ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

হায়রে গাড়ি! বিআরটিএতে ভোগান্তি

প্রকাশিত: ২১:২৮, ১৩ জানুয়ারি ২০২২

হায়রে গাড়ি! বিআরটিএতে ভোগান্তি

প্রশ্ন-তোমাদের সম্পদ কি কি? উত্তর- সম্পদ হলো একটি ফ্ল্যাট, অনেক কষ্টে চাকরির পাশে আমি গবেষণা, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি এবং আমার স্বামী বিদেশে ইউনেস্কোর কনসালটেন্সি করে বাড়তি আয় করে সে সময়ে সবচেয়ে কম দামে ফ্ল্যাট কিনতে সক্ষম হয়েছিলাম। ঢাকায় সবচাইতে কম দামে ফ্ল্যাট বিক্রি করল এ্যাপার্টমেন্ট হাউস ব্যবসা শুরু করতে যাওয়া এক তরুণ-পুরনো ঢাকার বাসিন্দা। ঢাকায় ’৯৩ সালে উচ্চ মূল্যের ফ্ল্যাটের তুলনায় কম দামের একটি ফ্ল্যাট কিনতে সক্ষম হবো এমন অসম্ভব কল্পনাকে সম্ভব করেছিল বেশ কয়েক বন্ধু-প্রতিবেশীর উৎসাহ। ফ্ল্যাটটি, যেটিতে আমরা উঠেছি ’৯৬ সালে, তার অবসর প্রাপ্তির পর। কেনা হয়েছে আমার নামে। স্বামীর মৃত্যুর পর জানলাম- লক্কর-ঝক্কর গাড়িও সম্পদ। ওটা ওর নামে। সুতরাং ওয়ারিশ সনদ ছাড়া এটি নবায়নও হবে না, বিক্রিও হবে না। আশ্চর্য। এ তথ্য জানা ছিল না। সত্যি বলতে- ওয়ারিশ বা ওয়ারিশ সনদ সম্পর্কে জানতাম না কিছুই, ছিলাম পুরোপুরি অজ্ঞ। ড্রাইভার ওয়ার্ড কমিশনারের অফিসে যায় আমার আবেদনপত্র নিয়ে। ফিরে আসে, এতে হবে না। তার ওপর, এসব অফিসে আমাকে নিয়ে গল্পতো হবেই, সাদা চুল, বব্্ কাট চুল, চাকরিজীবী মহিলা, স্বামী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, তাদের মাত্র একটা ফ্ল্যাট আর একটা পুরনো গাড়ি ছাড়া আর কোন সম্পদ নেই, এ হতে পারে না। অবশেষে একদিন একজনের বুদ্ধিতে ড্রাইভার ওখানে কাউকে এক শ’ টাকা চা খেতে দিলে সে একটি ফর্ম দিল। হায়। এখন বুঝলাম, জরমযঃ ঃড় ওহভড়ৎসধঃরড়হ কেন এত দরকার। ফরম পূরণ করে পাঠালাম। ফেরত এলো। কেন? না, আপনার তো ছেলে নেই। সুতরাং ঐ পুরনো গাড়িরও ওয়ারিশ হবে আপনার স্বামীর ভাই বা বোন। অবিশ্বাস্য মনে হলো। বললাম- তাহলে দেশ ডিজিটাল হলো কোথায়? এতো মান্ধাতার আমলের পুরুষতান্ত্রিক রীতি। এটি বর্তমান যুগে থাকতে পারে না। বর্তমান যুগেও দেবর-ননদের নাম ওয়ারিশে থাকবে। বিস্মিত হয়ে উকিল-দেবরকে বললাম, তাহলে তোমাদের নামের পাশে- ‘দাবি নাই’ লিখতে হবে, তাই না? সে বলল- হ্যাঁ, লিখে দ্যান, মোবাইল নম্বরও দেন। তবু ফেরত এলো ফর্ম। না। দু’জন সাক্ষীর মন্তব্য থাকবে, মৃত লতিফ সাহেবের ওয়ারিশ হচ্ছে স্ত্রী এবং দুই কন্যা, অন্য কোন ওয়ারিশ নেই, তিনি যে তথ্য দিয়েছেন এগুলো সত্য। এক দেবর স্ট্যাম্প পেপারে এসব টাইপ করে একজনের, ননদের স্বামীর স্বাক্ষর আনল। আমি পুরাতন বাসিন্দা এক প্রতিবেশীর স্বাক্ষর