২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর দিন বদলের সনদে যেদিন ঘোষণা করা হলো ২০২১ সালের মধ্যে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ে তোলা হবে, এই কথা শুনে সেদিন আমরা কী বুঝেছিলাম? নিশ্চয়ই এই রূপকল্পের কোন তাত্ত্বিক কাঠামো সে ঘোষণায় ছিল না বা শেখ হাসিনা কিছু না বুঝেই এই স্বপ্নের কথা তাঁর ভোটের অঙ্গীকারের অংশ করে নেননি। কিন্তু আমরা যারা বহুদিন যাবত তথ্যপ্রযুক্তির সীমাহীন সম্ভাবনার স্বপ্নের জগতে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম তারা ভেবেনিলাম এখন সরকার যদি এ কাজে সত্যি সত্যিই সচল হয় তাহলে আমাদের স্বপ্ন বাস্তবরূপ নেবে, সেখানে আপাতত কোন রূপের কাঠামো থাকুক বা না থাকুক।
যে স্বপ্নের জগতে আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম তা মোটেও অবাস্তব ছিল না। এই স্বপ্ন আমাদের দেখিয়েছেন মোস্তাফা জব্বার সেই আশির দশকে যখন বাংলা হরফে কম্পিউটারে লেখা শুরু করলেন। এর পরে যুক্ত হলেন কম্পিউটার জগতের কাদের ভাই আর অগ্রজ সাংবাদিক নাজিমউদ্দিন মোস্তান। তাঁরা এই স্বপ্নকে কয়েক ধাপ এগিয়ে দিলেন গরিবের জন্য প্রযুক্তির সেবা চেয়ে। তাঁদের এই সৃজনশীল অনুপ্রেরণায় আমরা ভাবতাম এই দেশের সবাই একদিন ডিজিটাল প্রযুক্তির সেবা পাবে। আমরা ভাবতে শুরু করলাম কেউ যদি কম্পিউটার নাও কিনতে পারে সে অবশ্যই কম্পিউটার কী কী কাজ করে বুঝতে পারবে ও তার ছেলেমেয়েদের কাছে গল্প করতে পারবে। একজন দরিদ্র কৃষক বা দিনমজুর পিতা-মাতার পক্ষে সে সময় ৪০-৫০ হাজার টাকা খরচ করে কম্পিউটার কিনে দেয়া অসম্ভব ছিল (এখনও অনেকের পক্ষে তা অবম্ভব)। কিন্তু আমরা যদি গ্রামে গ্রামে এমন ব্যবস্থা করে নিতে পারি যে, সবাই কম্পিউটার দেখতে, ছুঁয়ে দেখতে ও ব্যবহার শিখে নিতে পারবে তাহলে ঘরে ঘরে কম্পিউটার পরিচিত হবে ও একটি প্রজন্ম জীবনের শুরু থেকেই এই প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে অভ্যস্ত হবে। ২০০৮ সালে যে শিশুর বয়স ৫ বছর ২০২১ সালে তার বয়স হবে ১৮ বছর। মাঝখানের এই ১৩ বছরে তাদের পাশাপাশি যাদের বয়স প্রতি বছর ৫ হবে তাদের হালশুমারি হাতে রেখে ক্রমে ক্রমে ১২, ১১, ১০, ৯ করে কমিয়ে এনে ২০২০-২১ সালে আমরা গ্রামের ছেলেমেয়েদের কোথায় পৌঁছে দিতে পারব ভেবে কয়েকটি রাত ঘুমাতে পারিনি। একদিন এসব শুনে মোস্তাফা জব্বার ভাই উৎসাহ দিয়ে আমাকে বলেছিলেন, রাজনৈতিক অঙ্গীকার নিয়েই এই স্বপ্ন বাস্তব করতে হবে। তুমি লেনিনের অফিসে আসো, আমরা সব প্ল্যান ঠিক করে নেই।
