ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

কেন বাড়লো মুরগির দাম?

কাজী জাহিন হাসান

প্রকাশিত: ১৮:২৬, ১০ মে ২০২৩; আপডেট: ১৮:৪৫, ১০ মে ২০২৩

কেন বাড়লো মুরগির দাম?

পোল্ট্রি

সম্প্রতি, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর অভিযোগ করে, পোল্ট্রি সংস্থাগুলো অস্বাভাবিকভাবে ব্রয়লার মুরগির দাম বেশি নির্ধারণ করেছে। কয়েক সপ্তাহ পর একই অধিদপ্তর অভিযোগ করে, কোম্পানিগুলো মুরগির দাম অস্বাভাবিকভাবে কম নির্ধারণ করেছে। দুটি অভিযোগই ভিত্তিহীন। কারণ, চাহিদা ও সরবরাহের ভিন্নতার কারণে মুরগির দাম বাড়ে বা কমে।

যে মুরগি আজ বিক্রি হচ্ছে, একমাস আগে তা হ্যাচারিতে বিক্রি হয়েছে বাচ্চা অবস্থায়। হ্যাচারীতে ডিম ফুটানোর জন্য ইনকিউবেটর মেশিনে রাখতে হয় তিন সপ্তাহ। আর হ্যাচারিতে পাঠানোর জন্য এই ডিম উৎপাদন করতে মুরগি পালতে হয় ছয় মাস আগে থেকে। অর্থাৎ, ব্রয়লার মুরগি উৎপাদনের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয় প্রায় আট মাস আগে। যেহেতু উৎপাদন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আট মাস সময় লাগে এবং এই সময়ে চাহিদা ওঠানামা করে, তাই প্রায়ই সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে মিল থাকে না। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

কোনো এক সপ্তাহে, সরবরাহের চেয়ে চাহিদা বেশি হলে বাজার মূল্য বেশি হতে পারে। আবার আরেক সপ্তাহে, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি হলে দাম কম হতে পারে। প্রতিদিন হাজার হাজার খামারি মুরগি বিক্রি করে। এমন প্রতিযোগিতামূলক বাজারে কোনো নির্দিষ্ট বিক্রেতা ইচ্ছামত দাম নির্ধারণ করতে পারে না।

পোল্ট্রি শিল্পকে সবসময়ই আট মাস পরের চাহিদা অনুমান করে তা পূরণের প্রস্তুতি নিতে হয় এবং কেউই শতভাগ সঠিক ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতে পারে না। এ কারণেই গতবছর পুরোটা সময়ই মুরগির দাম কখনো বেড়েছে, আবার কখনো কমেছে।

মুরগির দাম মূলত বাড়তে শুরু করে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার  পর। যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ায় ভুট্টা ও সয়াবিনের দাম বাড়তে শুরু করে। যেহেতু পোল্ট্রি ফিডের বেশিরভাগই ভুট্টা ও সয়াবিন থেকে তৈরি হয়, তাই পোল্ট্রি খাবারের খরচ ২০২২ সালের মে, জুন ও জুলাই মাসে বাড়তে শুরু করে। ওই সময়ে অনেক পোল্ট্রি খামারি বড় ধরণের ক্ষতির মুখে পড়েন এবং অনেকে তাদের খামার বন্ধ রাখতে বাধ্য হন।

ব্রয়লার মুরগির অনেক খামার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মুরগির সরবরাহ কমে যায় এবং ব্রয়লারের বাজার মূল্য বেড়ে যায়। এ কারণেই ২০২২ সালের আগস্ট, সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবরে ব্রয়লারের দাম বেড়েছে।

অনেকেরই স্মরণ আছে, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো পূর্বাভাস দিয়েছিল শীতকালের মধ্যেই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শেষ হয়ে যেতে পারে। বিশ্বে শান্তি ফিরবে, পাশাপাশি পোল্ট্রি খাদ্যের দাম কমবে এমন আশায়, পোল্ট্রি কোম্পানিগুলো ২০২২ এর ডিসেম্বর এবং ২০২৩ এর জানুয়ারিকে লক্ষ্য রেখে বেশি করে ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা উৎপাদনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

বাস্তবতা হলো, যুদ্ধ শেষ হয়নি এবং পোল্ট্রি খাদ্যের দামও কমেনি। কিন্তু পোল্ট্রি কোম্পানিগুলোর পূর্ব পরিকল্পনার ফলে ২০২২ সনের নভেম্বর ও ডিসেম্বর এবং ২০২৩ এর জানুয়ারিতে উৎপাদন ও সরবরাহ বেড়ে যায়। তবে চাহিদা কম থাকায় উৎপাদন খরচের চেয়ে কম মূল্যে মুরগি বিক্রি করতে হয়। ফলে পোল্ট্রি শিল্প বড় ধরণের ক্ষতির মুখে পড়ে।

লোকসানের কারণে স্বাভাবিকভাবেই আবারো অনেক ব্রয়লার খামার বন্ধ হয়ে যায়। যার জন্য ২০২৩ এর ফেব্রুয়ারিতে মুরগি সরবরাহ ঘাটতি দেখা দেয়। এতে ব্রয়লারের দাম আবার বেড়ে যায়।

