ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

বার্ধক্য জয় যেভাবে বদলে দেবে জীবন

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ১৯ আগস্ট ২০১৬

বার্ধক্য জয় যেভাবে বদলে দেবে জীবন

বিজ্ঞানের মহিমায় এক অপার সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত আমাদের সামনে। জরা, রোগব্যাধি দিনকে দিন জয় করে চলেছে বিজ্ঞান। বার্ধক্য না বুড়িয়ে যাওয়া সেটাও আজ মন্থর বা বিলম্বিত করার উপায় বিজ্ঞানের করায়ত্ত হওয়ার পথে। আমাদের সামনে এখন এমন এক ভবিষ্যত উঁকি দিচ্ছে যেখানে আপনার নিজস্ব দেহকোষ থেকে তৈরি করে নেয়া যাবে নতুন হৃৎপি-, নতুন লিভার, নতুন কিডনি। আপনার এসব অকেজো দেহযন্ত্রগুলোকে বদলে একেবারে নতুন করে ফেলা যাবে। হাঁটু কিংবা হিপ রিপ্লেসমেন্ট যেমন আজ নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে ওইসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বদলে ফেলার ব্যাপারটাও হবে তেমনি। তখন যদি আপনি স্কুল জীবনের বন্ধুদের সঙ্গে ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগিতায় নেমে আপনার ৯৪তম জন্মদিন পালন করেন তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তেমন একটা পর্যায়ে বার্ধক্যকে জয় করবে মানুষ। অমরত্ব না পেলেও তারা দীর্ঘায়ু হতে পারবে। সেই দুনিয়ার আগমন কবে হবে কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। তবে যেভাবে একটু আধটু করে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে তাতে এটুকু বলা যায় এর আগমন কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। ইংরেজীতে সেনিসেন্স বলে একটা শব্দ আছে। বাংলায় বলা যেতে পারে জরা। অর্থাৎ শরীরের শক্তি, বল, বীর্য, ক্ষিপ্রতা কমে আসতে থাকা। সময় যত বয়ে চলে, আমাদের বয়স তত বাড়ে আর ততই এসব ক্ষমতা হ্রাস পায়। কেন ও কিভাবে হ্রাস পায় চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও জীববিজ্ঞানীরা সে রহস্য ভেদ করার জন্য অক্লান্ত সাধনা করে চলেছেন। এই শক্তি ও ক্ষমতা লোপের প্রক্রিয়াটা আপাতত ঠেকিয়ে রাখার কোন কৌশল এখনও বের হয়নি বটে। তবে বিলম্বিত বা মন্থর করার উপায় সম্ভবত বেরিয়েছে। গত এক শতাব্দীতে মানুষের গড় আয়ু প্রভূতরূপে বেড়েছে। তবে সেটা হয়েছে উন্নততর খাদ্য, আবাসন, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও কিছু কিছু ওষুধপত্রের বদৌলতে। এখন নতুন করে যে আয়ু বাড়বে সেটা হবে জরা প্রতিরোধী সুনির্দিষ্ট কিছু ওষুধের কল্যাণে। সেই ওষুধগুলোর দু’একটা ইতোমধ্যে এসে গেছে। আশাবাদীরা মনে করেন, এর ফলে অনেক মানুষেরই আয়ু ১২০ বছর বা তারও বেশি হবে। তবে সেটা তো হবে সবে শুরু। পরবর্তী পর্যায়ে শুধু গড় আয়ু নয়, সিংহভাগ মানুষের আয়ু বেড়ে যাবে। তখন শরীরের কোন অঙ্গ জরাজীর্ণ হয়ে হাল ছেড়ে দিলে সেটাকে মেরামত করা কিংবা একেবারেই বদলে দেয়া যাবে। দীর্ঘায়ু হওয়ার জন্য ডিএনএকে সর্বোচ্চ মাত্রায় কাজে লাগানো হবে। এর সঙ্গে জরা প্রতিরোধী ওষুধ যোগ করা হলে শতবর্ষী হওয়া নিতান্তই মামুলি ব্যাপারে পরিণত হবে। মানুষকে দীর্ঘায়ু করার লক্ষ্যে বিজ্ঞানী মহলের অনেকে রীতিমতো দোকান খুলে বসছেন। তাদের কেউ কেউ স্টেম সেলকে কাজে লাগিয়ে জরাজীর্ণ টিস্যুকে উন্নততর অবস্থায় আনতে চান। একে বলা হয় বায়ো-রিনোভেশন। এই বায়ো-রিনোভেশন এমন এক চিকিৎসার ভিত্তি যা কোন কোন মহলে চালু হলেও এখনও পর্যন্ত এর শতভাগ সাফল্য প্রমাণিত হয়নি। যেমন বুড়ো মানুষের দেহে তরুণের রক্ত পরিসঞ্চালন। ব্যাপারটা কতকাংশে ভ্যাম্পায়ারের কাহিনীর মতো শোনাবে। দেহের অঙ্গ তৈরির কারবারও এগিয়ে চলেছে। এ মুহূর্তে এসব ‘অর্গানয়েভ’ ছোটখাটো পর্যায়ের, অসম্পূর্ণ বা ত্রুটিপূর্ণ এবং এগুলো মূলত ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্যই ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এ অবস্থার নিশ্চয়ই পরিবর্তন ঘটবে। আমরা জানি যে, কিছু কিছু পরিবারের মানুষ দীর্ঘায়ু হয়। তা থেকে বোঝা যায় যে নির্দিষ্ট কয়েক ধরনের জিন জীবনকে দীর্ঘায়িত করে। এ নিয়ে কেউ কেউ অনুসন্ধানমূলক গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে এবং সেটা করছে এই ভাবনা থেকে যে জিন-এডিটিং বা বংশগতি সম্পাদনার আধুনিক কৌশলগুলো হয়ত একদিন কাজে লাগিয়ে আয়ু বৃদ্ধির অতি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো সেইসব মানুষের ডিএনএতে স্থানান্তর করা যাবে যাদের তা প্রয়োজন। ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এসব কিছুই অতিমাত্রায় কাক্সিক্ষত বলে মনে হবে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে সমাজের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে বলতে হয় যে সমাজের ওপর এসব কিছুর সুগভীর প্রভাব এসে পড়বে। বেশিরভাগ প্রভাব ভাল বা কল্যাণমূলক হবে বটে তবে সবই যে অমন হবে তা নয়। যেমন একটি ভাবনা হলো, মানুষ দীর্ঘায়ু হলে প্রচলিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাবলী বাড়বে বৈ কমবে না। সবচেয়ে আশু চ্যালেঞ্জটা হবে জরা প্রতিরোধী চিকিৎসার সুযোগ লাভ করতে দেয়া। দীর্ঘায়ু হওয়ার চিকিৎসাটা যদি ব্যয়বহুল হয় তাহলে প্রথমে কে সেই সুযোগ লাভ করবে? নিশ্চয়ই যার পয়সা আছেÑ অর্থাৎ যে বড় লোক সে নেবে। ইতোমধ্যেই দেখা গেছে যে, আয় আয়ু নির্ধারণের অন্যতম শর্ত। যার আয় বেশি তার আয়ুও বেশি। আয়ু বৃদ্ধির চিকিৎসা যদি গরিবের আয়ত্তের অসাধ্য হয়, তাহলে এই চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যবধান বাড়বে। তাতে করে সমাজে বিভাজন গভীরতর হবে এবং গণতন্ত্র চাপের মুখে পড়বে। বয়স্ক কর্মীদের প্রতি কি বৈষম্য করা হবে যেমনটি এখন হচ্ছে? নাকি সংখ্যার জোরে তারা তরুণদের ওপর দাপট দেখিয়ে বেড়াবে? কর্তাব্যক্তিরা কি নিজেদের পদ আঁকড়ে থাকবে এবং অধীনস্থদের ক্যারিয়ার সমস্যা সঙ্কুল করে তুলবে? নাকি তারা ক্লান্তিকর একঘেয়েমিতে বিরক্ত হয়ে চাকরি ছেড়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু করবে? আর