ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৭ মে ২০২৫, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

এনামুল হক

মুদ্রাস্ফীতি কি ফিরে আসছে

প্রকাশিত: ২০:৪৯, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২১

মুদ্রাস্ফীতি কি ফিরে আসছে

অনেককে বলতে শোনা যাচ্ছে যে, করোনাভাইরাসের অধ্যায় থেকে বেরিয়ে এসে বিশ্ব এখন উচ্চতর মুদ্রাস্ফীতির যুগে প্রবেশ করতে পারে। তাদের যুক্তি যে খুবই জোরালো তা যেমন নয়, তেমনি আবার অন্তঃসারশূন্যও নয়। মুদ্রাস্ফীতির জোয়ারের মোকাবেলা করতে হবে এমন একটা সম্ভাবনা যদি ক্ষুদ্র পরিসরেও থাকে সেটাও যথেষ্ট উদ্বেগজনক। কেননা, দেশে দেশে সরকারগুলোর ঋণের বোঝা অনেক বেশি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ব্যালেন্সশীটও অনেক স্ফীত হয়ে গেছে। পণ্য ও সার্ভিসের দ্রুত এবং বিরামহীন মূল্যবৃদ্ধির ফলে সঞ্চয়কারীদের হাত থেকে সম্পদ চলে যায় এবং মজুরির মূল্যমানও কমে যায়। এতে মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতাই শুধু যে কমে যায় তা নয়, পুঁজিবাদের নির্ভরযোগ্য ভবিষ্যত সম্পর্কে আস্থাও ক্ষয়ে যায়। ১৯৭০-এর দশকের প্রথমভাগ থেকে শুরু করে ১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত ৫০ শতাংশেরও বেশি আমেরিকান বলেছিল যে, মুদ্রাস্ফীতি বা জীবনযাত্রার উচ্চব্যয়ই হচ্ছে দেশের সামনে একক বৃহত্তম সমস্যা। কিন্তু ১৯৯০-এর দশক নাগাদ সেই সমস্যাকে ব্যাহত দমন করা হয়েছিল। সমস্যাটা নতুন করে আত্মপ্রকাশ করে ২০০০-এর দশকের শেষদিকে। সে সময় ২০০৮ সালের মন্দা মোকাবেলায় সরকারের দেয়া প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর কারণে সরকারী ঋণ বহুল পরিসরে বেড়ে যায়। নতুন নোট ছাপানোর ফলে কয়েক ট্রিলিয়ন নতুন ডলার বাজারে আসে। অনেকে উদ্বিগ্ন হয় এইভেবে যে, এর ফলে দ্রব্যমূল্য এমনভাবে বাড়বে যা এক প্রজন্মের মধ্যে দেখা যায়নি। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। ১৯৭০-এর দশকে ধনী বিশ্বে মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছিল বছরে গড়ে ১৯ শতাংশ। ২০১০-এর দশকে এই হার বছরে ২ শতাংশের নিচে থেকেছে। অর্থনীতিবিদ ও বিনিয়োগকারীদের যে ক্ষুদ্র দলটি অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল, তাদের আশঙ্কা উপেক্ষিত হওয়ার এটা ছিল অন্যতম কারণ। কিন্তু সে আশঙ্কাকে উপেক্ষা করা সহজ হতে পারে, তবে তাই বলে সে বিচক্ষণতার পরিচয় না-ও হতে পারে। ২০২০ সাল যদি কোন শিক্ষা বহন করে থাকে তাহলে সেটা হচ্ছে এই যে যেসব সমস্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন বোধ করা বিশ্বের অনেকেই বহুলাংশে বন্ধ করে দিয়েছিল, সেগুলো সহসা এক ভয়াবহ শক্তি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। আজ যারা মুদ্রাস্ফীতি সম্পর্কে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছে, তাদের আশঙ্কাকে ২০০৯ সালের মতো মিথ্যা আশঙ্কা বলে উড়িয়ে দেয়ার কোন কারণ নেই। কারও কারও আশঙ্কা এমন যে সম্ভবত উচ্চমাত্রায় তবে ক্ষণস্থায়ী মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেবে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিবিদ বিল ডুডলে গত ৩ ডিসেম্বর হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন যে, মহামারীর কারণে কমে যাওয়া সরবরাহের সঙ্গে চাহিদার ভারসাম্য রক্ষার জন্য ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজন হতে পারে। পরদিন ডেভিড আনদোলফান্তো নামে আরেক অর্থনীতিবিদ হঠাৎ করে সাময়িক মুদ্রাস্ফীতি