গত ২৩ মার্চ জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে রমজান মাসে খামার থেকে কত দামে মুরগি বিক্রি করা যাবে তা নির্ধারণ করার জন্য বড় পোল্ট্রি কোম্পানিগুলোকে সরকারের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়। সভায় উপস্থিত পোল্ট্রি কোম্পানিগুলো তাদের খামার থেকে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি সর্বোচ্চ ১৯৫ টাকায় বিক্রি করতে সম্মত হয়।

আমাদের কোম্পানি, কাজী ফার্মস, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সভায় গৃহিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৪ মার্চ থেকে সর্বোচ্চ ১৯৫ টাকা কেজিতে মুরগি বিক্রি শুরু করে, যা এখন পর্যন্ত বহাল আছে।

গত ২৫ মার্চ থেকে ব্রয়লারের চাহিদা কমতে শুরু করে এবং বাজার মূল্য ভোক্তা অধিকারের সভায় গৃহিত সর্বোচ্চ মূল্যের নিচে নেমে যায়। ফলে ঐ সর্বসম্মত সর্বোচ্চ মূল্য অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। ২৬ মার্চ কিছু জেলায় কাজী ফার্মসের কন্ট্রাক্ট খামারে ব্রয়লার বিক্রি হয়েছে ১৭০ থেকে ১৭৫ টাকা কেজিতে।

২৭ মার্চ চাহিদা আরও কমে যায় এবং অনেক জেলায় কাজী ফার্মসের কন্ট্রাক্ট খামারে ব্রয়লার বিক্রি হয় প্রতি কেজি ১৪৫ থেকে ১৬০ টাকায়। হঠাৎ করে দাম কমে যাওয়ার কারণ খুবই সহজ,  চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি থাকা।

ব্রয়লার মুরগির চাহিদা কমে যাওয়ার কারণ কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। কারণ, ভোক্তাদের চাহিদার বিষয়ে কোনো জরিপ বা গবেষণা নেই। কেউ কেউ অনুমান করে বলছেন, রমজানে ভোক্তারা ব্রয়লার মুরগি কেনার জন্য কম খরচ করেন এবং ঐতিহ্যবাহী অন্যান্য খাবারের পেছনে বেশি ব্যয় করেন।

ঈদের ঠিক আগে ব্রয়লার মুরগির দাম আবার বেড়ে যায় কারন যে কোনো উৎসব, বিশেষ করে ঈদের সময়, প্রায় সব শ্রেণির মানুষ একসাথে অন্যান্য মাংসের তুলনায় সস্তা দামে ব্রয়লার মুরগি কিনেন। ফলে ব্রয়লার মুরগির চাহিদা ও দাম দুটোই বেড়ে যায়।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর অভিযোগ করেছে, পোল্ট্রি কোম্পানিগুলো কম দামে মুরগি বিক্রি করে বাজারমূল্য প্রভাবিত করেছে। ফলে ছোট খামারিরা লোকসানে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। এই অভিযোগ ভিত্তিহীন।

সারা দেশে অনেক ছোট খামারি কাজী ফার্মসের বাচ্চা ও খাদ্য ক্রয় করে বলেই আমাদের পোল্ট্রি হ্যাচারি ও ফিড মিল টিকে আছে। তাই আমরা কখনো উদ্দেশ্যমূলকভাবে ছোট খামারিদের লোকসানে পড়তে বাধ্য করবো না। কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের ব্যবসায়ী তার গ্রাহকদের দেউলিয়া করার চেষ্টা করবে না।

দেশে বিক্রি হওয়া ব্রয়লারের মাত্র ৬ বা ৭ শতাংশ বিক্রি করে কাজী ফার্মস। এরমধ্যে কাজী ফার্মসের সব কন্ট্রাক্ট ফার্মের মুরগিও গণনা করা  হয়েছে। মোট বাজারের এত কম শেয়ার নিয়ে একটি কোম্পানি ব্রয়লারের বাজার মূল্যকে কখনো প্রভাবিত করতে পারে না।

কাজী ফার্মস এর উৎপাদিত ব্রয়লার মুরগি একটি স্বচ্ছ নিলাম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিক্রি হয়। এই নিলামে, মূল্য বিক্রেতা দ্বারা নির্ধারিত হয় না; এটা ক্রেতাগণ তাদের  প্রস্তাবিত মূল্য (বিড) দিয়ে নির্ধারণ করেন।

ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মতো শস্য রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে যুদ্ধ পোল্ট্রি খাদ্যের কাঁচামালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য প্রায় ৩০ শতাংশ কমে গেছে। যে কারণে গত বছরের প্রায় পুরো সময় বেশিরভাগ ব্রয়লার খামারি লোকসান গুনেছেন।

এক্ষেত্রে, পোল্ট্রি শিল্প কোনো অন্যায় করেনি। পোল্ট্রি শিল্প কেবল বাজারের চাহিদা ও সরবরাহ মূল্যের ওঠানামায় সাড়া দিয়েছে মাত্র।

আইন মেনে চলা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে সরকারি যেসব সংস্থা অনিয়মের অভিযোগ তুলছে, পোল্ট্রি বাজার কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে তাদের বিশেষ পুরোপুরি জানা নেই। তাই অভিযোগ তোলার আগে তাদের প্রকৃত তথ্যগুলো জেনে নেওয়া প্রয়োজন।

লেখক: কাজী ফার্মস লিমিটেডের পরিচালক।

×