ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৫ জুন ২০২৫, ২২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

দিল্লির ঐতিহাসিক কুতুব মিনার আজও কেন বন্ধ?

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৩:১৩, ৩ জুন ২০২৫

দিল্লির ঐতিহাসিক কুতুব মিনার আজও কেন বন্ধ?

ছবি: সংগৃহীত

দিল্লির ঐতিহাসিক কুতুব মিনার — দিল্লি সালতানাতের স্থাপত্য ও ইতিহাসের গর্ব। কয়েক দশক ধরে হাজারো পর্যটক প্রতিদিন এই স্মৃতিস্তম্ভে ভিড় জমাত। তবে ১৯৮১ সালের ৪ ডিসেম্বর, এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা কেড়ে নেয় ৪৫টি প্রাণ, আহত হয় আরও ২১ জন। সেই ঘটনাই স্থায়ীভাবে কুতুব মিনারের ভিতরে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেয় সাধারণ দর্শকদের জন্য।

সেদিন কী ঘটেছিল?
সেদিন ছিল শুক্রবার — সাধারণত স্কুল-কলেজের শিক্ষাভ্রমণের দিন, কারণ প্রবেশ ছিল সম্পূর্ণ ফ্রি। সকাল থেকেই কুতুব প্রাঙ্গণে ভিড় বাড়তে থাকে। সকাল ১১টার মধ্যেই একের পর এক বাস এসে থামে, শত শত পর্যটক মিনারে যাওয়ার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন।

মিনারের উপরের অংশে যাওয়া নিষিদ্ধ থাকলেও, প্রথম ব্যালকনি (প্রায় দশতলা সমান উঁচু) পর্যন্ত যাওয়া যেত। সেই দিনও শতাধিক পর্যটক সরু পাকদণ্ডি সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলেন।

প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, আনুমানিক সকাল ১১টা ৩০ মিনিট নাগাদ হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে যায় এবং ভিতরের বাতিগুলো নিভে যায়। সরু, বদ্ধ সিঁড়ি হয়ে পড়ে অন্ধকার ও দমবন্ধ। বাতাস চলাচলের জন্য বড় ভেন্টগুলোও বন্ধ ছিল, ফলে ভিতরে দ্রুত ঘনিয়ে আসে শ্বাসরোধকারী পরিবেশ।

এই সময়েই একজন চিৎকার করে ওঠে, “কুতুব ভেঙে পড়ছে!” মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে ভয়। অতিরিক্ত ভিড়ে আতঙ্কিত লোকজন একসঙ্গে নিচে নামতে শুরু করে। শুরু হয় হুড়োহুড়ি এবং ভয়াবহ পদদলন। যারা ভিতরে ছিলেন, তাদের অনেকে পড়ে যান, কারও শ্বাস রোধ হয়, কেউ পায়ের নিচে চাপা পড়ে যান।

যখন লোকজন বাইরে বেরোতে চায়, তখন দেখা যায় প্রধান দরজাগুলো ভিতরের দিকে খুলে যায়। দরজাগুলো বন্ধ হয়ে গিয়ে আটকে যায়। পাহারাদার (চৌকিদার) ভিড় ঠেকাতে দরজাগুলো বন্ধ করে দেন, কিন্তু পরে তা আর খোলা যাচ্ছিল না। ভিতরে আটকে পড়েন শত শত মানুষ।

তবে কাকতালীয়ভাবে, মিনারের পেছনে সংস্কারের জন্য তৈরি করা একটি বাঁশের মাচা তখন উদ্ধারকাজে ব্যবহৃত হয়। স্থানীয় হকার ও পর্যটন গাইডরা সেই পথ বেয়ে উঠে ভেন্ট দিয়ে ভিতরে ঢুকে বহুজনকে উদ্ধার করেন এবং মৃতদেহ বের করে আনেন।

প্রায় এক ঘণ্টা পর দমকল বাহিনী ও পুলিশ আসে। আহতদের কাছাকাছি হাসপাতালে পাঠানো হয়। ঘটনার সময় কংগ্রেস সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গিয়ানি জেইল সিং সংসদে জানান, এতে ৪৫ জন নিহত ও ২১ জন আহত হয়েছেন।

দিল্লির জেলা ও দায়রা জজ জগদীশ চন্দ্রর নেতৃত্বে তদন্তে দেখা যায়, সিঁড়ির খারাপ অবস্থা, বিদ্যুৎ বিভ্রাট, অতিরিক্ত ভিড় এবং মিথ্যে গুজব ছিল এই বিপর্যয়ের মূল কারণ। 

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনাটি শুরু হয় তখন, যখন একটি কিশোরী ৮ নম্বর ভেন্টিলেটরের কাছে পা পিছলে পড়ে যান। এর পরেই কয়েকজন ছেলে চিৎকার করে বলেন, “মিনার ভেঙে পড়ছে,” আর তাতেই ভিড়ের মধ্যে ভয়ানক আতঙ্ক সৃষ্টি হয়।

এই ঘটনাই প্রথম নয়। এর আগে ১৯৭৮ সালের ১৫ আগস্টও এমন একটি ছোটখাটো পদদলনের ঘটনা ঘটে, যেখানে ১২ জন আহত হয়েছিলেন। সেই সময় থেকেই কুতুব মিনারে জনসমাগম নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু নিয়ম চালু হয় — প্রতিবারে ৩০০ জনের বেশি প্রবেশ না করা, ব্যালকনিতে ৫০ জনের বেশি না রাখা ইত্যাদি। কিন্তু ১৯৮১ সালের ৪ ডিসেম্বর সেই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে।

দিল্লি বিদ্যুৎ দপ্তর প্রথমে বিদ্যুৎ বিভ্রাট অস্বীকার করে। তাদের দাবি, সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে একটি ট্রাক বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে ফেলে, তবে সকাল ১০টা ৫০ মিনিটেই বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে যায়। কিন্তু বিচারপতি চন্দ্রর কমিশন স্পষ্টভাবে বিদ্যুৎ বিভ্রাটকে ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন এবং দিল্লি ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই আন্ডারটেকিং (DESU)-কে দায়ী করেন।

প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ (ASI)-কেও কাঠগড়ায় তোলা হয় সিঁড়ির দুরবস্থা ও অনিয়মের জন্য। সিঁড়িগুলো অসমান ছিল, বহু জায়গায় খাঁজ ছিল, যা অনেকদিন ধরে ঠিক করা হয়নি।

এই ভয়াবহ ঘটনার পরই স্থায়ীভাবে কুতুব মিনারের ভিতরে প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করে দেয় সরকার। আজও কেবল নিচ থেকে দর্শনার্থীরা এই বিস্ময়কর মিনারকে দেখতে পারেন — সেই ভয়াবহতার স্মৃতিচিহ্ন বহন করে চলেছে তার বদ্ধ সিঁড়িপথ।

মুমু

×