মোকাবেলায় আমেরিকানদের প্রস্তুত থাকার জন্য হুঁশিয়ার করে দেন। অন্যবছর হুঁশিয়ারি হলো এই যে মুদ্রাস্ফীতির চাপ ক্ষণস্থায়ী নয় বরং অধিকতর লাগাতার হবে। মরগ্যান স্ট্যাননী ব্যাংকের অর্থনীতিবিদরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, আমেরিকায় মুদ্রাস্ফীতির ধরন ও বৈশিষ্ট্যে মৌলিক পরিবর্তন ঘটবে। মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে ২০২১ সালের দ্বিতীয়ার্ধের মধ্যে ফেডারেল সরকারের টার্গেট ২ শতাংশে পৌঁছবে এবং তারপর সেটাকে ছাড়িয়ে যাবে। সাধারণ এক মন্দার পর মুদ্রাস্ফীতি ঘটতে তিন বছর বা তারও বেশি লেগে যেতে পারে। সবচেয়ে নৈরাশ্যবাদী গ্রুপের হুঁশিয়ারি হলো, আত্মতুষ্টি থেকে কিংবা হতবিহ্বল হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো এ ধরনের মুদ্রাস্ফীতির চাপ অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলতে দিতে পারে, যার পরিণতিতে এক দশক ধরে বেয়ারা ধরনের অতি মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিতে পারে, যা কিনা ১৯৭০-এর দশকের মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে তুলনীয়। এর পিছনে প্রধান তিনটি কারণ কাজ করতে পারেÑ মহামারী মোকাবেলায় সরকারের গৃহীত প্রণোদনা ব্যবস্থার প্রভাব, জননীতির পরিবর্তন এবং অর্থনীতির প্রতি নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। মুদ্রাস্ফীতির মূল কারণ অর্থের অতিরিক্ত সরবরাহ। ৮ শ’ বছরের রেকর্ড পর্যালোচনা করে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গবেষকরা উপসংহার টেনেছেন যে, একটা মহামারী শুরু হওয়ার এক বছর পর সাধারণত মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। ১৯১৮-২০ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীর কারণে অন্তত সাময়িকভাবে মুদ্রাস্ফীতির হার বেড়ে গিয়েছিল। কোভিড-১৯ এর সর্বনাশা প্রভাব যখন পুরোপুরি কেটে যাবে, ততদিনে মানুষের ব্যয় করার সুযোগ যতটা না থাকবে, তার চেয়ে ব্যয় করার স্পৃহা সহজেই দ্রুততর গতিতে ফিরে আসতে পারে। ইতোমধ্যেই কিছু কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম হচ্ছে। এক দেশ থেকে আরেক দেশে কোন কিছু পাঠানোর খরচ সাম্প্রতিককালে লাফ মেরে বেড়ে গেছে। যেমন আকরিক লোহার দাম ২০২০ সালের শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ৬০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। তবে জরিপের তথ্য বা আর্থিক বাজারের চিত্র কোনটি থেকে মনে হয় না যে দ্রব্যমূল্যের নাটকীয় বৃদ্ধি ঘটবে বলে জনগণ আশা করে। অধিকাংশ পূর্বাভাস বলে যে কর্মসংস্থানের প্রাক মহামারী পর্যায়ে ফিরে যেতে কিছু সময় নেবে। এমনকি যেসব দেশে অর্থনীতি সবচেয়ে দ্রুত ঘুরে দাঁড়ায় সেখানেও। আমেরিকার গোল্ডম্যান শ্যাকস ব্যাংক মনে করে না যে আমেরিকায় বেকারত্বের হার ২০২৪ সালের আগ পর্যন্ত ৪ শতাংশের নিচে নামবে। মার্কিন অর্থনীতি অধিকাংশ দেশের তুলনায় দ্রুততর গতিতে পুনরুদ্ধার লাভ করবে। সাম্প্রতিক কয়েক দশকে চীন, ইউরোপের সাবেক কমিউনিস্ট দেশসমূহ ও অন্যান্য উদীয়মান বাজারগুলো বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থায় একীভূত হওয়ার ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে লাখ লাখ নতুন শ্রমিকের আগমন ঘটে। এতে ধনী দেশগুলোর শ্রমিকদের দরকষাকষির ক্ষমতা হ্রাস পায়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মজুরি বৃদ্ধি অতীতের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সে অবস্থার এখন পরিবর্তন ঘটতে চলেছে। ধনী দেশগুলোর ও