যাদেরকে বয়স্ক বলা হচ্ছে তারা সবাই কি নিজেদের বয়স্ক ভাবা বাদ দিয়ে তরুণের মতো প্রাণবন্ত ও বলিষ্ঠ শারীরিক ও মানসিক মনোভাবের পরিচয় দেবে, নাকি বয়স্ক হওয়ার কারণে সমাজকে আরও রক্ষণশীল করে তুলবে? গবেষকরা আশা করেন যে, বয়স্কদের রক্ষণশীলতা ও গোঁড়ামি কমে যাবে। তাদের এমন আশা করার একটা কারণ হলো জীবনটাই তখন অন্য রূপ ধারণ করবে। নতুন সূচনার একটা সিরিজ চলতে থাকবে। মধ্য জীবনের সঙ্কটগুলো তখন হারানো যৌবন ফিরে পাওয়া নিয়ে অত বেশি কেন্দ্রীভূত থাকবে নাÑ যত বেশি থাকবে আগামী অর্ধশতাব্দী সময়টা থেকে সবচেয়ে ভাল কিছু কিভাবে চয়ন করে নেয়া যায় তা নিয়ে। বেশিরভাগ মানুষ অবসরে যাওয়ার কথা ভাববে না। সে ভাবনাটা হবে তাদের জন্য অধিকতর দূরের বিষয়। কারণ তাদের আয়ু বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে অবসরে যাওয়ার পরও জীবনের যে দীর্ঘ অবশিষ্ট সময়টা পড়ে থাকবে সেটি নির্বাহের জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন হবে। পঞ্চাশের কোঠায় বয়স থাকাকালেও লোকে স্কুলে ফিরে যেতে পারে সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু কিভাবে করতে হয় তা শিখবার জন্য। যিনি কায়িক শ্রম দিয়েছেন তার নিশ্চয়ই বিশ্রামের প্রয়োজন হবে। তিনি আর অন্য পেশায় নাও যেতে পারেন। কিন্তু যিনি এ্যাকাউন্টেন্ট তিনি নতুন করে লেখাপড়া করে ডাক্তার বনে যেতে পারেন। তেমনি আইনজীবী হয়ে যেতে পারেন সাহায্য সংস্থার কর্মী। কেউ কেউ হয়ত দুই ক্যারিয়ারের মাঝখানে দীর্ঘ সময় বিরতি নেবেন এবং ফুর্তি-ফার্তি করে কাটাবেন। কারণ, তারা জানেন যে শরীরের কোন মেরামতির দরকার হলে ওষুধ বা চিকিৎসা তো রয়েছেই। একঘেয়েমি এবং তা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বৈচিত্র্যের প্রয়োজনীয়তা পারিবারিক জীবনও পাল্টে দেবে। বিশের কোঠায় বয়স থাকতে দাম্পত্য জীবনে জুটি বাঁধা নর-নারী ৮০ বছর পরও একই জুটিতে আবদ্ধ থাকার প্রত্যাশা নিয়ে থাকবেন এমন মানুষের সংখ্যা বাড়বে না কমবে? সে প্রশ্নের জবাবে বলা যায় যে এক সঙ্গী বা সঙ্গিনী নিয়ে সারা জীবন কাটিয়ে দেয়া নর-নারীর সংখ্যা ইতোমধ্যে কমে এসেছে। আগামীতে তা বিরল হয়ে দাঁড়াতে পারে। সে জায়গায় দেখা দেবে কয়েক পর্বের একাধিক দাম্পত্য সম্পর্ক। প্রতিটি পর্ব এত দীর্ঘায়িত হবে যে সেটা আজকের বিবেচনায় অনেকের চোখে হবে এক সুখী ও সুন্দর দাম্পত্য জীবন। প্রজননের ক্ষেত্রে পুরুষের শুক্রাশয় সম্ভবত অনির্দিষ্টকাল ধরে সক্রিয় থাকবে। অন্যদিকে মহিলাদের ডিম্বাশয় নির্দিষ্ট সংখ্যক ডিমে পূর্ণ থাকে বলে ধারণা করা হলেও তখন প্রযুক্তির কল্যাণে ওতে নতুন নতুন ডিম্ব সৃষ্টি হতে পারবে। তার ফলে যারা চাইবেন তারা কয়েক দশক ধরে সন্তান উৎপাদন করে যেতে পারবেন। এই কারণে এবং নর ও নারীরা দীর্ঘস্থায়ী একেকটি পর্বে একেক জনের সঙ্গে জুটি বাঁধার ফলে কার সঙ্গে কার কি সম্পর্ক বা আত্মীয়তা সেই হদিস রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। পরিবারগুলোকে দেখা