ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ সালাহ্উদ্দিন আহ্মেদ

সুশাসনের পূর্বশর্ত

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ২৬ জানুয়ারি ২০১৭

সুশাসনের পূর্বশর্ত

বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন। বিচারকরা নিরপেক্ষভাবে কাজ করছেন বলে মন্তব্য করে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাবলেছেন, বিচারক বা বিচার বিভাগের ওপর চুল পরিমাণ হস্তক্ষেপও বরদাস্ত করবেন না বিচারকরা। সম্প্রতি মহানগর দায়রা জজ আদালত ভবনে জগন্নাথ-সোহেল স্মৃতি মিলনায়তনে ‘বিচারিক কার্যক্রমের সমন্বয়, সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। আইনজীবীদের আরেকটি অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন, শুধু আইনজীবীর ত্রুটির কারণেই ৬০ থেকে ৭০ ভাগ মামলায় বিচারপ্রার্থীরা হেরে যান। একটি বাড়ি তৈরিতে যেমন কারিগর থাকে। ঠিক একজন আইনজীবীও একটি মামলার কারিগর। তিনি যেভাবে চাইবেন সেভাবেই মামলাটি তৈরি হবে। আইনের শাসনের মধ্যেই নিহিত আইনের প্রয়োগ ও কার্যকারিতা। যে সমাজে আইনের শাসন নেই, সেখানে আইনের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হবেই। আইন মানুষকে যেমন নিয়ন্ত্রণ করে, তেমনই মর্যাদাবান ও পরিশীলিত করে। আইন যেখানে অচল, মানবাধিকার সেখানে ভূলুণ্ঠিত। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মধ্যেই নিহিত রয়েছে সমাজ-সভ্যতার ক্রমবিকাশ। পৃথিবীতে এমন কোন সভ্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে আইনের বিকাশ হয়নি। আমার মতে, আমাদের দেশের প্রচলিত আদালত ব্যবস্থায় দীর্ঘসূত্রতা একটি ভয়ানক ব্যাধি। মামলা নিষ্পত্তিতে সীমাহীন কালক্ষেপণ হওয়াতে অনেক সময় বিচার বিঘিœত হয়। বিচারপ্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা বিচারকে অগ্রাহ্য করারই নামান্তর। আমাদের দেশের ফৌজদারি ব্যবস্থায় গুরুতর অপরাধগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সরকার ২০০২ সালে দুটি বিশেষ আইন প্রণয়ন করে। এর একটি ‘আইনশৃঙ্খলা বিঘœকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) আইন’ অপরটি ‘দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইন’। ফৌজদারি বিচার ত্বরান্বিত করতে দুটি আইন একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। এ ছাড়া দেশে ১ হাজার চার শ’ আইন প্রণীত হয়ে জনসেবার পরিবর্তে জননিষ্পেষণে ভূমিকা রাখছে। ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ৩৪০(১) ধারায় বলা হয়েছে, অভিযুক্ত ব্যক্তি অসচ্ছল হলে রাষ্ট্র তার আইনজীবীর খরচ বহন করবে। ১৯০৮ সালের দেওয়ানি কার্যবিধি আইনের ৩২নং অর্ডারে, দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রেও অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি অসচ্ছল হয়, তবে সে আইনী সহায়তা পাবে। আর্থিকভাবে অসচ্ছল, দরিদ্র ও অসহায়দের আইনগত সহায়তা দেয়ার জন্য সরকার ২০০০ সালে আইনগত সহায়তা প্রদান আইন প্রণয়ন করেছে। দেওয়ানি ও ফৌজদারি মিলে ১৭ লাখ ১২ হাজার ৪৬ মামলার ভারে ন্যুব্জ বিচারব্যবস্থা। মামলা সংক্রান্ত জটিলতা কমাতে চলমান ‘গ্রাম আদালত’ আরও শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে। এক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা গ্রাম আদালতের বিচারক হিসাবে নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও মেম্বারগণের শিক্ষা, বিচার ও আইনের প্রতি জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ। গ্রাম আদালত গঠন এখতিয়ার, ক্ষমতা, দায়িত্ব ও এর সুফল সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করলে এবং যথাসময়ে গ্রাম আদালত কার্যকর হলে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিদ্যমান আদালতগুলোতে মামলার জট অনেক কমে যাবে। এক্ষেত্রে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশে আইন পেশায় প্রতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণবিহীন চেয়ারম্যান মেম্বারদের মাধ্যমে গ্রাম আদালত পরিচালনা দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে না। আমাদের ভিশন নির্ধারণ করতে হবে ২০২১ সালের মধ্যে প্রতিটি ইউনিয়নে ১০Ñ১৫ জন ডিপ্লোমা আইন প্রযুক্তিবিদ পৌঁছানো। একাধিক আইন শাস্ত্রে প্রশিক্ষিত ডিপ্লোমাধারী আইনবিদগণ স্থানীয় নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করবে। মেম্বার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবে। আইনজ্ঞদের পরিচালনায় গ্রাম আদালতে সুশাসন নিশ্চিত হবে। আদালত হচ্ছে সাধারণ জনগণের ন্যায়বিচারপ্রাপ্তির জায়গা। সেখানে ভাষা হবে জনসাধারণের ভাষা, যাতে বিচারপ্রার্থীরা বেশি উপকৃত হন। আদালতে ইংরেজী ভাষা ব্যবহারের ফলে বিচারপ্রার্থীরা তাদের তথ্য জানার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ডিপ্লোমা আইন প্রযুক্তিবিদ এবং উপ-সহকারী জজদের আদালত আঙিনায় সরকারী নির্দেশনার আলোকে বাংলা ভাষা প্রচলন মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। একটি দক্ষ ও ন্যায়পরায়ণ বিচারাঙ্গন সুশাসনের পূর্বশর্ত এবং এর জন্য প্রয়োজন বিচারাঙ্গনের সংস্কার। তা না হলে বাংলাদেশের সামনে যে অমিত সম্ভাবনা রয়েছে সেটি মরীচিকার মতো হারিয়ে যেতে পারে। সাউথ এশিয়ান ল’ ইয়ার্স ফোরাম, ঢাকা থেকে
×