আমার রাজনৈতিক জগতের বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র হাসান মাহমুদই শেখ হাসিনার কাছে এসব বার্তা তুলে ধরতেন। ২০০৪ সাল থেকে আমি আর হাসান মাহমুদ কেমন করে তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে গ্রামে গ্রামে কাজ করা যায় তা আলাপ করে আমাদের পরিকল্পনা অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছিলাম। যদিও সেসবই ছিল আমাদের স্বপ্নের অংশ। তাঁর মাধ্যমে আমি নিজেও বেশ কয়েকবার ডাক পেয়ে দারিদ্র্য বিমোচনে তথ্যপ্রযুক্তির সম্ভাবনা নিয়ে সুধাসদনে কথা বলতে গিয়েছি। ব্যাখ্যা করেছি কেমন করে আমাদের ‘এক্সেস’ বাড়াতে হবে, রামপালের উদাহরণ তুলে ধরে বলেছি মানুষ বিষয়টা আগে বুঝতে চায়। শেখ হাসিনা আমাকে বললেন, শুধু ‘এক্সেস’ দিয়ে হবে না, ‘এফরডেবল’ও হতে হবে। আমি আমাদের নিত্যদিনের প্রযুক্তি-কাজের সুপরিচিত এই এফরডেবল’ বা ‘সাশ্রয়ী’ শব্দটি তাঁর মুখে শুনে সেদিন চমকে উঠেছিলাম।
আমাদের অগ্রজ রাজনীতিক, যাকে আদর্শ বলেই জ্ঞান করি নূহ-উল আলম লেনিন ভাইয়ের সঙ্গে এই নিয়ে আলাপ করতাম। শেষতক লেনিন ভাই একটা সেল গঠন করলেন। আমি আর মুনির হাসান মাঠের গল্প আর অভিজ্ঞতা এনে সে সেল গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছি। আমাদের সাধ্যমতো গড়ে তুলেছি ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য রিসোর্স সেন্টার, যেখানে সব পাওয়া যাবে। আমরা উপলব্ধি করলাম চাষী-মজুর থেকে শিক্ষিত-দরিদ্র সবাই সেখানে সমান অংশ নেবে। নতুন নতুন ভাবনা এনে জমাতে হবে আর তা ছড়িয়ে দিতে হবে সারাদেশে। একদিন মাহবুবুল হক শাকিল আমার কাছে জানতে চাইল, ‘ভাই, ডিজিটাল বাংলাদেশে নাকি আপনারা ড্রাইভার-হেলপারদেরও যুক্ত করবেন? ক্যামনে?
আমি বললাম, ডিজিটাল বাংলাদেশ শুধু কি কম্পিউটার? এটা তো রূপকল্প। আপনি এমন এক বাংলাদেশের কল্পনা করেন যেখানে কোন ড্রাইভার বেপরোয়া গাড়ি চালাবে না। কোন হেলপার যাত্রীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করবে না, অন্যায্য ভাড়া নেবে না। গাড়ি, ট্রেন, বাস, লঞ্চ ছাড়বে সব নিয়মমতো। পথে-ঘাটে মানুষের কোন ভোগান্তি থাকবে না। সেই বাংলাদেশে কোন প্রসূতি মাতা যানজট থেকে শেষে পথে সন্তান প্রসব করবে না। কোন ফাইল কোথাও আটকে থাকবে না। আপনার, আমার বাবা বা আমাদের স্কুলের শিক্ষক অবসরে গেলে তাঁর পেনশন পেতে কোন হয়রানি হতে হবে না। ছেলেরা-মেয়েদের স্কুলের সামনে বসে থেকে শিস দেবে না, কারণ সে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সীমাহীন শক্তি সম্পর্কে জেনে গেছে। এখন তার অনেক চিন্তা, তাকে একটা নতুন বাংলাদেশ গড়তে কাজ করতে হচ্ছে। আমার মনে পড়ছে শাকিলের মুখটা, অবাক হয়ে শুনছিল আর বলেছিল, ‘এইটা হবে ভাই, এইটাই তো বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা।’
