ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

দেড় শ’ বছরের আয়ু সত্যিই কি সম্ভব

প্রকাশিত: ০৪:০১, ২৮ আগস্ট ২০১৬

দেড় শ’ বছরের আয়ু সত্যিই কি সম্ভব

মৃত্যুঞ্জয়ী হওয়ার আকাক্সক্ষা মানুষের সেই কোন্ কালের। এজন্য তার সাধনারও অন্ত ছিল না, যার পরিচয় মেলে পৌরাণিক কাহিনীতে। মানুষ পরে বুঝতে পেরেছে মৃত্যুকে জয় করা যায় না। মৃত্যু অমোঘ। আর আধুনিক বিজ্ঞান যেটা করছে তাহলো মৃত্যুকে বিলম্বিত করার, এড়িয়ে চলার এবং ফাঁকি দেয়ার লড়াই। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সেই লড়াইও জোরদার হয়ে উঠেছে। মৃত্যুকে পিছিয়ে দেয়ার হাজারো কৌশলের মধ্যে চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের সুপারিশ করা একটি কৌশল হলো কম ক্যালরির অথচ পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ। মাইকেল রাইয়ের দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায় যে, তিনি দিনে ১৯শ’ ক্যালরির খাদ্য খান, যা তার জন্য বরাদ্দ থেকে ৬শ’ ক্যালরি কম। প্রাতরাশ সারেন প্রচুর পরিমাণ সালাদ, দই এবং নির্দিষ্ট কিছু উপাদানের তৈরি মাফিক দিয়ে। এতে মোট ক্যালরি হয় এক শ’। এ দিয়ে তাঁর অপরিহার্য পুষ্টির ১০ শতাংশ পূরণ হয়। তার দুপুরের ডায়েট হলো শিমজাতীয় সবজির তরকারি ও আরেকটা মাফিন। ডিনারটা রকমফের হলেও সাধারণত তাতে থাকে মাশরুফ, বেগুন ও আরেকটি সবজি। সেই সঙ্গে ছোট এক গ্লাস রেড ওয়াইন। এই ডায়েট রাই ১৫ বছর ধরে চালিয়ে যাচ্ছেন। সীমিত ক্যালরির খাদ্য গ্রহণ করলে ক্যান্সার ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমে, স্নায়ুর ক্ষয় হ্রাস পায় এবং জীবন দীর্ঘায়িত হয়। ব্লাড প্রেশারও স্বাভাবিক থাকে এবং ধমনীগুলো থাকে সুস্থ। এই রোগগুলো না হতে পারলেই কিন্তু মানুষের আয়ু বেড়ে যায়। বার্ধক্য এমন এক ব্যাপার যা পরিবেশ ও জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে প্রভাবিত বা বিলম্বিত করা যায়। পরিবেশগত পরিবর্তনের একটা হলো এই ক্যালরি সীমিতকরণ। আর জিনগত পরিবর্তন হচ্ছে বার্ধক্যের জন্য দায়ী জিনগুলোতে এবং সেইসঙ্গে বিপাক ক্রিয়ার পথগুলোতে ওষুধের মাধ্যমে পরিবর্তন ঘটানো। তাহলেই মানুষের দীর্ঘতর ও অধিকতর সুস্থ জীবনের অধিকারী হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। কিন্তু এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, হৃদরোগ সম্পূর্ণ নির্মূল করা হলে আমেরিকায় সার্বিক আয়ু মাত্র ৫.৫ বছর এবং ক্যান্সারে মৃত্যু রোধ করা গেলে মাত্র ৩.২ বছর যোগ হবে। মানুষের বয়স যত বাড়তে থাকে তাদের মেরে ফেলার জন্য রোগ-ব্যাধির নিজেদের মধ্যেও প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। একটি রোগ তাকে মারতে না পারলে অন্য রোগ মারবেই। সুতরাং মানুষের আয়ু ৯৫ বছর ছাড়িয়ে আরও অনেক দীর্ঘায়িত করতে হলে বার্ধক্য বা মৃত্যুর জন্য দায়ী শুধু একটি কারণকে নয়, অনেকগুলো কারণকে একসঙ্গে ঠেকিয়ে রাখতে হবে। কিছু রোগ-ব্যাধি আছে যেগুলোতে আক্রান্ত না হলে কিংবা আক্রান্ত হওয়া বিলম্বিত করা গেলে বুড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে