কর্মকা-ে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। ভর্তি প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে ২০০৫-২০০৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে ঈড়সঢ়ঁঃবৎরুবফ ঝুংঃবস-এ ভর্তি কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০০৫ অনুযায়ী সকল বিভাগে সেমিস্টার পদ্ধতিতে পাঠদান কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। সেন্টার ফর ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে ‘ইনস্টিটিউট অব মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজ’ হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ৬টি অনুষদ, ২টি ইনস্টিটিউট, ৩৬টি বিভাগে শিক্ষক রয়েছেন ৬৫০ জন। আর শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। বিশ্ববিদ্যালয়ের তানপুরা জীবনের অবিচ্ছিন্ন গানের সুর তোলা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তানপুরায় আছে রোভার স্কাউট, বিএনসিটি, সায়েন্স ক্লাব, ডিবেটিং ক্লাব, থিয়েটার, বিজ্ঞান ক্লাব, ক্যারিয়ারের সকল নার্সাারির সমারোহ। বর্ণাঢ্য আয়োজন বর্ণাঢ্য আয়োজনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) প্রতিষ্ঠার ১৩ বছর পূর্তি উৎসব উদযাপিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে উৎসবের মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়। বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা একটি শোভাযাত্রা বের করেন। দুপুর ১২টায় নতুন একাডেমিক ভবনের নিচতলায় ‘শিল্প-সৃজনে আলোকিত হই’ স্লোগানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বার্ষিক শিল্পকলা প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া ভাষা শহীদ রফিক ভবনের নিচতলায় দিনব্যাপী ছিল প্রকাশনা প্রদর্শনী। দিনটি উপলক্ষে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ চত্বরে দুপুরে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে সঙ্গীতানুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। এ ছাড়া বিকেলে সামাজিক বিজ্ঞান ভবন চত্বরে কনসার্ট আয়োজন করা হয়। রাজনীতির জ্বলন্ত অগ্নিকু- স্মৃতিসিক্ত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শুধু গৌরবের সৌধ নয়, জাতি ও দেশের দুঃসময়ে প্রতিবাদের তীব্র সুনামি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শুধু জ্ঞানের আলোই ছড়ায়নি, দেশ ও জাতির দুর্দিনে ছড়িয়েছে রাজনীতির জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ড। ’৫২-র ভাষা আন্দোলন,’ ‘হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণআন্দোলন, ‘অধিকার আদায়ের যে কোন আন্দোলন’ ‘’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ‘স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন যার প্রমাণ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত স্বাধীনতার মন্ত্রবীজ ৬ দফা আন্দোলনের ডেঞ্জার রণক্ষেত্র ছিল জগন্নাথের বীরত্বগাধা। জগন্নাথের বহু ছাত্র ঐ সময় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। জানা যায়, ১৯৭১ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে হানাদারদের ক্যাম্প ছিল, যুদ্ধের পর এখানে বেশ কয়েকটি গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়। পাওয়া যায় ট্রাকভর্তি নরকঙ্কালও। জগন্নাথ একটি নিতান্তই বিদ্যাপিঠ নয়, জগন্নাথ বাংলার মুক্তিযুদ্ধের দলিলÑ যার বুকে এখনও দেশ ও জাতির প্রয়োজনে প্রতিবাদের সুনামি উঠে, আগুন জ্বলে রাজনৈতিক এক ভাষায়, বাজে মুক্তির ডাক...
×