২০০৯ সালের মে মাসে একদিন মুনির হাসান আমাকে বলল, ‘রেজা ভাই, উনারা ডিজিটাল বাংলাদেশ কী বলে আর আমরা কী বলি, মিলতেছে না।’ জব্বার ভাই তাঁর লেখা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ নামের একটা বই আমাকে দিয়ে বললেন, দেখ তোমাদের চিন্তার সঙ্গে আমার কলমের মিল খুঁজে পাও কি-না। তিনি আমাদের কিছুতেই থামতে দিলেন না। বললেন, যার যে ভাবনা সেটা নিয়েই কাজ করতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ শুধু কম্পিউটার দিয়ে রাতারাতি হবে না, এটা সবাইকে বুঝতে হবে। হাসান মাহমুদ বললেন, আমার গ্রাম রাঙ্গুনিয়ার সুখবিলাসে চলেন আমরা কাজ শুরু করি। দেখবেন আমাদের সব স্বপ্ন আর চিন্তা একদিন মিলেমিশে এক হবে।
আমরা কিছু কাজ করতে শুরু করলাম লেনিন ভাইয়ের গ্রাম মুন্সীগঞ্জের কনকসারে। প্রথম দিন আমাদের সঙ্গে গেলেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল, এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, ডাটাসফটের মাহবুব জামান ভাই আর ওই গ্রামের এক সন্তান ভারতের তৎকালীন হাইকমিশনার পিনাকী রঞ্জন চক্রবর্তী। সেই থেকে আমাদের ভাবনায় ওই কাজে সহায়তা দিল মাইক্রোসফট। বলল, দেখতে চাই কী হয়। শুরু হলো আমাদের মতো করে আমাদের কাজ। আমার কুমিল্লায়, ছাত্র জীবনের বন্ধু অমূল্য বড়ুয়ার বাঁশখালীর শীলকুপে, লেনিন ভাইয়ের কনকসার, হাসান মাহমুদের রাঙ্গুনিয়া, মিহির কান্তি মজুমদারের পিরোজপুরের জুজখোলা, খালেক তালুকদার বললেন খুলনা শহরে একটা করে দেখেন, তাঁর দেয়া পরামর্শে সোনাডাঙ্গা, আমার সহকর্মী দীপকের গ্রাম বাগেরহাটের কচুয়ার দেপাড়া আর রামপাল, শ্রীফলতলা তো আছেই। আমি আর মুনির হাসান এবার নড়েচড়ে বসলাম। চলেন সবাইকে এক সঙ্গে ডাকি আর দেখাই কেমন হতে পারে ডিজিটাল বাংলাদেশ। যেই কথা সেই কাজ, ২-৩ অক্টোবর ২০০১ আমরা আয়োজন করলাম ‘বাগেরহাট হবে ডিজিটাল’- এই শিরোনামে জ্ঞান উৎসব।
ছাত্রছাত্রী, সাধারণ ব্যবসায়ী, কর্মজীবী, খেটে খাওয়া মানুষ সকলেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই উৎসবে অংশ নিয়েছিল। সেখানে জ্ঞান আর বিজ্ঞানের মেলা, গণিতের উৎসব, তথ্যপ্রযুক্তির নানা রকম উদ্ভাবন প্রদর্শন, স্থানীয় সরকার, জনপ্রতিনিধি, সংসদ সদস্য, প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিবর্গ, বিজ্ঞানমন্ত্রী থেকে প্রযুক্তি শিক্ষাবিদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল থেকে শুরু করে মোস্তাফা জব্বারÑ প্রায় শতাধিক জাতীয় পর্যায়ের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ অংশ নেন। বাগেরহাট শহরজুড়ে কয়েকদিন ধরে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার এক প্রত্যয় ছড়িয়ে পড়েছিল। এমনকি এত নামী-দামী অতিথি থাকার ভাল ব্যবস্থা ওই ছোট শহরে নেই বলে বাগেরহাটের অনেক সাধারণ পরিবার তাদের বাড়িতে দূরের মেহমানদের রেখে আতিথেয়তা দিয়েছেন, এমন উদাহরণও তখন তৈরি হয়েছিল।
