ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মোঃ আকতারুজ্জামান

উচ্চশিক্ষা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণে করণীয়

প্রকাশিত: ২১:০৯, ১৮ জানুয়ারি ২০২২

উচ্চশিক্ষা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণে করণীয়

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপ্ন দেখেছিলেন ‘সোনার বাংলা’- একটি ক্ষুধা দুর্নীতিমুক্ত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশের। বঙ্গবন্ধু মানসম্পন্ন শিক্ষার গুরুত্বকে অনুধাবন করে দেশের প্রথম বিজয় দিবস-১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলার সূচনা করেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় ইউজিসি ১৯৭৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করে। ইউজিসির ৫০ বছর পূর্তিতে ‘বঙ্গবন্ধু ইন্টারন্যাশনাল র‌্যাঙ্কিং অব ইউনিভার্সিটিজ ইন বাংলাদেশ’ বৈশ্বিক ট্রান্সন্যাশনাল শিক্ষা ইকোসিস্টেমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী ও তার আইসিটি উপদেষ্টার দূরদর্শী নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ এখন রূপান্তরিত হয়েছে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে’। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের রিপোর্ট অনুসারে কোভিড-১৯-এর বৈশ্বিক অস্থিরতার মধ্যেও বাংলাদেশ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। করদাতার আয় এবং সমাজের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে সরকার এখন উচ্চশিক্ষা ঋণ কর্মসূচী চালু করতে পারে। যেমন- সম্পূর্ণ বিনামূল্যে, সরকারী ভর্তুকিপ্রাপ্ত এবং সম্পূর্ণ ফি প্রদান স্কিম। ব্লেন্ডেড এবং অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীকে আকৃষ্ট করার জন্য টিউশন ফি এবং সুযোগ-সুবিধাগুলো নির্ধারণ করা প্রয়োজন, যা আমাদের কূটনৈতিক মিশনের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া যেতে পারে বহির্বিশ্বে। এই প্রবণতা আমাদের দেশ থেকে বার্ষিক ৬ বিলিয়নের বেশি রেমিট্যান্স প্রবাহের বহির্গমন বন্ধ করতে সাহায্য করবে। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে একজন সহকর্মী বাংলাদেশী ছাত্র আমার কাছে একটি প্রতিবেদন নিয়ে এসেছিলেন। যেখানে অস্ট্রেলিয়ান কম্পিউটার সোসাইটি বাংলাদেশ থেকে তার বিএসসি ডিগ্রী এ্যাসোসিয়েট ডিপ্লোমা হিসেবে মূল্যায়ন করেছে এবং তাকে সেখানে বিএসসি সমমানসম্পন্ন করার জন্য আরও একটি বছর অধ্যয়ন করার পরামর্শ দিয়েছে। প্রাথমিকভাবে ভেবেছিলাম যে, এটি একটি ভুল। কিন্তু ২০১৪ সালের প্রথম দিকে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী ইঞ্জিনিয়ার অস্ট্রেলিয়া, ভেটএসেস, এসিএস ইত্যাদি থেকে একই রকম মূল্যায়ন পেয়েছিলেন। এক্ষেত্রে ডিগ্রী প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি শিক্ষার্থীদের ভর্তির পছন্দে বাংলাদেশের শীর্ষ-৫ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে। বিভিন্ন উন্নত দেশে ইতোমধ্যে এ ধরনের ঘটনা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের ক্ষেত্রে ঘটেছে। ভবিষ্যতেও ঘটতে পারে। বিষয়টি উদ্বেগজনক, কিন্তু আশ্চর্যজনক নয়। বৈশ্বিক বাণিজ্যিক বিশ্বে শিক্ষা আর শুধু সেবা নয়, বরং একটি ব্যবসাও। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্য একই দর্শন বহন করে– মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন। ২০১৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের জাতীয় অর্থনীতিতে ৪১ বিলিয়ন অবদান রেখেছে এবং মোট ২৬০,০০০ পূর্ণকালীন চাকরির যোগান দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার ৩৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩২৫,০০০ শিক্ষার্থী তাদের ডিগ্রী সম্পন্ন করেছে এবং র‌্যাঙ্কিং তাদের সাফল্যে গাথায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ২০২১ সালের শেষের দিকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বিবেচনা করেছে। ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। বেশিরভাগ উন্নত দেশই ‘স্টাডি ইন অস্ট্রেলিয়া, কানাডা বা আমেরিকা’ নামে শিক্ষামেলার আয়োজন করে থাকে। ২০৪১-এর উন্নত বাংলাদেশে আমরা কি আশা করতে পারি না যে, আমাদের অন্তত ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় টাইমস, কিউএস বা কোন নামকরা র‌্যাঙ্কিং-এ শীর্ষ ৩০০-৫০০-এর মধ্যে স্থান পাবে? ভারত ইতোমধ্যেই ‘স্টাডি ইন ইন্ডিয়া’ ক্যাম্পেইন শুরু করেছে। এশিয়া, আফ্রিকা বা আরব অঞ্চল থেকে বিদেশী শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে আমাদের পরিকল্পনা কী? যা পরবর্তীতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাঙ্কিং এবং জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। টাইমস হায়ার এডুকেশন র‌্যাঙ্কিং সূচক এবং সামগ্রিক র‌্যাঙ্কিংয়ে তাদের অবদানের শতাংশ হলো: (i) পাঠদান [৩০], (ii) গবেষণা [৩০], (iii) সাইটেশন বা উদ্ধৃতি [৩০], (রা) আন্তর্জাতিক আউটলুক [৭.৫], এবং (া) শিল্প আয় [২.৫]। পাঠদানে (শিক্ষার পরিবেশ), খ্যাতি সমীক্ষা: ১৫%, শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত: ৪.৫%, ডক্টরেট থেকে স্নাতক অনুপাত: ২.২৫%, ডক্টরেট-শিক্ষক অনুপাত: ৬%, প্রাতিষ্ঠানিক আয়: ২.২৫%। গবেষণায় (আকার, আয় ও খ্যাতি), খ্যাতি জরিপ: ১৮%, গবেষণা আয়: ৬%, গবেষণা উৎপাদনশীলতা: ৬%। সাইটেশনে (গবেষণার প্রভাব), নতুন জ্ঞান এবং ধারণা ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকা, বিশ্বব্যাপী এক্সপার্টদের দ্বারা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত গবেষণা নিবন্ধগুলো গড়ে কতবার উদ্ধৃত হয়েছে তার দ্বারা নির্ধারণ করা হয়। আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে (শিক্ষক, ছাত্র, গবেষণা), আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের অনুপাত: ২.৫%, আন্তর্জাতিক শিক্ষকদের অনুপাত: ২.৫%, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: ২.৫% এবং সবশেষে শিল্প আয় (জ্ঞান স্থানান্তর), শিল্পকে সাহায্য করার জন্য উদ্ভাবন এবং পরামর্শের মাধ্যমে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিল্প থেকে কত গবেষণা বাবদ আয় করে তা একাডেমিক কর্মীদের সংখ্যার বিপরীতে ট্যালি করে দেখা হয়। কিউএস র‌্যাঙ্কিংয়ে সূচক এবং সামগ্রিক র‌্যাঙ্কিংয়ে তাদের অবদানের শতাংশ হলো- (র) একাডেমিক খ্যাতি [৪০], (রর) নিয়োগকর্তার খ্যাতি [১০], (iii) শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত [২০], (রা) শিক্ষক প্রতি উদ্ধৃতি [২০], (া) আন্তর্জাতিক শিক্ষক অনুপাত [৫] এবং (ার) আন্তর্জাতিক ছাত্র অনুপাত [৫]। প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক রেপুটেশন স্কোর একাডেমিক সমীক্ষার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়, যা বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষাদান এবং গবেষণার মান সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞদের মতামতকে একত্রিত করে। নিয়োগকর্তার খ্যাতি নিয়োগকর্তা সমীক্ষার ওপর নির্ভর করে, যা তাদেরকে সেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিহ্নিত করতে বলে, যেখান থেকে তারা সবচেয়ে যোগ্য, উদ্ভাবনী, কার্যকর স্নাতকদের নিয়োগ দেয়। এক্ষেত্রে শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত, শিক্ষক প্রতি উদ্ধৃতি, আন্তর্জাতিক শিক্ষক বা আন্তর্জাতিক ছাত্র অনুপাত টাইমস উচ্চশিক্ষা র‌্যাঙ্কিংয়ের অনুরূপ আক্ষরিক অর্থ বহন করে। এখন আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে দৃষ্টি দেয়া যাক। বেশিরভাগ অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪০ শতাংশ আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের প্রচুর সংখ্যক আন্তর্জাতিক শিক্ষক ও সহযোগিতার সম্পর্ক রয়েছে, যেখানে আমাদের ভাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী নেই বললেই চলে। থাকলেও খুব কম সংখ্যক আন্তর্জাতিক শিক্ষক ও সহযোগিতা বিদ্যমান। আমাদের অবশ্যই অধিক সংখ্যক বিদেশী শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ ফ্যাকাল্টি মেম্বার (বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতও হতে পারে) এবং বিদেশী ভাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সহযোগিতার জন্য আকৃষ্ট করার মাধ্যমে নিজেদের আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি এমন উন্নত করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ে (৪৪) তুলনায় আমাদের ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত (১০-২০) তুলনামূলকভাবে ভাল থাকলেও নিম্ন গড়ের শিক্ষাদান খ্যাতি, কম প্রাতিষ্ঠানিক আয় এবং স্নাতকোত্তর ছাত্র ও ডক্টরেটসম্পন্ন শিক্ষকের সংখ্যা খুব কম। আমরা সাইটেশনে ক্রমবর্ধমান ভাল করছি। কিন্তু গবেষণার উৎপাদনশীলতা, আয় এবং খ্যাতিতে যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে। আমাদের কমিউনিটির কাছে গবেষণাকে পণ্য বা পরিষেবায় রূপান্তর করতে হবে। ইন্ডাস্ট্রি ও একাডেমিয়া সংযোগ শক্তিশালী করতে হবে। ফলে ধীরে ধীরে একটি উদ্ভাবনী শিক্ষা ইকোসিস্টেম তৈরি হবে। টাইমস, কিউএস বা আমাদের নিজস্ব কাস্টমাইজড ফরম্যাট অনুসরণ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি জাতীয় র‌্যাঙ্কিং সিস্টেম থাকা উচিত। যখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী এবং বাইরের গবেষণা অনুদান থেকে আয় করবে তখন তারা বিদেশ থেকে বিশেষ করে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ভিজিটিং প্রফেসর এবং এক্সপার্টদের সহজেই আনতে পারবে। তবে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য কোর্স বা প্রোগ্রাম অফার করা উচিত হবে না। শিক্ষক এবং বিশ্ববিদ্যালয় উভয়ের জন্য একটি প্রতিযোগিতামূলক, কিন্তু অনুকূল একাডেমিক পরিবেশ থাকতে হবে। এটি আমাদের স্নাতক শিক্ষা, গবেষণা, প্রকাশনা এবং আন্তর্জাতিক আউটলুকের মান উন্নত করবে। কর্মক্ষমতাভিত্তিক বিনিয়োগ, গবেষণা অনুদান, একাডেমিক উৎকর্ষ স্বচ্ছতার সঙ্গে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে চালু করতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশের কাছে বাংলাদেশ রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ডিজিটাল ক্যামেরুন, ডিজিটাল পাকিস্তান, ডিজিটাল নাইজিরিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারণা অনুসরণ করা হয়। ২০৪১ সালে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশে ভাল র‌্যাঙ্কের কোন বিশ্ববিদ্যালয় না থাকলে তা লজ্জাজনক। আমাদের অনেক সুবিধা রয়েছে। যেমন- জনবল খরচ কম, স্নাতক শিক্ষার মান তুলনামূলক ভাল, গ্রহণযোগ্য শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত ইত্যাদি। এখন আমাদের স্নাতকোত্তর গবেষণা, প্রকাশনা, তহবিল, গবেষণার বাণিজ্যিকীকরণ এবং আন্তর্জাতিক এক্সপোজার বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের শিক্ষার ব্র্যান্ড হিসেবে দেখতে চাই তাহলে আমাদের নীতিনির্ধারকদের অচিরেই একটি প্রতিযোগিতামূলক ও স্বচ্ছ র‌্যাঙ্কিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বৈশ্বিক শিক্ষার বাজারে উৎকর্ষ সাধনের জন্য আমাদের সেরা প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রস্তুত হতে সাহায্য করবে। লেখক : পরিচালক, ব্লেন্ডেড লার্নিং সেন্টার, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আইসিটি ও শিক্ষা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি
×