
শুভ্র সুন্দর পারিজাতিকা ফুল দিয়ে গাঁথা মালা বিক্রি হচ্ছে ঢাকার পথে পথে
এক দেশে এক রাজকন্যা ছিল। তার রূপের কথা আর কী বলব! বলে শেষ করার মতো নয়। অপরূপা রাজকন্যাকে কত শত রাজপুত্র নিজের করে পেতে চেয়েছে! কিন্তু চাইলেই তো হবে না। রাজকন্যার দৃষ্টি ছিল অন্য কোথাও। অন্য কোনখানে। কোথায়? কোনখানে? শুনে অনেকের চোখ কপালে উঠবে। রাজকন্যার পছন্দ ছিল সূর্য। তেজোদীপ্ত সূর্যের জন্য সে কী আকুলি বিকুলি তার। আর কাউকে নয়, তার সূর্যকে চাই। কিন্তু হায়! সূর্য এই ভালোবাসার মূল্য বোঝে না। একদমই সাড়া দেয় না রাজকন্যার আহ্বানে। অধরা হয়ে দূর আকাশেই থেকে যায়। এমন নিষ্ঠুর প্রত্যাখ্যানের ঘটনায় প্রেমিকার বুক ভেঙে খান খান হয়ে যায়। ব্যথা সইতে না পেরে বেছে নেয় আত্মহননের পথ।
শাস্ত্র মেনে তার শরীর দাহ করা হয়। দাহ করা হয় বটে। রাজকন্যার দেহভস্ম থেকে জন্ম নেয় একটি গাছ। গাছে চমৎকার ফুল ফোটে। রাতে ফোটা শুভ্র সুন্দর ফুল সকালে তেমন দেখা যায় না। সূর্যের স্পর্শ পাওয়া মাত্রই অশ্রুবিন্দুর মতো ঝরে পড়ে। দুখীনি রাজকন্যার নামে এই ফুলের নামকরণ করা হয় ‘পারিজাতিকা।’ পৌরাণিক এই কাহিনী অনুযায়ী, পারিজাতিকা বেদনার প্রতীক। ব্যর্থ প্রেমের আলেখ্য।
একই ফুল পুরাণে এসেছে ‘পারিজাত’ নামে। পারিজাতকে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে স্বর্গের শোভা হিসেবে। এই কাহিনী অনুযায়ী কৃষ্ণের দুই স্ত্রী সত্যভামা ও রক্তকমিণী। উভয়েরই ইচ্ছে তাদের বাগান পারিজাতের ঘ্রাণে ভরে উঠবে। কিন্তু পারিজাত তো স্বর্গের শোভা। মর্ত্যে কেন আসবে? কৃষ্ণ তবু ফুলটি সংগ্রহের পরিকল্পনা করেন। স্ত্রীদের খুশি করতে লুকিয়ে স্বর্গের পারিজাত বৃক্ষ থেকে একটি ডাল ভেঙে নিয়ে আসেন তিনি। পরে সত্যভামার বাগানে এটি রোপণ করা হয়। সেখান থেকে ফুলটি সুগন্ধ ছড়ায়। রক্তকমিণীর বাগানেও এই ফুল ফোটে। এদিকে স্বর্গের রাজা ইন্দ্র পারিজাতের ডাল ভেঙে নিয়ে যাওয়ার কথা শুনে ভীষণ রেগে যান। কৃষ্ণকে শাপ দেন, বলেন, কৃষ্ণের বাগানের পারিজাত বৃক্ষ ফুল দেবে ঠিকই। কোনো দিন ফল ধরবে না, তার বীজে কখনো নতুন প্রাণের সঞ্চার হবে না। ঘটনা তা-ই ঘটেছিল কি না, সেটি অন্য আলোচনা। তবে পারিজাতের মতো সুগন্ধী একটি ফুল ঠিকই পাওয়া হয়েছিল পৃথিবীর।
কবিগুরু লিখেছিলেন, পারিজাতের মধুর গন্ধ পাও কি-/হায় বুঝি তার নাগাল মেলে না...। আপনিও কি নাগাল পাচ্ছেন না পারিজাতের? তা হলে বলি, পারিজাত বা পারিজাতিকার আরেক নাম শিউলি। এবার নিশ্চিয়ই চেনা হলো। নাগালে পাওয়া হলো প্রিয় ফুল। হ্যাঁ, এখন এই শরতের কালে প্রচুর শিউলি ফুটছে। অবশ্য দিনে নয়, এ ফুল রাতে ফোটে। তখন গাছের দিকে তাকালে মনে হয় ঘন সবুজ পাতার মাঝে টুকরো টুকরো আলো ছড়িয়ে আছে। ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ গাছের নিচ থেকে একচুল সরতে দেয় না।
