ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১০ আগস্ট ২০২৫, ২৬ শ্রাবণ ১৪৩২

শাহ মোঃ জিয়াউদ্দিন

স্মরণ ॥ বসন্ত বাতাসে শাহ আব্দুল করিম

প্রকাশিত: ২১:৩০, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২

স্মরণ ॥ বসন্ত বাতাসে শাহ আব্দুল করিম

‘বসন্ত বাতাসে সই গো, বসন্ত বাতাসে, বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ, আমার বাড়ি আসে সই গো বসন্ত বাতাসে।’ এমনিই এক বসন্তে জন্ম নিয়েছিলেন অসাম্প্রদায়িক, বাঙালী সংস্কৃতিতে চির বসন্তধারা তৈরির কারিগর বাউল শাহ আব্দুল করিম। ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দিনটি ছিল ফাল্গুন মাসের দ্বিতীয় দিন। এইদিনে তৎকালীন অসম রাজ্যের শ্রীহট্ট জেলার সুনামগঞ্জ মহকুমার দিরাই থানার উজানধলন গ্রামে শাহ আব্দুর করিম জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বহন করে এনেছিলেন ফুলের গন্ধ, যা বাঙালী সংস্কৃতিকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সুবাসিত করেছে। সুনামগঞ্জকে বলা হয় ভাটি এলাকা। এই অঞ্চলটিতে সারা বছরই থাকে পানি। আগেকার দিনে বছরে একটি ফসল ফলত ভাটি এলাকায়। তাই অভাব আর দারিদ্র্য ছিল এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের নিত্যসঙ্গী। বৈশাখ থেকে আশ্বিন পর্যন্ত এই সময়টা ভাটি এলাকায় কোন কাজ থাকত না। এই কর্মহীন মানুষগুলো মেতে থাকতেন নানা ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে। এখানকার মানুষ ছিল ধর্মভীরু। তাই মহাজন, গ্রাম্য মাতব্বর, মৌলবাদী নেতারা ধর্মীয় প্রলেপে সাধারণ মানুষকে শোষণ করত। শাহ আব্দুল করিম তার সঙ্গীতচর্চার মাধ্যমে এই মৌলবাদীদের বিরুদ্ধাচরণ করেন। শাহ আব্দুল করিমের জন্ম হয় এক অভাবের সংসারে। অভাবী সংসারে জন্ম নেয়া শাহ আব্দুল করিম হাওড়ে আর্থ-সামাজিক অবস্থাটি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই তার প্রতিটি গানের মূল বাণীতে রয়েছে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও সাম্যের কথা। তিনি পারস্পারিক সম্প্রীতির বন্ধন গড়ার লক্ষ্যে বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আরেক বন্ধুর বাড়িতে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। গানটির মূল উদ্দেশ্য হলো জাগতিক সম্পদ যেন ফুলের গন্ধের মতো সবার কাছে পৌঁছায় সমানভাবে। শাহ আব্দুল করিম একজন স্বশিক্ষিত মানুষ ছিলেন। নেই কোন ধরনের একাডেমিক শিক্ষা। তবে তিনি সমাজ পরিবেশ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সুশিক্ষিত হয়েছিলেন। সেই জ্ঞান ও শিক্ষার মান বিচার করলে তার সমকক্ষ শিক্ষিত মানুষ খুব বেশি পাওয়া যাবে না। তিনি মাত্র আটদিন স্কুলে পড়েছিলেন। শাহ আব্দুল করিম ছিলেন একজন ব্রিটিশবিরোধী। তাই তিনি স্কুল ত্যাগ করেন। শাহ আব্দুল করিমের কাছে মানুষ ছিল বড়, তিনি মানবিক মূল্যবোধ লালন করতেন। তার কাছে হাওড় অঞ্চলে বসবাসরত সকল ধর্মের-বর্ণের মানুষ ছিল সমান। একবার ঈদের দিন তিনি ঈদের নামাজের আগে সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষ নিয়ে একটি গানের আসর বসান। ঈদের দিন গানের আসর বসানোর দায়ে তাকে মৌলবাদীদের রোষানলে পড়তে হয়। মৌলবাদীরা তাকে তওবা করতে বলেন। তওবা করতে বলায় শাহ বলেছিলেন যে, আমি তো কোন অন্যায় করিনি। তাহলে কেন তাকে তওবা পড়তে হবে? তখন মৌলবাদীরা শাহ আব্দুল করিমকে কাফের উপাধিতে ভুষিত করেন। মৌলবাদী, সমাজের মাতব্বরসহ জোতদাররা সিদ্ধান্ত নেন যে, এই কাফেরকে তারা আর গ্রামে রাখবেন না। কিন্তু শাহ আব্দুল করিম ছিলেন সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয়। যার জন্য তারা তাকে মারতে পারেনি। সেই সময় গ্রাম্য সালিশে মোড়লরা সিদ্ধান্ত নেন শাহ আব্দুল করিমকে গ্রাম থেকে বিতাড়িত করার। প্রাণভয়ে সেইদিন শাহ আব্দুল করিম নিজের জন্ম গ্রাম উজানধলন ছেড়ে হাওড়ের গান্ধার গ্রামে আশ্রয় নেন। গান্ধার গ্রামটি ছিল একটি পশ্চাৎপদ জনপদ। তবে এই গ্রামের ঐতিহ্য ছিল গান-বাজনার। তাই এই গ্রামে শাহ আব্দুল করিম নিজেকে মানিয়ে নেন সহজেই। তিনি সকল কুসংস্কার, অপসংস্কৃতি, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে আজীবন লড়াই করে গেছেন। উজানধলন গ্রাম ছাড়ার পর তিনি তার একটি গানে বলেছেন , ‘মন মিলে, মানুষ মিলে সময় মিলে না।’ শাহ আব্দুল করিম ছিলেন একজন ভবঘুরে মানুষ। তার কাছে গানের মাধ্যমে মানবতা ও মানবপ্রেম ছড়ানোটাই ছিল বড়। সংসারধর্মের চেয়ে এ জগতের কুসংস্কার, ধর্মীয় বিভেদ নির্মূল করা, সেইসঙ্গে সমতার সমাজ নির্মাণের কাজটি ছিল তার কাছে মুখ্য। তিনি এই কাজটি করতেন গানের মাধ্যমে। সমাজ বদলের এই সংগ্রামটি ছিল তার কাছে নিজ সংসারে চেয়ে বেশি জরুরী। তিনি প্রেম করে বিয়ে করেন কাচামালা নামের এক নারীকে। এটা ছিল তার প্রথম বিয়ে। শাহ আব্দুল করিম তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে ঘরে রেখে দূর-দূরান্তের হাওড়ের গ্রামে গ্রামে গানের আসরে মেতে থাকতেন। এই অবস্থা দেখে কাচামালার পরিবার ক্ষুব্ধ হয়। তার শ্বশুর তাকে ডেকে বলেন, আমার মেয়ের সঙ্গে তুমি সংসার করতে পারবে যদি তুমি গান ছেড়ে দেও। তিনি গান ছাড়তে রাজি হননি। সংসার ছাড়তে রাজি হয়েছিলেন। এভাবেই শাহ আব্দুল করিমের প্রথম বিয়েটি টেকেনি। তিনি দ্ধিতীয় বিয়ে করেছিলেন আফতাবুন্নেছা সরলা নামের এক নারীকে। সরলা নামের এই মহীয়সী নারী ছিলেন শাহ আব্দুল করিমের জীবন-সংগ্রামের সাথী। সরলা এই মানবপ্রেমী মানুষটিকে চিনতে পেরেছিলেন। শাহ আব্দুল করিমের চরম দরিদ্র পরিবারে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটিয়েছেন সরলা। কোনদিন সরলা শাহ আব্দুল করিমের এই ভবঘুরে জীবন নিয়ে কোন অভিযোগ করেননি। তিনি সরলাকে মুর্শিদ বলে সম্বোধন করতেন। বাংলা জনপদের স্বাধীনতা আন্দোলনে শাহ আব্দুল করিমের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ, মহাজন, জমিদার, জোতদারদের বিরুদ্ধে অনেক গান গেয়েছেন শাহ আব্দুল করিম জনগণকে সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে। ১৯৪৮ সালে জিন্নাহ যখন রাষ্ট্রভাষা উর্দু ঘোষণা করেন তার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। ভাটি অঞ্চলের গ্রামগুলোর হাট-বাজারে গানের আসরে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই এই দাবিতে গান গেয়েছেন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে বাংলা জনপদের মানুষকে করেছিলেন মুক্তির সংগ্রামের জন্য সংগঠিত। বাংলা জনপদের মানুষকে সংঘবদ্ধ করার জন্য বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন জেলায় ও অঞ্চলে জনসভা করতেন। বঙ্গবন্ধু যখন যুক্তফ্রন্ট সরকারে মন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনি ১৯৫৬ সালে সুনামগঞ্জের এক জনসভায় বক্তৃতা করেন। সেই সভায় শাহ আব্দুল করিম একটি গান গেয়েছিলেন। গানটি ছিল- ‘পূর্ণচন্দ্রে উজ্জ্বল ধরা, চৌদিকে নক্ষত্রঘেরা, জনগণের নয়নতারা, শেখ মুজিবুর রহমান, জাগরে জাগরে মজুর কৃষাণ।’ বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেছিলেন, আমরা আছি যেখানে, করিম ভাই আছে সেখানে। বঙ্গবন্ধুর সেই সফরকালে সুনামগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী লীগের কমিটি ঘোষণা করেন। এই কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদকের দায়িত্ব পান শাহ আব্দুল করিম। তারপর থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শাহ আব্দুল করিমের হৃদ্যতা বেড়েই চলেছিল। ১৯৫৭ সালে বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে শাহ আব্দুল করিম টাঙ্গাইলের সন্তোষে কাগামারী সম্মেলনে যোগ দেন। এই সম্মেলনের মঞ্চে শাহ আব্দুল করিম শিল্পী রমেশ চন্দ্র শীলের সঙ্গে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। বঙ্গবন্ধু সুনামগঞ্জে যতবার সফরে গিয়েছিলেন প্রত্যেকটি সফরেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে থাকতেন শাহ আব্দুল করিম। বঙ্গবন্ধু বলতেন, মুজিব ভাই বেঁচে থাকলে করিম ভাইও বেঁচে থাকবে ইনশাল্লাহ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন সপরিবারে নিহত হন তার প্রতিবাদও করেছিলেন এই বাউল শিল্পী। শাহ আব্দুল করিম তার গানের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক, মানবিক মূল্যবোধের সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন আমৃত্যু। মানবিক মূল্যবোধ ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ হলো একটি ফুলের বাগানের সমতুল্য। শাহ আব্দুল করিম তার গানের মাধ্যমে এই সমাজকে একটি ফুলের বাগান বানাতে চেয়েছেন। তাই বাংলায় তিনি বেঁচে আছেন চিরবসন্ত হয়ে। ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর এই বরেণ্য মানুষটি মৃত্যুবরণ করেন। লেখক : গবেষক
×