
অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ আগামী ২ জুন সোমবার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন। প্রতি অর্থবছরে জুন মাসের কোনো বৃহস্পতিবারকে বাজেট ঘোষণার জন্য বেছে নেওয়া হয়। এবারই তার ব্যতিক্রম হচ্ছে। তবে বাজেট ঘোষণার পরদিন রেওয়াজ অনুযায়ী অন্য উপদেষ্টাদের সঙ্গে নিয়ে বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলন করবেন অর্থ উপদেষ্টা। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্র্বর্তী সরকারের এটি হবে প্রথম বাজেট। এবার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য অন্তর্র্বর্তী সরকারের দেয়া বাজেটের আকার হতে পারে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। রাজনৈতিক সরকারের অর্থমন্ত্রীরা বাজেট উপস্থাপন করে থাকেন জাতীয় সংসদে। সংসদ না থাকায় অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বাজেট উপস্থাপন করবেন টেলিভিশনের পর্দায়। রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে এ বাজেট ঘোষণা করা হবে। সর্বশেষ ২০০৭-০৮ সালে টেলিভিশনে ভাষণের মাধ্যমে দুটি বাজেট ঘোষণা করেছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রথম অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট করতে যাচ্ছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বর্তী সরকার। এ ছাড়া এবারের বাজেটে নজর থাকবে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, জ্বালানি সাশ্রয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দক্ষতা উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে বাজেটে। এ ক্ষেত্রে সকলের চাওয়া মানুষের জীবনযাত্রা যেন সহজ হয়। এত কিছু কীভাবে করা সম্ভব হবে? একজন অর্থনীতি বিশ্লেষক হিসেবে আমার মনে প্রশ্ন জাগছে। রাজস্ব তো পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে আমরা আশাবাদী, আগামী অর্থবছরে রাজস্ব বাড়বে। সরকার ইতোমধ্যেই এনবিআরকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে দুটি পৃথক বিভাগ সৃষ্টির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাদের সবার প্রত্যাশা, মানুষের ওপর অহেতুক করের বোঝা বাড়াবে না সরকার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) আগামী অর্থবছরে ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হতে পারে, যা চলতি বাজেটে ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এরই মধ্যে চলতি অর্থবছরের লক্ষ্য কমিয়ে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছে।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) রাজস্ব আদায় হয়েছে ২ লাখ ২১ হাজার ৮১৭ টাকা, কিন্তু আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব-ঘাটতি ৫৮ হাজার কোটি টাকা, অর্থাৎ ২১ শতাংশ। যেখানে রাজস্ব আয় চার লাখ কোটি টাকা করতেই ঘাম ছুটে যায়। সে বিবেচনায় আগামী বাজেটও হবে উচ্চাভিলাষী। এতে ঘাটতি হবে বড়। এটা কোনোভাবেই ছোট বাজেট হবে না, মূল্যস্ফীতি কমার বাজেটও হবে না, এমনকি বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ভালো হওয়ার বাজেটও হবে না। সাত হাজার কোটি টাকা কমানোর কথা বলা মানে হচ্ছে, কল্পনার সঙ্গে কল্পনার তুলনা করা। অনেকটা এ রকম-আগের সরকার চাঁদে যাওয়ার কথা বলেছিল, এখন বলা হবে মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার কথা।
আগের সরকার যে বাজেট ঘোষণা করতো, তার অনেকটাই অবাস্তবায়িত থাকত। শেষ পর্যন্ত বাজেটে ঘোষিত বিষয়গুলো অসার বলে প্রমাণ হতো। স্রেফ জনগণের সাথে ভাঁওতাবাজি করতে স্বৈরাচারী স্বেচ্ছাচারী সরকার নিজেদের কৃতিত্ব ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রকাশ করতেই এক ধরনের স্ট্যান্টবাজি করতো। আমরা বিগত স্বৈরাচারী সরকারের আমলের দেয়া বাজেটগুলোতে এটি বারবার লক্ষ্য করেছি। তারা ক্ষমতার মঞ্চ থেকে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে তাদের কৃতকর্মের কারণে। এখনো যদি আগের মতো অবাস্তব, কাল্পনিক, সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিতে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বাজেট প্রকাশ করা হয়, তাহলে সেটা হবে চরম দুঃখজনক।
এখন সরকারের প্রধান নির্বাহী হিসেবে রয়েছেন একজন বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ। যিনি একাধারে মেধাবী, অসাধারণ উদ্ভাবনী ক্ষমতার অধিকারী। সাধারণ, দরিদ্র মানুষের জন্য তিনি জীবনের প্রায় পুরোটা সময়ই ব্যয় করেছেন। এজন্য প্রবর্তিত গ্রামীণ ব্যাংকের উদ্ভাবক হিসেবে নোবেল পুরস্কারও লাভ করেছেন। তেমন একজন অর্থনীতিবিদের নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ে দেয়া বাজেট যথাসম্ভব বাস্তবসম্মত, জনকল্যাণকর, দারিদ্র্যবান্ধব, সাধারণ মানুষের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম চাপ সৃষ্টিকারী একটি চমৎকার সুন্দর বাজেট হিসেবে পরিগণিত হবে, দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। এটাও আশা করি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা এবং শ্বেতপত্র কমিটি ও টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনের সুপারিশের প্রতিফলন থাকবে বাজেটে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরকে দুইভাবে বিভক্ত করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। সংস্থাটি ভেঙে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে দুটি বিভাগ সৃষ্টি করা হয়েছে। অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, রাজস্ব নীতি বিভাগ কর আইন প্রয়োগ ও কর আদায় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে। রাজস্ব সংগ্রহের মূল কাজ করবে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ। বাজেট ঘাটতি মেটাতে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে কম ঋণ নেবে সরকার। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকারের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল প্রায় ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এ লক্ষ্যমাত্রা মোট বাজেটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। আগামী অর্থবছরেও তা-ই থাকছে।