দিতে লাগবে গোলকধাঁধা সুলভ নেটওয়ার্কের মতো। দাম্পত্য জীবন যেখানে চিরস্থায়ী নয় সেখানে সর্বত্রই মহিলারা অবাধে ডিভোর্স দিয়ে বসবে এবং বয়স্ক পুরুষরা শেষপর্যন্ত নিজেদের দাপট হারিয়ে ফেলবে। এ ধরনের জল্পনাটা মজার এবং কৌতুকের তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে এটা আশাবাদীদের কথা। মানুষ দীর্ঘায়ু হবে এবং সুদীর্ঘ সময় ভালভাবে বেঁচে থাকবে এটাই হলো বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিকল্প। তবে সেটা একটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে। তার এই সুদীর্ঘ অস্তিত্ব যাতে সুস্থ ও স্বাস্থ্যময় হয়। মানবজাতিকে গ্রীক পৌরাণিক কাহিনীর সেই টিথোনাসের মতো নিজের ফাঁদে যাতে পড়ে না যেতে হয়। টিথোনাস দেবতাদের কাছে অমরত্ব চেয়েছিলেন এবং তা লাভও করেছিলেন। কিন্তু তিনি যা চাইতে ভুলে গিয়েছিলেন তা হলো অনন্ত যৌবন। তাই একসময় তাকে বার্ধক্য গ্রাস করল। তিনি লোলচর্মসার, দৃষ্টিহীন, দন্তহীন বৃদ্ধে পরিণত হলেন এবং এ অবস্থায় অসহায়ভাবে বেঁচে থাকলেন, মরলেন না। শেষ অবধি তিনি পরিণত হলেন ঘুণ পোকায়। টিথোনাসের ফাঁদের কথা উঠল এই কারণে যে, মানুষের শরীরটা আসলে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে জিন বয়ে নিয়ে যাওয়ার বাহক যানের মতো। কিন্তু কালের প্রবাহে শরীর সেই বহন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তখন সেটি বাতিল যানে পরিণত হয়। জীববিজ্ঞানীরা এই অবস্থাটাকে দুটি শব্দে প্রকাশ করে থাকেনÑ ‘ডিসপোজেবল সোমা’। এর মধ্যে শুধু যে সামগ্রিক জরা বা বার্ধক্যাবস্থার ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে তাই নয় উপরন্তু স্মৃতিলোপ, ক্যান্সার, হৃদরোগ, বাত এবং এ জাতীয় অন্যান্য সমস্যা তরুণ বয়সে কেন হয় না কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে যখন প্রজনন ক্ষমতা শেষ হয়ে যায় তখন কেন জাঁকিয়ে বসে সেই উত্তর পাওয়া যাবে। দীর্ঘ ও স্বাস্থ্যময় জীবন নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত করতে হলে এ সমস্যাগুলোরও অবশ্যই সমাধান করতে হবে। উপরন্তু সুস্থ মস্তিষ্ক ও বয়স বেড়ে যাওয়ার ফলে অনেক ক্ষমতা হারাতে পারে। আমাদের মস্তিষ্কের বিবর্তন ঘটেছে এমনভাবে যে এই অঙ্গটি ৭০ থেকে ৮০ বছরের স্মৃতি ধারণ করে রাখতে পারে। কিন্তু সেই মস্তিষ্ককেই যদি দেড়শ’ বছরের স্মৃতি ধারণ করে রাখতে বলা হয় সেই ক্ষমতা তার নাও থাকতে পারে। তারপরও বলতে হয় সে জীববিজ্ঞানে অগ্রগতি যেরূপ দ্রুতলয়ে ঘটছে তাতে মানুষের আয়ু বৃদ্ধির ব্যাপারটা নাগালের মধ্যে আসতে দেরি হবে না। কিছু কিছু কল্পনাবিলাসী স্বপ্ন দেখেন মানুষ অমরত্ব অর্জন না করলেও অমরত্বের কাছাকাছি পৌঁছাবে। সেটা কোনদিনও ঘটবে না। তবে জরা ও বার্ধক্য যে মন্থর করা যাবে, মানুষকে যে দীর্ঘায়ু করে তোলা যাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। বিজ্ঞান আজ সেদিকেই দ্রুত ধাবমান। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×