আনলাম। এবার দেবরকে নিয়ে নিজেই কমিশনার অফিসে গেলাম। যথারীতি কমিশনার নেই, সিটি কর্পোরেশনে গিয়েছে। আসবেন। বসে রইলাম। দেবর অফিস ছুটি নিয়ে বড় ভাবীর উদ্ধারে বসে আছে। ঘণ্টা দুয়েক পর দেবরকে বললাম, মনে হয় ওপর থেকে ফোন করাতে হবে। ভাগ্যিস, কমিশনারের ফোন নম্বর মৃত্যু সনদের খামে ছিল, যেটি আমি সঙ্গে নিয়েছিলাম। দেবর ফোন করল ভাগ্নিকে। ওর স্বামী এমপি, সংসদে দায়িত্বে আছে। ওর পিএ কে দিয়ে ফোন করাতে বললাম। ততক্ষণে ওর স্বামী নিজেই ফোন করলে কমিশনার কথা দিল- ‘আজকেই করে দেব, স্যার।’ খুশি হলাম। তবে অত ওপরের আত্মীয়কে দিয়ে বলাতে হলো বলে মনোকষ্টও হয়েছিল। বাসায় ফিরলাম। দেবর চলে গেল। দুপুর গেল, বিকাল গেল, সন্ধ্যার মুখে এ্যাসিস্ট্যান্টকে ফোন করলাম, ‘না, স্যার আসেননি, কালকে আপনার ফাইল সই হয়ে যাবে।’ পরদিন ১১টা, ১২টা, ১টা বেজে গেল। ভাবলাম, আচ্ছা, কমিশনারকে আমিই ফোন করলে কেমন হয়? এর আগে অবশ্য ফোনে ওর রাগান্বিত বক্তব্য শুনতে হয়েছিল। তবু ওয়ারিশ সনদ ছাড়া কিছুই করতে পারছি না। অসহায় আমি ফোন করলাম। জানি, ধরবে না, তবে, আশা ছিল কাজটা হতে পারে। তাই হল। দশ মিনিট পরেই এ্যাসিস্ট্যান্ট গম্ভীর স্বরে বলল, ‘লোক পাঠান, আপনার সনদ নিয়ে যান।’ এর জন্য এত খুশি হওয়ার কথা নয়। তবু খুশি হয়ে ড্রাইভারকে পাঠালাম। সনদ হাতে পেয়ে ভাবলাম- বঙ্গবন্ধুর ‘ছেলে হোক, মেয়ে হোক, দুটি সন্তানই যথেষ্ট’ আন্তরিকভাবে মেনেছি আমরা, স্বামীর, মা-শাশুড়ির অনুরোধ অগ্রাহ্য করে। কিন্তু ডিজিটাল দেশ এখনও এসব ক্ষেত্রে প্রস্তুত হয়নি। এবার বিআরটিএ। আরেকটি লড়াই সেখানে। কয়েক উকিলের পরামর্শ শুনলাম। ‘নোটারি’ নামক নতুন শব্দ শিখলাম, সে কোন জাতের মানুষ হবে, জানি না। গেলাম বিআরটিএ। ‘নোটারি’ কোথায় থাকে? শুনলাম, অফিসারের সামনে নিরক্ষর চালকেরা বলছে- ‘লটারি’। শুনে শিক্ষক আমি বললাম, ‘লটারি নয়, নোটারি।’ পাশে এক যুবক বলল, ‘ঐ হলো, একই কথা, নোটারিকে ‘লটারি’ বলতে পারে ওরা।’ বললাম, ‘ভুলটা শুধরে নিতে অসুবিধা কি।’ যাক, অফিসার দয়া করে জানাল ‘নোটারি’ বিআরটিএ’র ভেতরে থাকতে পারে না, বাইরে বাম দিকে গেলেই পাবেন। তবে, মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে একটা ধন্যবাদ দিতে হয়। বিআরটিএ এখন দালালমুক্ত। বিশ বছর যাবত প্রতি বছর গাড়ির ট্যাক্সসহ কাজ করতে যাই। যা হোক, বাইরে বের হয়ে ‘নোটারী’কে পেলাম। বাইরে বড় সাইনবোর্ড লেখা। ঢুকলাম। তাকে কার্যকর সহায়তাকারী হিসেবে পেলাম। সহায়ক দু’জন তরুণ কাজে ব্যস্ত, ‘নোটারি’ মহাব্যস্ত মানুষ, সব মুখস্থ, কার কোন ফর্ম পূরণ করতে হবে, কার কত টাকার স্ট্যাম্পে কি কি লিখতে হবে- যাবতীয় কাগজ-ফর্ম