
কালের সাক্ষী হিসেবে পলাশ ফুলের একটি গাছ এখনো টিকে আছে উপজেলার ঐতিহ্যবাহী তেওতা জমিদারবাড়ির আঙ্গিনায়
ঋতু পরিক্রমায় শীতকাল এখনো শেষ হয়নি। দিনপঞ্জিতে বসন্ত আসতে আরও ক’দিন বাকি। এরই মধ্যে পলাশ-শিমুলের শাখা ভরে উঠেছে রঙ্গে-রঙ্গিন ফুলে। গাছে-গাছে পাখির কলকাকলি। কোকিলের কুহু-কুহু শব্দ ভাসছে বাতাশে। প্রকৃতিতে এসেছে নবপ্রাণ। তবে, মানিকগঞ্জের শিবালয়ে পলাশ-শিমুলের তেমন দেখা না মিললেও তেওতা জমিদারবাড়ির আঙ্গিনায় কালের সাক্ষী হিসেবে টিকে থাকা ফুলে-ফুলে ভরা পলাশের গাছটি বসন্তের জানান দিচ্ছে। রঙ্গিন ফুলের মুগ্ধতায় যেন সতেজতা ফিরে পেয়েছে জমিদারবাড়ির দক্ষিণের আঙ্গিনা।
জানা যায়, বসন্তকালে পলাশ ও শিমুল গাছ প্রকৃতিতে শুধু শোভাই বৃদ্ধি করে না। সৌন্দর্যের পাশাপাশি গাছের মালিকরাও আর্থিকভাবে লাভবান হন। শিমুলের তুলা লেপতোষকসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার হয়। আর পলাশের রয়েছে একটি বিশেষ চাহিদা। বিদ্যাদেবী বলে খ্যাত ‘সরস্বতী’ পূজায় বাজারেও উঠে এ ফুল। এক সময় এ উপজেলার গ্রামাঞ্চলে কিছু পলাশ গাছের দেখা মিললেও কালের বিবর্তনে এখন তা অনেকটাই হারাতে বসেছে।
শিবালয় উপজেলার স্থানীয়রা জানান, কিছু-কিছু গ্রামে স্বল্প পরিমাণে শিমুল গাছের দেখা মিললেও পলাশের যেন দেখা দায়! বসন্ত ঋতুর আগমনে এরা জেগে ওঠে ফুলে-ফুলে। তবে, কালের সাক্ষী হিসেবে পলাশ ফুলের একটি গাছ এখনো টিকে আছে উপজেলার ঐতিহ্যবাহী তেওতা জমিদারবাড়ির আঙ্গিনায়।
প্রত্যক্ষদর্শী জানায়, গাছটি ভরে আছে শুধু ফুলে-ফুলে। গাছের নিচে মাটিতে কিছু ফুল বিছানা পেতেছে প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য। জমিদারবাড়ির দক্ষিণাঙ্গিনার পাশের পথে চলা অতসুক অনেকের হাতে থাকা স্মার্ট ফোনে ধারণ হচ্ছে প্রকৃতির এ দৃশ্য। এছাড়া, উপজেলার বিভিন্ন কাঁচা-পাকা রাস্তার ধারে অযত্ন-অবহেলায় কিছু শিমুল ও পলাশ গাছের দেখা মেলে। তবে এর পরিমাণে খুবই কম।
মানিকগঞ্জ প্রেসক্লাব সভাপতি গোলাম সারোয়ার ছানু বলেন, দিন পঞ্জিকায় এখনো চলছে শীতকাল। এরই মধ্যে পলাশ-শিমুলের রঙিন উচ্ছ্বাসে প্রকৃতি সেজেছে নতুনরূপে। এ রকম মনোমুগ্ধকর পরিবেশে নয়ন জুড়িয়ে যায়। এমন প্রকৃতির ছোয়া পেয়ে সকলেই আনন্দিত। শীতের তীব্রতা কাটিয়ে বইছে ফাগুন হাওয়া। যা মানুষের মনে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। শিবালয় সদরউদ্দিন ডিগ্রি কলেজ অধ্যক্ষ ড. বাসুদেব কুমার দে শিকদার জানান, দুর্লভ হয়ে উঠেছে পলাশ ফুলের গাছ। নতুন প্রজন্মের অনেকেই পলাশ ফুলের সঙ্গে তেমনা পরিচিত নন। ঋতুরাজ বসন্তকে মনে করে দেওয়ার জন্য একটি গাছই প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য যথেষ্ট। অন্তত বসন্তের জন্য হলেও বিভিন্ন স্থানে এ গাছের চারা লাগানো দরকার বলে মনে করেন তিনি।
প্রকৃতিপ্রেমী ও স্থানীয় সাংবাদিক শাহজাহান বিশ্বাস বলেন, পরিকল্পিত আবাদ না হওয়ায় পলাশ-শিমুল গাছ হারিয়ে যেতে বসেছে। অযতœ ও অবহেলায় বেড়ে ওঠা এখনো কিছু গাছ প্রকৃতিতে টিকে আছে। যার মধ্যে তেওতা জমিদারবাড়ির আঙ্গিনার পলাশ গাছটি সংরক্ষণের দাবি জানান তিনি। প্রতি বসন্তে আগুন রাঙা ফুল ফুটিয়ে গাছটি নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে আসছে।
