ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ শুভ কামনায় সালাম বিনিময়

প্রকাশিত: ২১:২৬, ২১ জানুয়ারি ২০২২

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ শুভ কামনায় সালাম বিনিময়

ওলামায়ে কেরামের মতে সালামের শাব্দিক অর্থ শান্তি ও নিরাপত্তা। তাই ‘আসসালামু আলাইকুম’ অর্থ হলো- আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আমার পক্ষ থেকে আপনার নিরাপত্তা দেয়া হলো, আপনিও আমাকে নিরাপত্তা দিন। আর ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় একজন মুসলমান আরেক মুসলমানের সাক্ষাতে যে বাক্য দ্বারা পরস্পর ভালবাসা, বন্ধুত্ব, শান্তি, নিরাপত্তা, কল্যাণ ও দোয়া কামনা করে তারই নাম সালাম তথা ‘আসসালামু আলাইকুম’। মানব ইতিহাসের শুরু থেকেই সালামের প্রচলন ছিল। পরবর্তীতে বিভিন্ন জাতি নিজেদের সভ্যতা, সংস্কৃতি, আদর্শ ও রুচি অনুযায়ী পরস্পর ভাববিনিময় ও সাদর সম্ভাষণে বিভিন্ন পদ্ধতি প্রচলন করে নানা শব্দ ও বাক্য বেছে নিয়েছে। প্রাক ইসলামী যুগে আরব সমাজের মধ্যে ‘হাইয়্যাকাল্লাহ’-আল্লাহ তোমাকে জীবিত রাখুক, ‘আনআমাকাল্লাহ বিকা আইনাহু’- আল্লাহ আপনার বদৌলতে প্রিয়জনদের চক্ষু শীতল করুন এবং ‘আনইম সাবাহান’- আপনার প্রত্যুষ সুখময় হোক ইত্যাদি প্রচলিত ছিল। কিন্তু এসব পদ্ধতির মধ্যে পার্থিব শুভকামনা ছাড়া ইহ-পারলৌকিক কল্যাণ, শান্তি ও মুক্তি কামনায় শুভ ইচ্ছা পরিলক্ষিত হয় না। ইসলামের আবির্ভাবের পর বিশ্বনবী (সা) ওসব শব্দ পরিহার করে ‘আসসালামু আলাইকুম’ এবং উত্তরে ‘ওয়া আলাইকুমুস্ সালাম’ বলার প্রথা প্রবর্তন করেন। কুরআন শরীফে বলা হয়েছে, অতঃপর যখন তোমরা গৃহে প্রবেশ কর, তখন তোমাদের স্বজনদের প্রতি সালাম বলবে। এটা আলাহর কাছ থেকে কল্যাণময় ও পবিত্র দোয়া। (সূরা নূর, আয়াত ৬১)। সূরা আল-ফুরকানে এসেছে, রহমান এর বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদের সাথে যখন মূর্খরা কথা বলতে থাকে, তখন তারা বলে, সালাম। (আয়াত ৬৩)। আর বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা) কে সালাম শব্দ দ্বারা পবিত্র কোরআনের অনেক স্থানে সম্বোধন করা হয়েছে। বিশেষ করে মিরাজের রাতে আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবিব (সা) কে ‘আসসালামু আলাইকা আইয়্যুহান্নাবীয়্যু’ বলে সালাম জানান এবং প্রতি উত্তরে প্রিয় নবী ‘আসসালামু আলাইনা ওয়ালা ইবাদিল্লাহ’ বলে জবাব দেন। অতুলনীয় রীতি ও সর্বজনীন অভিবাদন পদ্ধতির ক্ষেত্রে যে সালাম প্রবর্তিত হয়েছে তা কয়েকভাগে বিভক্ত। যেমন- অনুমতির জন্য সালাম: কোন অনুষ্ঠানে, কারো ঘরে, অফিসে এমনকি নিজের ঘরে ও আপন স্ত্রীর কামরায় প্রবেশকালে অনুমতি সূচক সালাম দিতে ইসলামের বিধান রয়েছে- যাতে অনেক উপকার ও নিগৃঢ় তত্ত্ব নিহিত আছে। আল্লাহ বলেন, হে ঈমানদারগণ! তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত অন্যের ঘরে প্রবেশ করবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না সে ঘরের অধিবাসীর অনুমতি নেবে এবং তাদেরকে সালাম করবে। (সূরা নূর)। সাক্ষাতের সময় প্রীতি সম্ভাষণে সালাম : একজন মুসলমানের সঙ্গে অপর মুসলমান ভাইয়ের সাক্ষাত হলে প্রথমেই সালাম দেয়ার মাধ্যমে সাদর সম্ভাষণ জানাবে। যার মধ্যে নিহিত রয়েছে পারস্পরিক বন্ধুত্ব, ভালবাসা, কল্যাণ কামনা এবং গর্ব অহঙ্কার বিবর্জিত বিনয়ীভাব ও মিত্রতা। রাসূল (সা) বলেছেন, যখন কোন মুসলমান ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাত হবে তখন তাকে সালাম করবে। এরপর যদি তাদের মাঝে বৃক্ষ, প্রাচীর কিংবা পাথরের আড়ালে পুনরায় সাক্ষাত হয় তখনও আবার সালাম দেবে। বিদায়ী সালাম : একজন আরেকজনের আগমনকালে যেমনি সালামের মাধ্যমে সাদর সম্ভাষণ শিক্ষা দেয়, তেমনি বিদায়কালেও প্রীতি-ভালবাসা ও দোয়া দিয়ে বিদায় জানানোর এক অপূর্ব রীতিনীতি ইসলাম শিক্ষা দিয়েছে। রাসূল (সা) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ কোন মজলিসে প্রবেশ করলে সে যেন সালাম করে।...অতঃপর যখন চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে দাঁড়াবে তখন যেন (দ্বিতীয়বার) সালাম করে। কেননা প্রথম বারের সালাম দ্বিতীয় বারের সালামের চেয়ে উত্তম নয়। অর্থাৎ উভয়ের সালাম সমান গুরুত্বের দাবিদার। (তিরমিযী)। বাহকের মাধ্যমে সালাম : বাহক ও প্রেরক মারফত আমরা অনেক সময় খোঁজ খবর নিয়ে থাকি, লেনদেন, আদান-প্রদান করি। এমতাবস্থায় পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বাহক মারফত যেন একে অপরের কল্যাণ ও দোয়া কামনা করতে পারে সে পদ্ধতি ইসলাম শিখিয়ে দিয়েছে। বাহকের মাধ্যমে প্রাপ্ত সালামের জবাবে বলতে হবে ‘ওয়া আলাইকা ওয়া আলাইহিস সালাম।’ চিঠিÑপত্রের মাধ্যমে সালাম : চিঠি পত্রের মাধ্যমে কুশলাদি বিনিময় ও প্রয়োজনীয় খবরাখবর প্রেরণ করার এই রীতি অতি প্রাচীন। আত্মীয়স্বজনের খোঁজ খবর নেয়া, রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন ও দাওয়াতী কাজে চিঠি-পত্রের ব্যবহার হয়। পত্র লেখার মাধ্যমেও যাতে একে অপরের কল্যাণ কামনা করতে পারে সে জন্য সালামের বিধান প্রবর্তন হয়েছে নবী করীম (সা) এর যুগ থেকে। হুজুর (সা) সম্রাট হিরাক্লিয়াসের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করতে লিখেছিলেন, ‘সালামুন আলা মানিত্তাবাআল হুদা,’ অর্থাৎ ‘যে ব্যক্তি হেদায়াতের অনুসরণ করবে তার প্রতি সালাম বা শান্তি বর্ষিত হোক।’ এছাড়া টেলিফোনে আলাপ কালে, ফ্যাক্স ও ই-মেইলসহ উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও সালামের আদান প্রদান করা যেতে পারে। সালামের ফজিলত সম্পর্কে হাদিস শরীফে বলা হয়েছে, ইমরান ইবন হুসাইন (রা) থেকে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি নবীজীর (সা) কাছে এসে বলল, আসসালামু আলাইকুম। নবী (সা) বললেন, দশ নেকি। অতঃপর আরেক ব্যক্তি এসে বলল, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। নবী (সা) বলেন, বিশ। আরেক ব্যক্তি এসে বলল, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুলাহি ওয়া বারাকাতুহু। নবী (সা) বললেন, ত্রিশ। (নেকি অর্জন করলে)। হযরত আয়শা (রা) বলেন, রাসূলুলাহ (সা) তাঁকে বলেন, জিব্রাঈল (আ) তোমাকে সালাম বলেছেন। তিনি (আয়শা) বলেন, ওয়াআলাইহিস সালাম ওয়া রাহমাতুলাহি ওয়া বারাকাতুহু। (বুখারী, মুসলিম)। আবু উমামা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুলাহ (সা) কে জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসূূল! দু’জন লোকের সাক্ষাত হলে কে প্রথম সালাম করবে? তিনি বলেন : ‘তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি আল্লাহর বেশি নিকটবর্তী।’ আল্লাহপাক আমাদের এ বরকতময় অভ্যাসের চর্চা সমাজে বাড়িয়ে দেয়ার তৌফিক দান করুন। লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব। [email protected]
×