এই কর্মসূচীতে বাংলাদেশ টেলিসেন্টার নেটওয়ার্ক প্রদর্শন করেছিল গ্রামের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি। সেবার কেন্দ্রগুলো কেমন হবে তার অভিজ্ঞতা ও ডি-নেট শেয়ার করেছিল তাদের পল্লী তথ্য কেন্দ্রের রূপরেখা। আমাদের গ্রাম শেয়ার করেছিল তার জ্ঞান-কেন্দ্রের মাধ্যমে গ্রামের তথ্যভা-ার কেমন করে গ্রামের মানুষের নিজেদের অর্থনৈতিক বা স্বাস্থ্য অবস্থার বিশ্লেষণ তুলে ধরতে পারে তার নানাবিধ নমুনা। বাগেরহাট প্রেসক্লাবের সদস্যরা ডিজিটাল বাংলাদেশে সংবাদকর্মীদের ভূমিকা নিয়ে একটি সেমিনার করে, আর একটি সভা হয় তাদের উদ্যোগ শুধু ‘মোস্তাফা জব্বার’কে নিয়ে, ‘মোস্তাফা জব্বার সন্ধ্যা’, সেখানে স্থানীয় সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও অনেক সাধারণ মানুষ মোস্তাফা জব্বারের সঙ্গে আড্ডা দেন আর তার সারাজীবনের কাজ, বিশেষ করে কম্পিউটারে বাংলা অক্ষরবিন্যাস, বিজয় কীবোর্ড এসব নিয়ে অভিজ্ঞতা জানতে চান।
বাগেরহাটের সেই উৎসবে পুলিশের এসপি ও র্যাবের আঞ্চলিক কর্মকর্তাসহ অংশ নেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। সাধারণ মানুষের কাছে একটি সেমিনারে তাঁরা তুলে ধরেন ডিজিটাল বাংলাদেশে তাঁদের ভূমিকা কী হবে, কেমন করে অপরাধ দমনে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার হবে। জেলা প্রশাসন এই আয়োজনে ব্যাপক সমর্থন দেয় । জেলা প্রশাসক থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ের কর্মকর্তারা এতে অংশ নেন, এমনকি ওই অনুষ্ঠানেই প্রথম বাগেরহাট জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইট উন্মুক্ত করা হয়, যেখানে স্থানীয় ভূমির ডিজিটাল তথ্য প্রকাশিত হয়।
এই সামান্য বর্ণনায় দুইদিনের ব্যাপক কর্মযজ্ঞের বিবরণ তুলে ধরা সম্ভব নয়; কিন্তু এটা নিশ্চয়ই অনুমেয় ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে আমরা তখন কী বুঝেছিলাম। আমরা এটাই বুঝেছিলাম, সেখানে সকল মানুষের অংশগ্রহণ থাকবে, সবাই নিজেদের প্রযুক্তি শিক্ষা ও ব্যবহারে কনফিডেন্টবোধ করবে। আর সে শিক্ষা হবে সমান সুযোগের, সাশ্রয়ী। ডিজিটাল বাংলাদেশ মানে মানুষের সঙ্গে প্রযুক্তির দূরত্ব সৃষ্টি নয়। মিলিয়ন ডলারের স্বপ্ন দেখা নয় বা ঘরের কোণে বসে মোবাইল ফোন আজ ইন্টারনেট নিয়ে প্রাইভেসির নামে যা খুশি করা নয়। এ দেশের মানুষ কী চায়, প্রযুক্তির কোন্ কোন্ সেবা দিয়ে তাদের জীবনযাত্রার মান আরও উন্নত করা যায়, ছেলেমেয়েদের জীবন কেমন করে আরও নিশ্চিত রাখা যায়, স্ত্রীর অসুখ হলে সুচিকিৎসা পাবে, বয়োবৃদ্ধ পিতা-মাতা ঘরে বসে পাবে রিমোর্ট চিকিৎসাসেবা, ট্রেন চলবে কাঁটায় কাঁটায় ডিজিটাল তালে পা রেখে, ডাক্তারের কাছে থাকবে