যেসব অক্ষমতা দেখা দেয় সেগুলোও কতকাংশে হ্রাস করা যেতে পারে। তাছাড়া বার্ধক্য প্রতিরোধক কিছু কিছু ওষুধও আবিস্কার ও চালু হয়েছে। এগুলোর কার্যকারিতা এখনও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়ে আছে। কিন্তু কিছু ওষুধ আছে যেগুলো অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হলেও কার্যক্ষেত্রে দেখা গেছে সেগুলো বার্ধক্য প্রতিরোধ বা বিলম্বিত করতে ব্যাপক প্রভাব রাখে। যেমন ডায়াবেটিস চিকিৎসার জন্য বহুল ব্যবহৃত ও দারুণ সহনীয় একটি ওষুধ হলো মেটফরমিন। আরেকটি ওষুধ আছে রাপামাইসিন, যা অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে শরীরে অন্যের অঙ্গ প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ঝুঁকি হ্রাসের জন্য দেয়া হয়। কিছু গবেষকের কাছে মনে হয়েছে এই দুটো ওষুধেরই বার্ধক্য প্রতিরোধ বা বিলম্বিত করার দারুণ গুণ বা ক্ষমতা রয়েছে। ২০১৪ সালে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ৯০ হাজার বয়স্ক রোগীর ওপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে মেটফরমিন নেয়া রোগীদের বেঁচে থাকার হার মেটফরমিন না নেয়াদের চেয়ে বেশি। আরেক সমীক্ষায় দেখা যায় মেটফরমিন নেয়ার ফলে ক্যান্সারের ঝুঁকিও হ্রাস পায়। মেটফরমিন অন্যান্য রোগ-ব্যাধির আক্রমণ, এমনকি মৃত্যুও বিলম্বিত করে কিনা দেখার জন্য বয়স্কদের ওপর আরেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। তাতে ইতিবাচক ফল পাওয়া গেলে বহুলাংশে এই সত্যই প্রতিষ্ঠিত হবে যে, বুড়িয়ে যাওয়ার এক অভিন্ন সাধারণ প্রক্রিয়া আছে, যা ওষুধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। জিনগত রূপান্তর বা বিপাক ক্রিয়ায় পরিবর্তন এনেও বার্ধক্য বিলম্বিত করা যেতে পারে এবং সে চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। গত ২০ বছর ধরে এটা জানা আছে যে, গোলকৃমির জিন ডিএএফ-২ বদলে দেয়ার ফলে তাদের বয়স বাড়ার গতি মন্থর হয়ে গেছে এবং আয়ুও বেড়ে গেছে দ্বিগুণ। মানবদেহে সমধর্মী জিনগুলো দেহকোষের গাত্রে ইনসুলিন এবং ইনসুলিনের মতো গ্রোথ হরমোন গ্রহণ করার দায়িত্বে থাকে সেগুলোর গুরুত্বপূর্ণ বিপাক ক্রিয়াগত ভূমিকা আছে। ক্যালরি নিয়ন্ত্রণ করা হলে এই জিনগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। ক্যালরি নিয়ন্ত্রণের একটা ফল হলো এই যে, এটি ‘এমটিওআর’ নামের একটি প্রোটিনকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়া। সেই প্রোটিনের কাজ হলো গ্রোথ হরমোনগুলো থেকে সিগন্যাল দেহকোষের সেসব অংশে বয়ে নিয়ে যাওয়া যেগুলো প্রোটিন সংশ্লেষণের কাজে যুক্ত। কোষের বিপাক ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ, কোষ বিভাজন ও বৃদ্ধির কাজে এই প্রোটিন ভূমিকা পালন করে থাকে এবং ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলোকে ভেঙ্গে যাওয়া রোধ করে। খাবার প্রচুর খেলে ‘এমটিওআর’ কোষ বিভাজন ও বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে উদ্দীপ্ত করে থাকে। এখানেই মেটফরমিন ও রাপামাইসিনের ভূমিকা নতুন করে আসে। মেটফরমিন বেশ কিছু হরমোন রিসেপটরের ওপরও কাজ করে, যেগুলো আবার ক্যালরি নিয়ন্ত্রণের দ্বারাও প্রভাবিত হয়। অন্যদিকে রাপামাইসিন ‘এমটিওআর’ প্রোটিনের ওপর কাজ করে। দেখা গেছে ‘এমটিওআর’ প্রোটিনের কাজ কমিয়ে দেয়া হলে ঈস্ট, কৃমি ও মাছির আয়ু বেড়ে যায়। ২০০৯ সালে বেশকিছু গবেষণাগারের পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, রাপামাইসিন মধ্য বয়সী ইঁদুরের আয়ু ১৪ শতাংশ বাড়িয়ে দিতে পেরেছে। এই তথ্যটুকু জেনে কেউ যদি নিজের আয়ু বাড়ানোর জন্য রাপামাইসিন সেবন শুরু করে দেয় সেটা মোটেও সমর্থনযোগ্য হবে না। এতে বিপর্যয় ঘটতে পারে। নিজ থেকে এ জাতীয় ওষুধ সেবন নিরাপদ করতে হলে বায়োমেডিসিন সম্পর্কে প্রচুর জ্ঞান থাকা দরকার। এমন ওষুধের গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। রাপামাইসিন দিয়ে চিকিৎসা করা ইঁদুরের শরীরে ইনসুলিন রেজিস্টেন্স গড়ে উঠেছে। তাছাড়া এর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাও দুর্বল হয়ে পড়েছে। শরীরে প্রতিস্থাপন করা অঙ্গ প্রত্যাখ্যান রোধ করার কাজে এ ওষুধটি বেশ ভাল এবং এটাই তার আসল কাজ। কিন্তু সুস্থ মানুষের শরীরের বেলায় এটা তেমন ভাল নয়। অবশ্য অন্যান্য ওষুধও আছে যেগুলো আয়ু বাড়াতে পারবে বলে মনে করা হচ্ছে অথচ এদের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম। তেমন একটি ওষুধ হলো রেসভেরাট্রল। আয়ু বৃদ্ধির কৌশল নিয়ে যারা গবেষণায় নিয়োজিত তাদের মধ্যে এই ওষুধটি দারুণ উত্তেজনা ও আলোড়নের সঞ্চার ঘটায়। সেটা বছর কয়েক আগের কথা। তেল, মসলা ও চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়ানো ইঁদুরগুলো এই ওষুধের বদৌলতে তারুণ্যদীপ্ত ছিল। তবে প্রথমদিকে এই ওষুধ নিয়ে প্রচুর আগ্রহের ও উৎসাহের সঞ্চার ঘটলেও অচিরেই সেই উৎসাহে ভাটা পড়ে যখন জানা গেল অতি ওজনের নয় এমন ইঁদুরগুলোর বেলায় এই ওষুধ তেমন কাজে আসে না। অবশ্য আলঝেইমারের চিকিৎসা হিসেবে এই ওষুধ নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে। কেউ কেউ রেসভেরাট্রলকে ডার্টি ড্রাগ নামেও আখ্যায়িত করে থাকে। কারণ, এর বেশকিছু টার্গেট আছে যেগুলোর বাস দেহকোষের অভ্যন্তরে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে এক সেট প্রোটিন, যা সারটুইন নামে পরিচিত। এগুলো রেসভেরাট্রলে ক্রিয়াশীল হয়ে উঠতে দেখা গেছে। সারটুইন মেটাবলিক সেন্সর হিসেবে কাজ করতে পারে। বেশ কিছু সারটুইন শুধু মিটোকন্ড্রিয়ায় দেখতে পাওয়া গেছে। মিটোকন্ড্রিয়া হলো সেল বা কোষের কাঠামো বিশেষ, যা শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজটা দেখাশোনা করে। তাছাড়া কোষের বয়স বাড়ার ক্ষেত্রেও এর এক মুখ্য ভূমিকা আছে। বুড়িয়ে যাওয়া কোষগুলোর বৈশিষ্ট্যই হলো এর মিটোকন্ড্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ও ভেঙ্গে যাওয়া কোষ রিসাইক্লিং করতে বেশ অসুবিধাই হয়। মিটোকন্ড্র্রিয়া থেকে সাইটোকিন নামে এক জাতীয় প্রদাহ সৃষ্টিকারী পদার্থ তৈরি হয়, যা আশপাশের কোষগুলোকে সেনিসেন্স বা জরার দিকে নিয়ে যায়। এক পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, কোষ থেকে মিটোকন্ড্র্রিয়া সরিয়ে নেয়া হলে সেই কোষগুলোকে নবীন কোষের মতো দেখতে লাগা শুরু হয় এবং সেগুলো সাইটোকিন ক্ষরণ বন্ধ করে দেয়। অন্য এক পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, মিটোকন্ড্র্রিয়া মেরে ফেলা হলে সেই জাতীয় ওষুধের কিছু ফলের অনুকরণ ঘটে, যা মিটোকন্ড্র্রিয়া নবায়নের কাজকে সক্রিয় করে তোলে। তেমনি একটি ওষুধ হলো রাপামাইসিন। কোষ ও অণুজীবের ক্ষেত্রে এ জাতীয় আবিষ্কারের ফলে আয়ু বাড়িয়ে তোলার ব্যাপারে বাণিজ্যিক আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। জার্মানির স্টুটগার্টে ডাঃ জাভোবনকভের ইনসিলিকন মেডিসিন নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে। সেখানে তরুণ ও বৃদ্ধদের টিস্যুর মধ্যকার পার্থক্য নির্ণয় এবং মানুষের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জিন অভিব্যক্তির প্যাটার্নগুলোর কিভাবে বিবর্তন ঘটে দেখার জন্য মেশিনের সাহায্যে জেনোমোর ওপর বিপুল পরিমাণ ডাটা ঘেঁটে বেড়াচ্ছে। তারপর যেসব মলিকুল জিনের প্রভাব ঠেকাতে পারবে বলে মনে হয় সেগুলোর জন্য ওষুধের ডাটাবেস সন্ধান করে চলেছে। জিন সিকোয়েন্সিংয়ের অন্যতম অগ্রদূত ক্রেইগ ভেন্টার ২০০৩ সালে সান ডিয়োগোয় হিউম্যান লনজিভিটি ইনকর্পোরেটেড (এইচএলআই) নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠানটি বিপুল জেনোম ডাটা সংগ্রহ ও উৎপাদন করে শারীরিক বৈশিষ্ট্য এবং চেহারার সঙ্গে মিলিয়ে দেখছে। ডা. ভেন্টার আশা করেন যে, কোম্পানির পক্ষে দীর্ঘায়ু হওয়ার জিনগত সূত্র উন্মোচন করা এবং মানুষ কতদিন বাঁচবে তার ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারা সম্ভব হবে। প্রতিষ্ঠানটির গবেষণায় ইতোমধ্যে দেখা গেছে যে, বুড়োদের মধ্যে কিছু জিনেটিক ভ্যারিয়েশন অনুপস্থিত। তার অর্থ হয়ত এই যে, জিনগুলো হ্রস্বতর আয়ুর সঙ্গে যুক্ত। কোম্পানিটি শেষ পর্যন্ত ওষুধ ব্যবসায় চলে যেতে পারে। কারণ দুটো কোম্পানি ওষুধ আবিষ্কারের ব্যাপারে ইতোমধ্যে এইচএলআইএর সঙ্গে একটা সহযোগিতা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। ২০১৩ সালে গুগল ক্যালিফোর্নিয়া লাইফ কোম্পানি (ক্যালিকো) চালু করে, যার লক্ষ্য বার্ধক্য প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা। আমাদের শরীরে সর্বক্ষণ কোষের ক্ষয় ও ধ্বংস এবং পাশাপাশি নতুন কোষের জন্ম ঘটে চলেছে। ডিজেনারেশন বা ক্ষয় থেকেই নতুন করে সৃষ্টির বা রিজেনারেশনের ধারণাটি আসে। ডায়েট বা ওষুধের সাহায্যে বুড়িয়ে যাওয়া মন্থর করার অতি উৎসাহী সমর্থকরা স্বীকার করেন যে, এতে মৃত্যুকে যে ঠেকানো যাবে তার কোন কথা নেই। মৃত্যু যে কোন সময় হতে পারে। আর ডায়েট ও ওষুধ দিয়ে বার্ধক্য মন্থর করা গেলেও স্বাভাবিকভাবে যেসব মানুষ সবচেয়ে মন্থর গতিতে বুড়িয়ে যায় তাদের গতিতেই সেই বার্ধক্য আসবে। তার ফলে মানুষের আয়ু ১২০ বছর ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী এটাই হলো মানুষের আয়ুর স্বাভাবিক সর্বোচ্চ সীমা। চিকিৎসা, ওষুধপত্র ও অন্যান্য ব্যবস্থার উন্নতির ফলে আজ সারাবিশ্বে ৯০ ও ১০০-এর কোঠায় মানুষের সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক বেশি বেড়েছে সত্য। তবে ১৩০-এর কোঠায় মানুষের সংখ্যা সেই শূন্যতেই থেকে গেছে। এর আর নড়চড় হচ্ছে না। তাই যদি হয় তাহলে মানুষকে দীর্ঘায়ু করার দেড় শ’-দু’শ’ বছর বাঁচিয়ে রাখার যে স্বপ্ন দেখা হচ্ছে তার কি হবে? এখানেই আসে স্টেমসেলের প্রশ্ন। কারণ স্টেমসেল ক্ষয়ে যাওয়া টিস্যু মেরামত ও পুনরুৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অন্য জায়গার স্টেমসেল দিয়ে যে কোন অঙ্গ বা দেহযন্ত্র বা শরীরের যে কোন ক্ষয়প্রাপ্ত স্থান পুনরুৎপাদন করে পুষিয়ে দেয়া যাবে। স্টেমসেল দিয়ে সেল বদলে ফেলা যাবে। স্টেমসেল শরীরের যে কোন স্থান থেকে, এমনকি প্লাসেন্টার হিমায়িত নমুনা থেকেও নেয়া যেতে পারে। স্টেমসেল দিয়ে কোষ বা টিস্যু পুনরুৎপাদনের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার ফলে আজ রিজেনারেটিভ মেডিসিন তৈরির ক্লিনিক্যাল ট্রামালও শুরু হয়ে গেছে। ক্যালিকো ও এইচএলআই উভয়েই এক্ষেত্রে সক্রিয়। স্টেমসেলের এই কার্যকর ভূমিকার এখানে একটা দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে। পার্কিনসন রোগীদের শরীরে ডোপামিন ক্ষরণ হয় না। মানবভ্রƒণের স্টেমসেল থেকে জন্মানো নার্ভসেল পার্কিনসন জাতীয় রোগের আক্রান্ত ইঁদুরের শরীরে স্থাপন করে দেখা গেছে যে, নার্ভ সেলগুলোর সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সেগুলো থেকে ডোপামিন ক্ষরিত হচ্ছে। ক্যামব্র্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের রজার বেকার সম্প্রতি এই পদ্ধতিতে জনৈক ব্যক্তির পার্কিনসন রোগের সফল চিকিৎসা করেছেন। স্টেমসেল কাজে লাগিয়ে স্ট্রোকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীকে সারিয়ে তোলা সম্ভব। স্টেমসেল এভাবে রোগ সারানোর এবং মানুষকে দীর্ঘায়ু করার অপার সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছে। তবে এমন চিকিৎসার অনিয়ন্ত্রিত ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও সারাবিশ্বে শত শত ক্লিনিক গড়ে উঠেছে, যেগুলো বার্ধক্যজনিত রোগ-ব্যাধি চিকিৎসার অফার দিচ্ছে। অল্প বয়সী প্রাণীদের শরীরের রক্ত বয়স্ক প্রাণীদের শরীরে পরিসঞ্চালন করে তাদের নবযৌবন লাভের লক্ষণ দেখা গেছে। ক্যালিফোর্নিয়ার কিছু আলঝেইমার রোগীর শরীরে তরুণের রক্তের প্লাজমা দিয়ে চিকিৎসার চেষ্টা চলছে। যারা বলছেন তারা রোগ সারাতে আশাবাদী। জিন ক্লামেন্ট নামে এক ফরাসী মহিলা ১৯৯৭ সালে ১২২ বছর বয়সে মারা যান। মানুষকে দীর্ঘায়ু করার এত যে সাধনা চলছে তাতে ক্লামেন্টের সেই রেকর্ডটি এখনও অক্ষুণœ রয়ে গেছে। কেউ সেটি ভঙ্গ করতে পারেনি। তবে বায়ো প্রযুক্তি, জিন প্রযুক্তি ও অন্যান্য চিকিৎসার যেরূপ অগ্রগতি ঘটে চলেছে এবং এ পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে যতটুকু সাফল্য এসেছে তার ভিত্তিতে বলা যায় এই রেকর্ড ভাংতে বেশি সময় লাগবে না। আগামীতে মানুষের আয়ু বেড়ে যাবে। মানুষ গড়ে এক শ’ বছর, দেড় শ’ বছর বাঁচবে। এমনকি তার বেশিও বাঁচতে পারে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×