চীনের জনগোষ্ঠীর বয়স বেড়ে চলায় শ্রমিক পিছু নির্ভরশীল ব্যক্তিদের সংখ্যা বাড়বে। এতে পরিচর্যা শিল্পে শ্রমিক ঘাটতি দেখা দেবে। আফ্রিকা ও ভারতে বিপুল সংখ্যক তরুণ আছে। কিন্তু ধনী বিশ্বের রাজনীতির কারণে তাদের দেশে অভিবাসীর আগমনে অন্তরায় আরও বাড়তে পারে। এতে করে ধনী বিশ্বের শ্রমিকরা দরকষাকষির অধিকতর ক্ষমতা অর্জন করবে এবং তার ফলে মুজরি ও দ্রব্যমূল্য বাড়বে। এতে করে মুদ্রাস্ফীতি নতুন করে সৃষ্টি হবে। ব্রেট ওয়েনস নামে এক অর্থনীতিবিদ মনে করেন যে মুদ্রাস্ফীতি আসছে। যদিও এ মুহূতে লকডাউন ও অন্যান্য কারণে অত্যাবশ্যক পণ্য ছাড়া অধিকাংশ পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় মুদ্রাসংকোচন চলছে। তথাপি এ ব্যাপারে ভুল করার কোন কারণ নেই যে মুদ্রাস্ফীতির উপাদান বিরাজ করছে। সবচেয়ে বড় যে কারণটি তা হলো অর্থ সরবরাহ ব্যাপক পরিসরে বেড়ে গেছে। আমেরিকায় ফেডারেল রিজার্ভ কর্তৃক কাগজী নোট ছাপিয়ে কর্পোরেট বন্ড কেনার ফলে মার্চের পর থেকে মুদ্রা সরবরাহ ৩ ট্রিলিয়ন ডলার বেড়ে গেছে। এটাই মুদ্রাস্ফীতি ঘটানোর জন্য ঘথেষ্ট। তবে কি হারে মুদ্রাস্ফীতি ঘটবে সেটা একটা প্রশ্ন। তবে ওয়েনস বলেন, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কোন কারণ নেই। শুধু আমাদের মস্তিষ্কের রাডারে রাখলেই চলবে। মুদ্রাস্ফীতি মোকাবেলায় দু’ভাবে প্রস্তুত হওয়া যায়। একটা হচ্ছে স্বর্ণ কিনে রাখা। মুদ্রাস্ফীতির সময় বা যে কোন সঙ্কটে স্বর্ণ কিনে রাখার রেওয়াজটা দীর্ঘদিনের প্রধান চল এবং সেটা সঙ্গত কারণেই শেয়ার ও বন্ডের দরে ধস নামলে এ দিয়ে সেই সঙ্কটটা মোকাবেলা করা যায়। এ কারণেই স্বর্ণ কেনার হিড়িক পড়েছে এবং এর দাম ২০১১ সালের উচ্চতা ছাড়িয়ে গেছে। স্বর্ণের দাম ফানুসের মতো বেড়ে যাওয়ার ঘটনা চার দশকের মধ্যে কি প্রথমবারের মতো ঘটতে পারে? এখনও পর্যন্ত সে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না বলে ওয়েনস মনে করেন। তিনি বলেন, ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্যের ওপর নিজেদের প্রাধান্য বজায় রাখতে হলে আমাদের শেয়ারের সংখ্যা বা পরিমাণ বাড়াতে হবে। এ থেকে প্রাপ্তি দিয়ে মুদ্রাস্ফীতি মোকাবেলা করা যায়। এতে করে আমাদের আয়ই শুধু বাড়বে না, প্রকারান্তরে শেয়ারের দাম বাড়াতেও সহায়ক হবে। অর্থনীতি যখন ঢিমেতালে বা ধীরগতিতে চলে অর্থাৎ অতি বেকারত্ব থাকে কিংবা উৎপাদন ক্ষমতা অতিমাত্রায় বা বাড়তি মাত্রায় বিদ্যমান থাকে তখন মুদ্রাস্ফীতি হয় না। কারণ বেকার মানুষ অত বেশি খরচ করতে পারে না। করোনা মহামারীর শুরু থেকে ব্যয় ও সঞ্চয়ের প্রতি ভোক্তাদের মনোভাবের আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। ফেব্রুয়ারির পর থেকে আমেরিকায় সঞ্চয়ের হার আকাশচুম্বী হয়ে ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০ শতাংশ হয়েছে। ভোক্তাদের বকেয়া ঋণও ফেব্রুয়ারির পর থেকে প্রায় ৭৫ শতাংশ কমে গেছে। অর্থের হিসেবে যা ১০ হাজার ৬শ’ কোটি ডলারেরও বেশি। অর্থ ব্যবহারের সক্ষমতা হচ্ছে ৬৮ শতাংশ। এর কমে আর নামছে না। উৎপাদকদের পণ্য মূল্য বাড়ানোর তেমন কোন সক্ষমতা নেই। কারণ, অলস সক্ষমতা নিয়ে অন্যরাও আছে যারা পণ্যের চাহিদা থাকলেই প্রতিযোগিতা করার জন্য প্রস্তুত। সাধারণত উৎপাদন ক্ষমতা কাজে লাগানোর সক্ষমতা ৮০ শতাংশে না পৌঁছানো পর্যন্ত মুদ্রাস্ফীতি কোন সমস্যা নয়, পর্যাবেক্ষকদের মতে মুদ্রাস্ফীতির সম্ভাবনা অতিমাত্রায় বিদ্যমান। তবে তা আসন্ন নয় বা অতি শীঘ্র ঘটতে যাচ্ছে না। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×