রোগীর সব উপাত্ত, রোগের বিবরণ, শিক্ষক তাঁর ল্যাপটপে এক টোকায় জানবেন তাঁর শিক্ষার্থী গত মাসের তুলনায় এ মাসে কতদূর এগিয়েছে, মুদি দোকানি এক লহমায় দেখে নেবেন তাঁর মালামালের তালিকা, সবজিওয়ালা জানবেন মাঝখানে কেউ তাঁকে ঠকাবে না। কারণ, মহাজনের সব হিসাব ওপরে রাখা আছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে আমরা কিন্তু বুঝেছিলাম মোস্তাফা জব্বারই হবেন তার মন্ত্রী যিনি আশির দশকে আমাদের শিখিয়েছেন কেমন করে কম্পিউটারে বাংলা লেখা যায়। এই মোস্তাফা জব্বার যদি ঠিক সময়ে আমাদের ম্যাকিন্টোস কম্পিউটার না শেখাতেন তাহলে আরামবাগের শত শত কারিগর ফটোশপের দোকান দিয়ে সে আমলে নিজেদের সংসার চালাতে পারত না। তিনি যদি আমাদের নানা রকমের বাংলা হরফ এঁকে না দিতেন আমাদের বাংলা প্রকাশনা কি এত সুনিপুণ হতো? এই বইমেলার দেশে কোথায় থাকতাম আমরা যদি আমাদের দেশের অফসেট প্রকাশনা শিল্প আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে ডিজিটাল না হতো? এই প্রযুক্তিবান্ধব দেশপ্রেমিক মানুষটিকে আমরা সঠিক সময়ে নেতৃত্ব দিতে চিনে নিতে পারিনি কেন?
মোস্তাফা জব্বার যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের হাল ধরেছেন তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। অনেক পূর্ব শর্ত পূরণের কাজ বাকি রয়ে গেছে। এই দেশের মানুষের কাছে এখনও উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট নাগালের বাইরে। নানা রকম ইংরেজী নামের প্রজেক্টের কাছে ব্রডব্যান্ডকে বন্ধক দিয়ে রাখা হয়েছে। গ্রামে গ্রামে যে ইন্টারনেট এতদিন কূলপ্লাবি হওয়ার কথা সেখানে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট। সাশ্রয়ী হবে কেমন করে? একটা স্মার্টফোন, ইন্টারনেট প্যাকেজ, সঙ্গে কাজের খোঁজ। কাজ পেলে সেই কাজ কি মোবাইল ফোনে করা যাবে? লাগবে কম্পিউটার, মডেম, প্রিন্টার আর নানা রকম অনুষঙ্গ। যন্ত্রপাতির জন্য মোট বিনিয়োগ খরচ যদি ৫০-৬০ হাজার টাকা হয় সেও তো অনেক বেশি। একটা কাজ পেল তো আপ করবে কেমন করে? এই ফোনের ইন্টারনেট তো কানেক্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা ফাঁকি-জুকির মাঝে তার ডাটা শেষ হয়ে যায়। ওই যে গ্রামের ছেলেমেয়েরা নানা চেষ্টায় একটা কাজ যোগাড় করল তার তখন কি হবে? তাকে একটা ভুল প্রতিযোগিতার স্বপ্ন ধরিয়ে দেয়া হলো মোবাইল ফোনের ‘এ্যাপ’ তৈরি নাকি একটা ভাল ‘অপরচুনিটি’- ঘুরে ঘুরে কোথাও সে কোন কূল-কিনারা পাচ্ছে না। এসব অর্থহীন ‘উদ্যোগ’ কি বন্ধ হবে? গ্রামের ছেলেমেয়েরা এখনও দেখছে তথ্যপ্রযুক্তি মানে আলোর চিকমিকি। বাংলা-ইংরেজী মিশেল এক অদ্ভুত উচ্চারণে কথা চলছে ঢাকার বিশাল আলো ঝলমলে মিলনায়তনে। এসব কি ডিজিটাল বাংলাদেশে হওয়ার কথা ছিল?