বাজেট-ঘাটতি পূরণে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকার দুইভাবে ঋণ নেয়। একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক, অন্যটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমে যায় ব্যাংকগুলোর। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতি বাড়ে। তাতে ভোগান্তি বাড়ে সাধারণ মানুষের। এটি অর্থনীতিরই সূত্র। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত এপ্রিলে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য ব্যাংকঋণ অন্যতম কারণ হলেও সরকারের হাতে তেমন বিকল্প নেই। তবে আশার কথা হচ্ছে, লক্ষ্যমাত্রার পুরোটা সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে নেয় নি। চলতি অর্থবছরে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৯৯ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের আট মাসে সরকার ব্যাংক খাত থেকে লক্ষ্যমাত্রার ১৭ শতাংশ ঋণ নিয়েছে। ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকার বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আবার ব্যাংকঋণের সুদ বাবদও বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়, যা মূলত রাজস্ব সংগ্রহের অর্থ। আগামী অর্থবছরে এসব বিষয়ে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। আগামী অর্থবছরের বাজেট যদি ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে রাখা হয় তাহলে মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় তা যথেষ্টই ছোট হচ্ছে। আমাদের মূল নজর দিতে হবে রাজস্ব সংগ্রহে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে ১ নম্বর অগ্রাধিকারে রেখে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট সাজাচ্ছে সরকার। বাজেটে সুযোগ তৈরি করা হবে গ্রামীণ পর্যায়ে কর্মসংস্থানের। এজন্য উজ্জীবিত করা হবে রাস্তাঘাট নির্মাণ, সংস্কারসহ গ্রামীণ অবকাঠামো খাতের কর্মযজ্ঞকে। তবে বড় তেমন কোনো প্রকল্প নেওয়া হবে না। করা হবে না ঢাউস আকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিও (এডিপি)। বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতায় ভাতা কিছুটা বাড়ানো হবে। এমনকি বাড়ানো হবে ভাতাভোগীর সংখ্যা। সবই করা হবে সীমিত সাধ্যের মধ্য থেকে। রাজস্ব সংগ্রহের বড় কোনো উৎসের সন্ধান না পাওয়ায় আগামী বাজেট তেমন বড় করা হচ্ছে না। এ কারণেই চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় আগামী অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার কমানো হচ্ছে অন্তত সাত হাজার কোটি টাকা। অহেতুক উচ্চাভিলাষী নয়; বরং একটি বাস্তবভিত্তিক বাজেটের দিকেই এগোচ্ছে অন্তর্র্বতী সরকার। দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে, যা ৯ থেকে ১০ শতাংশের ঘরে থাকছে। নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা থাকবে। সরকার প্রথমে আগামী অর্থবছর শেষে এ হার ৭ শতাংশে নামিয়ে আনবে বলে ঠিক করেছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়ায় এ হার আরও কমবে বলে সরকার আত্মবিশ্বাসী।
চলতি অর্থবছরের মতো আগামী অর্থবছরেও বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের নিচে রাখা হবে। আগামী অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হারের লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য কিছুটা কমিয়ে ইতোমধ্যে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। যদিও বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলছে, চলতি অর্থবছরের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের নিচে থাকবে। এডিপিতে বরাদ্দ রাখা হবে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো। বরাদ্দের দিক থেকে আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। আগামী বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় বাজেট-ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা বেশ কমানো হয়েছে। এ ধরনের উদ্যোগ আমাদের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির সহায়ক। এটা সরাসরি মূল্যস্ফীতি কমাতে সহায়ক হবে।
সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা, নতুন বাজেট অগ্নিমূল্যের বাজার থেকে স্বস্তি দেবে। মধ্যবিত্তের আশা, টিসিবির ট্রাকের পেছনে মুখ লুকিয়ে আর দাঁড়াতে হবে না। বেসরকারি খাতের প্রত্যাশা, ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় কমবে, বিনিয়োগ বাড়বে। প্রশ্ন হচ্ছে, সবার আশা কি পূরণ করতে পারবে এই বাজেট? স্বৈরাচারী সরকারের শাসনামলে মানুষ অনেক কষ্ট করেছে। তাই আশার আলোর সন্ধানে সবাই। কিন্তু টানেলের শেষে কি আশার আলো দেখা যাচ্ছে?
প্যানেল