রাতে গাছে দেখা ফুল ভোর হতে না হতেই মাটিতে ঝরে পরে। একসঙ্গে এত ফুল মাটিতে পড়ে থাকে যে, দেখে মনে হয় শিউলি বিছানো পথ। নজরুল তাই লিখেছিলেন: এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলি বিছানো পথে। ঝরে পড়া ফুল গাছে থাকা ফুলের মতোই তরতাজা। ঘ্রাণটাও নতুন। নাকে এসে লাগতেই দারুণ স্নিগ্ধ একটা অনুভূতি হয়। সবুজ ঘাসের ওপর সারারাত ধরে জমা হওয়া শিউলি খুব ভোরে সযতেœ কুড়িয়ে নেন ফুলপ্রেমীরা। মুঠোভর্তি ফুল জীবনের অনেক অপ্রাপ্তির কথা মুহূর্তের জন্য হলেও ভুলিয়ে দেয়।
কবি আবিদ আজাদ আবার দেখেছিলেন মরা শিউলি গাছ। বিচ্ছেদের কষ্ট থেকে প্রেমিকার উদ্দেশ্যে তিনি লিখেছিলেন : ‘যে শহরে আমি নেই আমি থাকব না সে শহরে জনহীন কোন/পেট্রোল পাম্পের দেওয়াল ঘেঁষে/একটা মরা শিউলি গাছের মতো বেঁচে থাকবে তুমি।’ কবি আজ নেই। কী হলো তার প্রেমিকার? জানা যাবে না কোনো দিন। তবে এ কবিতা শিউলির কথা মনে করিয়ে দেবে সব সময়।
পারিজাতিকা, পারিজাত বা শিউলি ফুলের আরও কিছু নাম আছে। প্রচলিত অন্য নামগুলোর মধ্যে রয়েছে শেফালি, শেফালিকা, নাইট ফ্লাওয়ার জেসমিন, হারসিঙ্গার, কোরাল জেসমিন, রাগাপুষ্পি, খারাপাত্রাকা ও প্রজক্তা। বৈজ্ঞানিক নাম নিক্টান্থেস আরবর-ট্রিসটিস। লাতিন শব্দ নিক্টান্থেস অর্থ সন্ধ্যায় ফোটা। আরবর-ট্রিসটিস হচ্ছে বিষণœ গাছ। রাতে ফোটে সকালে ঝরে যায় বলে একে ট্রি অব সরো বলেও ডাকা হয়। নজরুল তাই হয়ত লিখেছেন : দূর প্রবাসে প্রাণ কাঁদে আজ শরতের ভোর হাওয়ায়।/শিশির-ভেজা শিউলি ফুলের গন্ধে কেন কান্না পায়...।
উদ্ভিদবিদদের বর্ণনা মতে, শিউলির ছয়টি শুভ্র সাদা পাপড়ি। বৃন্তটি কমলা রঙের টিউবের মতো দেখতে। গাছ সাদামাটা। নরম। লম্বায় ১০ মিটারের মতো হয়। পাতা ৬ থেকে ৭ সেন্টিমিটার লম্বা ও সমান্তরাল প্রান্তের বিপরীতমুখী সাজানো থাকে। দক্ষিণ এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব থাইল্যান্ড থেকে শুরু করে ভারত, নেপাল ও পাকিস্তান পর্যন্ত এলাকাজুড়ে শিউলি ফুটে। শুধু তাই নয়, এটি পশ্চিমবঙ্গ ও থাইল্যান্ডের কাঞ্চনাবুরি প্রদেশের প্রধান ফুল। আর বাংলাদেশে তো শিউলির তুলনা কেবলই শিউলি। গ্রামীণ বালিকারা, তরুণীরা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে শিউলি কুড়োতে বের হয়ে যায়। আঁচল ভর্তি করে শিউলি নিয়ে ঘরে ফেরে। রাজধানী শহরেও পথশিশুরা এ ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথে। পথে ঘুরে ঘুরে সে মালা বিক্রি করে তারা। একটি মালা মানে, অনেকগুলো ফুল। হাতে নিতেই দিনটা অন্যরকম হয়ে যায়। দেখবেন নাকি হাতে নিয়ে?