মানিকগঞ্জ জেলা পরিবেশ রক্ষা কমিটির সহ-সভাপতি লক্ষ্মী চ্যাটার্জি বলেন, পলাশ-শিমুল গাছ উজার হওয়ায় প্রকৃতির রূপ ম্লান হচ্ছে। প্রকৃতির রূপ ও বসন্তের সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে এসব গাছ রোপণ করা প্রয়োজন।
জনকণ্ঠের সঙ্গে কথা হয় শিবালয় উপজেলা বন কর্মকর্তা শরিফুল ইসলামের সঙ্গে। এ উপজেলার পলাশ ও শিমুল গাছের সংখ্যা জানতে চাইলে এর সঠিক সংখ্যা জানাতে ব্যর্থ হন তিনি। তবে, তিনি এ জাতীয় গাছের টিকে থাকার প্রয়োজনীতা গুরুত্বারোপ করেন।
শহিদুল ইসলাম, শিবালয়, মানিকগঞ্জ
শিমুলের ভারে গর্বিত হবে মাটির বুক
বিদায় নিতে যাচ্ছে শীত। গাছে গাছে সবুজ পাতা। ফসলের মাঠ সবুজে ছেয়ে আছে। মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে। প্রকৃতিতে বইছে দখিনা বাতাস। কোকিলের সুমিষ্ট কুহুতানে ফাগুনের উত্তাল হাওয়া দিচ্ছে দোলা। ঋতুরাজ বসন্তের আগমনে গ্রামবাংলার প্রকৃতি। মঙ্গলবার ছিল মাঘের শেষ দিন। তবে নীলফামারীসহ উত্তরাঞ্চলে শীতের দাপট মাঘের শেষ দিনটিতেও ছিল বেশ দাপটে। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৯ থেকে ১১-এর ঘরে ছিল এ অঞ্চলে।
তবে ফাগুনের প্রকৃতির কুঞ্জবনে এখন অশোক, শিমুল, পলাশ, বকুল। বসন্ত বাহারে বাতাসে তার অন্য ধরনের এক মিষ্টি সুবাস। বকুল আর নিমগাছের ডালে ডালে মঞ্জরি। আগুনরঙা পলাশ, শিমুলের দামাল উপস্থিতি। ফাগুনবিলাসী রঙের মাতনে সেজে উঠেছে নীলফামারীসহ উত্তরাঞ্চলের মাঠঘাট প্রান্তর। মনে হবে এ যেন রঙের পার্বণ। ভেষজ রং, জলীয় রঙে দোলের দামালপনা। মহাকবি কালিদাস যেমন ঋতুসংহার কাব্যের একটা সর্গ লিখেছেন ওই দেখো প্রিয়ে, বসন্তকাল সমাগত। প্রবল যোদ্ধার মতো রতিলালস কামিনীগণের হৃদয় বিদ্ধ করিবার জন্যই বসন্ত। প্রকৃতিতে এখন বসন্ত। ফালগুনের শুরুতেই গাছে গাছে সীমিত আকারে ফুল ফুটছে। শালিক এবং অন্য পাখিরা প্রস্ফুটিত শিমুলের সহযোগী। ফুল ফোটার সময় এদের কলকাকলিতে মুখরিত থাকে শিমুলের আবেষ্টনী।
বসন্তে শিমুল যেন অগ্নিকন্যা। ঋতু পরিবর্তনের ধারায় শিমুলের পাতাবিহীন ডালে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে লেলিহান শিখা। টুকটুকে লালের নয়নাভিরাম ফুলের প্রাণের স্পন্দনের সুবাস। স্বাধীন দেশের স্বাধীন বাংলার হাজারো ফুলের রাজ্যে ঐতিহ্য ধরে আছে গ্রামীণ জনপদের এই মেঠোফুলটির।
ফালগুন মাসজুড়ে শিমুল ফুল লাল পাঁপড়ি মেলে সৌন্দর্য বিলিয়ে যাবে। পাশাপাশি ঝরেপড়া শিমুলের ভারে গর্বিত হবে মাটির বুক। দূর থেকে হঠাৎ দেখলে ঠিক মনে হবে, কেউ লাল গালিচা বিছিয়ে রেখেছেন। রাস্তার পাশে শিমুল ফুলের সৌন্দর্য দেখে অবশ্যই প্রকৃতিপ্রেমীদের নজর কাড়বে। পাখপাখালি আর মৌমাছিদের আনাগোনা চোখে পড়ার মত দৃশ্য। আর যেকোনো পথচারীকে দাঁড়িয়ে দেখতে বাধ্য করবেই। ফালগুনের শুরুতেই গাছে গাছে সীমিত আকারে ফুল ফুটে। প্রকৃতির রূপ লাবণ্যে শিমুল ফুল সব গাছে এখনো ফোটেনি। গাছে গাছে ফুল ফুটলে আরও সুন্দর লাগবে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বলাই-এর