প্রস্তুত করলেন। কাজের জন্য ন্যায্য অর্থই নিয়েছেন। বুঝে নেন কথা বলে কার আর্থিক সঙ্গতি কেমন, আবার শ্বশুর বাড়ির লোক। পরদিন দুই মেয়েকে অফিসারের সামনে সই করতে নিয়ে যেতে হবে। ওদের দু’জনের সঙ্গে কথা বলে ঠিক হলো সকালেই রওনা হব। এদিন সকালে চালক দশটার আগে যেতে পারবে না জানাল। বকা-বকুনী দিলাম। মনে হলো- আজ ২৯ ডিসেম্বর, ও কোন ব্যবসায়ী বা কোম্পানির চাকরিতে কথা বলতে যেতে পারে। যদিও চেনা-জানা সবার চাইতে বেশি বেতন দেই। সপ্তাহে অনুষ্ঠান না থাকলে দু’দিন ছুটি পায়, তবু মনে হলো- যেতেই পারে। যা হোক, দেরি করেই বিআরটিএ-তে পৌঁছলাম। অফিসার বললেন, ‘আরেকটা কাগজে আপনার ওয়ারিশ হওয়ার কথা। অঙ্গীকারনামা হিসেবে স্ট্যাম্পে লিখে আনতে হবে।’ ভীষণ হতাশ হলাম। মেয়েদের একটা গাছতলায় বসতে বলে ছুটে গেলাম ‘নোটারি’র কাছে। তিনি প্রস্তুত ছিলেন। সময় ব্যয় না করে দ্রুতই অঙ্গীকারনামা, ফটো, স্বাক্ষরসহ প্রস্তুত করে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ছুট, বিআরটিএ’র অফিসারের কাছে। তিনি গাড়ি নিরীক্ষা করতে বললেন। আমার কাজ দুটো- একটা ওয়ারিশ হিসেবে মালিকের নাম বদল আরেকটা নতুন ইঞ্জিন লাগানোর কাগজপত্র, লগবুক তৈরি ইত্যাদি। অবশ্য ফি’টা আমি বরাবরের মতো ব্যাংকে জমা দিয়েই বিআরটিএতে গিয়েছিলাম। এবার দেখা গেল ইঞ্জিন বিক্রেতার কোন কাগজে ইঞ্জিনের নম্বর নেই। প্রায় সব কাগজই অসম্পূর্ণ। হায়। কেন আগেই দেখলাম না। অনেক চালককে অনুরোধ করলাম, গাড়ির নতুন ইঞ্জিন নম্বরটা দেখে দিতে। আমাদের ড্রাইভার জানে না। ওরা এদিক ওদিক দেখলেও ইঞ্জিন নম্বর পেল না। হঠাৎ এক গাড়ি পরিদর্শক এসে আমার হাত থেকে কাগজ নিয়ে স্বাক্ষর, সিল দিয়ে দিল। বলল, ‘যান হয়ে গেছে।’ মেয়েদের নিয়ে তিন তলা, দোতলা ঘুরে এক অফিসারের কক্ষে গেলাম। ওদের স্বাক্ষর করতে বলল। স্বাক্ষর শেষে আবার ইঞ্জিনের কাগজপত্রে ইঞ্জিন নম্বর না পাওয়ায় হতাশ মহিলা কর্মকর্তা বললেন, ‘ম্যাডাম, আজকে আপনার কাজটা করে দিতে চাইলাম, হলো না। সোজা ইঞ্জিন লাগানোর কারখানায় যান, ইঞ্জিন নংসহ কাগজগুলো পূরণ করে কাল সকালে চলে আসবেন। মেয়েদের আনতে হবে না।’ মেয়েদের যার যার বাসায় নামিয়ে দিয়ে চারটায় গেলাম কারখানায়। না, ওতো নিরক্ষর, ইঞ্জিনের নম্বরও জানে না, জানে বিক্রেতা। ওকে নিয়ে গুলশানের শেষ মাথায় ইঞ্জিন বিক্রির দোকান। ওরা এক যুবককে কাগজ পূরণ করতে লাগিয়ে দিল। গাড়িতে বসে সন্ধ্যার মশাদের পাখা দিয়ে তাড়াতে তাড়াতে অবশেষে কাগজ ফেরত পেলাম। ড্রাইভারকে বললাম, ‘এক্ষুনি ইঞ্জিন নম্বর দেখ, আমার সামনে।’ দেখল ও। তারপর ভয়াবহ জ্যাম ঠেলে রাত সাড়ে ৮টায় বাসায় আসলাম। পরদিন সকালে মনে হলো- ইঞ্জিন বিক্রেতার পূরণ করা কাগজপত্র দেখা দরকার। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখলাম- পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠার ফরমে লেখা আমাদের পুরাতন ইঞ্জিনের নম্বর। নিচে নামলাম, ড্রাইভারকে বললাম, ‘দেখাও ইঞ্জিনের নম্বর।’ ও মোবাইলের টর্চ দিয়ে বনেট তুলে ইঞ্জিনের নম্বর দেখাল, আমি টুকে নিলাম। চলে গেলাম বিআরটিএ। মহিলা কর্মকর্তার কক্ষে ভিড়। কোনমতে তার টেবিলের এক কোনায় দাঁড়ালাম। সব নতুন ইঞ্জিনের কাগজ তৈরি হচ্ছে। তাদের ফর্মগুলো খেয়াল করলাম। তারপর দ্রুত আমার কাগজের যে পাতাগুলোতে ইঞ্জিনের পুরনো নম্বর লেখা সেগুলো কেটে নতুন নম্বরটা লিখলাম। ইঞ্জিনের মূল্য আগের দিন কর্মকর্তাকে বলেছিলাম ছেচল্লিশ হাজার টাকা। সেটা তিনি নিজেই লিখেছেন। ঐদিকে ইঞ্জিন বিক্রেতা অনেক পাতায় ইঞ্জিনের মূল্য লিখেছে দশ লক্ষ টাকা। অবিশ্বাস্য এই অঙ্কটা ঘ্যাচাং করে কেটে কেটে লিখলাম- ছেচল্লিশ হাজার টাকা। মনে হচ্ছিল, যেন নকল করছি। এসব তো বিক্রেতার লেখার কথা। যা হোক, মহিলা আমার কাগজ চাইলেন, দিলাম। বললেন, ‘ঠিক আছে’। আপনার নতুন লগবুক লিখে দিচ্ছি। পরে ঝগঝ যাবে, ঐ দিন এসে ডিজিটাল কার্ড নেবেন। মনে হলো রাজ্য জয় করে এসে রাজা-মহারাজাদের এমনই খুশি লাগত। বললাম, ‘আচ্ছা, আপনাদের ক্লায়েন্ট এতো বেশি, কর্মকর্তা এত কম, সহায়ক কর্মকর্তাও তো দেখছি না।’ তিনি বললেন, ‘আমাদের রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয়। ছুটি নেই, শুক্র-শনিবারও অফিস করি। পরিবারের দেখাশোনাও করতে পারি না।’ বললেন, ‘পদ দু’শ’, কর্মকর্তা আছে ৫০। কিভাবে কাজ হবে? বললাম, আমি লিখব আপনাদের এত চাপ আর এত কম জনবলের কথা। মহিলা হাস্যোজ্জ্বল। নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেননি। তাকে বলপেনটা উপহার দিলাম। কেউ তারটা নিয়ে চলে গেছে। বিআরটিএতে যেখানে দু’শ’ কর্মকর্তা, কর্মচারী দরকার, সেখানে পঞ্চাশ জন কর্মকর্তা থাকবে কেন? ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা নিয়ে পালাচ্ছে ব্যাংকার-ব্যবসায়ী-ঠগবাজ মানুষ। আর এখানে ওরা দিন রাত কাজ করবে ঘুষ ছাড়া- একি সম্ভব? বিআরটিএর শূন্য পদ অবিলম্বে পূরণ করা হোক। সরকারী সব সহায়তাকে ‘জনগণের উপহার’ নামকরণ করুন। জনপ্রতিনিধি এবং সরকারী কর্মকর্তারা জনগণকে মাথায় ও হৃদয়ে রেখে কাজ করবেন। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যানবাহনে লেখা থাকা দরকার- জনগণের উপহার। দিন রাত চোখে পড়তে পড়তে জনপ্রতিনিধি ও সরকারী কর্মকর্তাদের মনে জনগণ ক্রমশ স্থায়ী প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। লেখক : শিক্ষাবিদ
×