এখন এই নতুন বাস্তবতায় মোস্তাফা জব্বারের চ্যালেঞ্জ তাঁর সামনের সীমিত কর্মকাল। নির্বাচন যদি ডিসেম্বরে হয় তো হাতে আছে দশ-এগারো মাস। বুঝে-শুনে যদি সব কাজ গুছিয়ে নিতে হয় তাহলেও আমরা বুঝতে পারি তাঁকে অগ্রাধিকার ঠিক করে আর নির্বাচন বিবেচনা রেখেই কাজ করতে হবে। আর এতে ডিজিটাল বাংলাদেশের অনেক কাজই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আমরা জানি যে কাজগুলো ইতোমধ্যে শেষ হয়ে যেতে পারত তার মধ্যে জরুরী ছিল সর্বজনের জন্য উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড সারাদেশে সাশ্রয়ী মূল্যে উন্মুক্ত করা আর ইন্টারনেট বিতরণের জন্য একটি নীতিমালা তৈরি করা। কে কত গতি পাবে, কে কত টাকা দিয়ে কত মাত্রার গতি পাবে আর কি কাজে ইন্টারনেট নেবে- এগুলো জেনে-বুঝে এই ‘বিতরণ নীতি’র কর্মসংযোগ হবে, যা দুর্ভাগ্যবশত এখনও আমাদের হয়নি। এই অল্প সময়ে জানি না মোস্তাফা জব্বার পারবেন কি-না তাঁর ক্রমাগত উচ্চারিত ‘প্রযুক্তি সেবাকে গ্রামবান্ধব’ করার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে। এক যুগ আগে খুলনায় আমাদের গ্রাম আয়োজিত উদ্ভাবনী মেলার উপস্থাপনকালে তিনি বলেছিলেন, ‘গ্রামে গ্রামে যুব শক্তির সংযোগ ঘটিয়ে গ্রামভিত্তিক তথ্যভা-ার তৈরি করা দরকার’, যার কোনই উদ্যোগ গত নয় বছরে নেয়া হয়নি। এখন কি তা সম্ভব হবে?
জব্বার ভাই আমাদের সঙ্গে সকল আন্দোলনে একমত ছিলেন বিটিসিএলের আমলাতান্ত্রিকতা থেকে ইন্টারনেট সেবাকে বের করে আনতে। এখন কি সেটা হবে? সোচ্চার ছিলেন আমাদের দাবির সঙ্গে, আমাদের দেশের জন্য বিদেশ থেকে কিনে আনা ইন্টারনেট যেন দেশের বাজারেই থাকে সে রকম ব্যবস্থা ও উদ্যোগ দেয়ার পক্ষে। তাঁকে দেখতে হবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও অনুশাসনগুলো বুঝতে ও মেনে চলতে আমাদের সরকার এবং মিশনগুলো যেন ঠিক ভূমিকা পালন করে সেটাও।
দেরি হয়ে গেলেও আমরা মোস্তাফা জব্বারের নেতৃত্বে ও কর্মদক্ষতার প্রতি আস্থাশীল। তিনি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ভাষা বোঝেন। তিনি জানেন ডিজিটাল বাংলাদেশ মানে শুধু যন্ত্র নয়, আলো ঝলমলে স্টুডিও সেবা নয়, প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সেবা দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ হলো এই দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের রূপক। আশা করি নানা রকম অনুষ্ঠানের আলোকচ্ছটায় তাঁকে ব্যস্ত রেখে মূল কাজ থেকে তাঁর দৃষ্টি কেউ সরিয়ে রাখতে পারবে না।
লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প
[email protected]