
পাকা তাল উঠেছে বাজারে
শরতকাল। তাল পড়বে না, তা কি হয়! এ কি যেমন তেমন তাল। বাঙালীর সংস্কৃতির ঐতিহ্যের ফল তাল। তালের কত রূপ। তালখুর (তালের শাঁস) খেতে মজা। আর ভাদ্র, আশ্বিন মাসের তাল। কত পদের যে পিঠা আর সুস্বাদের খাবার তৈরি হয় এই তাল দিয়ে। তালের পিঠা, তালের বড়া, তালের পায়েস, ফিরনি,তালসত্ত্ব, তালের ক্ষীর। এই ক্ষির দিয়ে পাটিসাপটা পিঠাসহ আরও কত কি বানানো হয়। হালে তাল দিয়ে খাবারের নানা রেসিপি তৈরি হচ্ছে।
তালকে নিয়ে অনেক কথাও আছে। বাংলার বাগবিধিতে আছে পিঠে তাল পড়ার কথা। সঙ্গীতে আছে সুরের তাল। কেউ উলটপালট কথা বললে, আনন্দে ও কোন কারণে ধৈর্যচ্যুতি হয়ে অস্বাভাবিক আচরণ করলে বলা হয় -গ্যাছে বেতাল হয়ে। বেসুরো গান, তবলার বোল কেটে গেলে বলা হয়- তাল কেটে বেতাল হয়েছে। এলোমেলো কিছু করলে বলা হয়- তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। একশ্রেণীর মানুষ কারও কাছে ভাল সেজে থাকতে, স্তুতি ও স্তাবকতায়, মোসাহেবি করতে তাল মিলিয়ে কথা বলেন। হিপোক্র্যাটরা এই কাজটি খুব নিখুঁতভাবে করতে পারেন। ভিলেজ পলিটিকস, চাকরি জীবনে তাল মিলিয়ে চললে উপরে ওঠা কঠিন নয়। প্রেমে মন পেতেও তাল মিলিয়ে চলতে হয়। তা না হলে দুঃখ আছে।
ভাদ্র মাসে তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বলা হয়, তাল পাকানোর গরম। প্রকৃতিই পি-াকৃতির সুপক্ব ফলটি পাকিয়ে ঘন লালচে রঙের করে দিতে তাপ বাড়িয়ে দেয়। এই তালপাতার পাখা গরমে স্বস্তির উপকরণ। এক সময় তালপাতায় লেখা হতো। ছিপছিপে গড়নের কোন লম্বা মানুষকে দেখলে আজও বলা হয় তালগাছ। প্রকৃতির আর্কিটেক্ট বাবুই পাখি বাসা বাঁধে তালগাছে। সরু ডগায় খড়কুটা দিয়ে যে বাসা বানায় তা চিরকালের ক্লাসিক শিল্পকর্ম হয়ে আছে।
শরত ও হেমন্তে ঘরে বাঙালীর ঐতিহ্যের তালের খাবার না খেলে তালের ষোলো কলা পূর্ণ হয় না। সামাজিক বিশ্লেষণ হলো, মৌসুমের ফলফলাদি খেতে হয়। তালের দ্রব্যগুণে ভিটামিন এ বি সি, পটাশিয়াম, জিঙ্ক, আয়রন, ক্যালসিয়াম, এ্যান্টি অক্সিডেন্ট, এ্যান্টি ইনফ্লামেটরি উপাদান আছে। তবে তালের রস নিয়ে কথা আছে- গাছ চুইয়ে সংগ্রহ করা টাটকা রসের দ্রব্যগুণ আছে, যা শরীরে ফিল্টারের কাজ করে। বিপাকে পড়তে হয় সংগৃহীত রস বিলম্বে পান করলে- তখন বেতালই নয়; সমতল ভূমি চোখে অসমতল দেখা যায়।
গ্রামের সুন্দর দৃশ্য আঁকতে তালগাছ জুড়ে না দিলেই নয়। একটা সময় লম্বা ঋজু একহারা চেহারার তালগাছ নেই এমন গ্রাম খুঁজে পাওয়া যেত না। দূর থেকে দেখা যায় এমন তালগাছ ছিল গাঁয়ের কোন বাড়ি চেনার নির্দেশক। গত শতকের মধ্যভাগের পর গ্রামে তালগাছ কমে যাওয়া শুরু হয়। অন্যতম কারণ ছিল, একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে খ-িত পরিবার শুরু হওয়া। বাড়ির ধারের তালগাছ কাটা শুরু হয়। তবে একবিংশ শতকে এই তালগাছ বজ্রপাতে মৃত্যুর হার কমাতে বড় ভূমিকা পালন করছে। ফের তালগাছ রোপণ শুরু হয়েছে। এখন শুধু বাড়ির আঙিনায় নয়, রাস্তার দুই ধারে তালগাছ রোপণ করা হচ্ছে।
আমাদের কাব্যে, সাহিত্যে অনেকটা জায়গা করে নিয়েছে তালগাছ। বনফুল তার ‘নুড়ি ও তালগাছ’ নামের গল্পটিতে যা সৃষ্টি করছেন তা অমর হয়ে আছে। এই গল্পের বর্ণনায়- বিশাল প্রান্তরে দাঁড়িয়ে নিঃসঙ্গ এক তালগাছ। তলায় পাথরের ছোট্ট নুড়ি। ঘাসই তার ভুবন। উঁচু তালগাছ তার কাছে বিস্ময়। নুড়ি গাছকে জিজ্ঞাসা করে- কে আপনি? অত উঁচুতে কী দেখেন। এভাবেই গল্পের গতি নিপুণ ছন্দ নিয়ে এগিয়ে যায়।
তালপাতার পুঁথি ও তালপাতার সেপাইয়ের কথা কে না জানে। কেচ্ছা ও শিশু সাহিত্যে তালগাছকে নিয়ে অনেক মজা আছে। বিশাল পাথারে এক তালগাছ- তাতে মামদো ভূতের বাস ভরদুপুরে বিলের ধারে, সন্ধ্যায়, ভোররাতে, গভীর রাতে তালগাছের নিচ দিয়ে যেতে কে কখন ভয়ে দাঁত লেগে পড়ে গেছে এ নিয়ে কতই গালগপ্প গ্রামে ছড়িয়েছে দূর অতীতে। তালগাছে কুসংস্কারের ভূতপেত্নি না থাক পিঠে তাল পড়লে মুখ থেকে এ্যাঁ উঁ শব্দ বের হয়ে আসে।
চিরচেনা তালগাছের আদি নিবাস আফ্রিকায়। বহুকাল আগে এই দেশে তার আগমন। বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন বোরাসুস ফ্লাবেলিয়ার। ইংরেজী নাম ডব পাম, টুড্ডে পাম, আইস এ্যাপেল ইত্যাদি। তালগাছ খুবই ধীরে বাড়ে। ৩০ থেকে ৪০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়। বসন্তের শেষে ফুল ধরে ফল পাকে শরতে। পোক্ত কা-ের গাছ ঘরের শক্ত খুঁটি হিসাবে ব্যবহার হয়। তালের আঁশ দিয়ে হস্তশিল্পের নানা কিছু তৈরি হচ্ছে। কুটির শিল্পে পরিণত হয়ে রফতানি হচ্ছে। আফ্রিকার তাল তাল মিলিয়ে দাপটেই আছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সে-ই কবে “তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে” এমন কবিতায় তালের ছন্দ এনে দিয়েছেন। সেই ছন্দ চিরন্তন হয়ে আছে।