কথা মনে পড়ে যায়। প্রকৃতি বা বুনো গাছ-গাছড়ার প্রতি মানুষের দুর্নিবার টানÑ সেটা পথের পাঁচালীর অপুর মতো করে আর কেউ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারে নি। কিন্তু নির্দিষ্ট একটা গাছের প্রতি এতো মমতা, এতো ভালোবাসা- সেটা বোধহয় বলাইয়ের চেয়ে বেশি আর কেউ অনুধাবন করেনি। বাংলার ফুলরাজ্যে আলাদা একটা ক্রেজ আছে গ্রামীণ এই মেঠোফুলটির। এমন সাজানে গোছানো পুরু পাঁপড়ি তার ওপর ঘণ্টার মতো চেহার আর শক্তপোক্ত গড়ন—এমন পরিপূর্ণ ফুল কি আর আছে প্রকৃতি রাজ্যে? পলাশের মনে আসবে অনেকের। পলাশের পাঁপড়িগুলোও আগুনরঙা, কিন্তু পাঁপড়ির বিন্যাসে কেমন যেন এলোমেলো ভাব। আর গন্ধের কথা যদি বলা হয়, বসন্তে আম, ভাটফুলের আর বাতাবি লেবুর ফুলের যেমন আলাদা রকম সুবাস, সেই সুবাসের কারণেই গড়ে ওঠে আলাদা এক স্বপ্নালু জগত, শিমুলের সুবাসেও ঠিক তেমনই মন পাগল করা এমন একটা জগত আছে। চেহারায, সংখ্যায় আর সবাইকে টেক্কা দিতে পারে বলেই হয়তো ঝরেপড়া শিমুলের ভারে গর্বিত হয় মাটির বুক। সাধারণত শিমুল গাছ সবুজ পাতায় সুশোভিত থাকে। তবে শীতের শুরুতেই সব পাতা ঝরে গাছ পুরোপুরি ন্যাড়া হয়ে যায়। বসন্তকালে অন্য বৃক্ষরা যখন নব পলবে সেজে ওঠে তখন শিমুল গাছে শুধু কুঁড়ি বের হয়। সেই বোধহয় ভালো। নইলে শিমুলের পাতার যে সৌন্দর্য, সেটা এর ফুলের কাছে একেবারে ফিকে হয়ে যেত। আবার উল্টো ঘটনাও ঘটতে পারত। শিমুলের পাতার যে বাহার, যে বিপুল তাদের সংখ্যা, হয়তো তার আড়ালে কিছুটা হলেও ম্লান হয়ে যেত শিমুলের সুন্দরী পুষ্পকুল!
শিমুলের রেশমি তুলা জাজিম, গদি, তাশেক, বালিশ তৈরিতে ব্যবহার হয়। কাঠ নরম ও অস্থায়ী হওয়ায় এর দ্বারা খেলনার বস্তু, প্যাকিং-বক্স, দিয়াশলাইয়ের খোল ও কাঠি, কাগজের ম- এমনি বহু প্রয়োজনীয় কাজে বহুল ব্যবহার্য। আমাদের দিয়াশলাই শিল্প আজ অনেকাংশেই শিমুল নির্ভর।
বেশ কয়েকটি শিমুল গাছের মালিক বশির মিয়া বলেন, পুরো শীতে গাছগুলো পাতা ঝরায়। ফালগুনের প্রথম সপ্তাহে কুঁড়ি এবং মাঝামাঝি সময়ে পুরো গাছজুড়ে ফুল আসে। কখনো কখনো একটু আগে-পরেও ফুল ফোটে। ফুলের পাঁপড়ি ১০-১২ সেন্টিমিটার হয়। পরে মোচাকৃতির ফল ধরে এবং বৈশাখ মাসে তা ফেটে বীজ ও তুলা বের হতে থাকে। একটি বড় ধরনের গাছ থেকে তুলা বিক্রি করে ১০-১৫ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। আগের তুলনায় এখন শিমুলের তুলার দাম অনেক বেড়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, এই শিমুল ঔষধি গাছ হিসেবেও পরিচিত। অন্যান্য গাছের মতো এ গাছ কেউ শখ করে লাগায় না। নেওয়া হয় না কোনো যতœ। অযতœ আর অনাদরে প্রাকৃতিকভাবেই এ গাছ বেড়ে ওঠে। এ গাছের প্রায় সব অংশই কাজে লাগে। এর ছাল, পাতা ও ফুল গবাদিপশুর খুব প্রিয় খাদ্য। বালিশ, লেপ ও তোষক তৈরিতে শিমুল তুলার জুড়ি নেই। বর্তমানে মানুষ এ গাছকে তুচ্ছ মনে করে কারণে অকারণে কেটে ফেলছে। অতীতে ব্যাপকহারে নির্মাণ কাজ, টুথপিকসহ নানা ধরনের প্যাকিং বাক্স তৈরি ও ইটভাটার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হলেও সেই তুলনায় রোপণ করা হয়নি শিমুল গাছ।
তাহমিন হক ববী
নীলফামারী