ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাস্থ্যবিধি মানাতে নতুন কৌশল অবলম্বনের তাগিদ বিশেষজ্ঞদের

লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ, তবুও মানুষ বেপরোয়া

প্রকাশিত: ২২:৪৮, ৮ জানুয়ারি ২০২২

লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ, তবুও মানুষ বেপরোয়া

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ফানুস আর আলোর বন্যার মধ্য দিয়ে ২০২১ কে বিদায় জানিয়েছিল দেশবাসী। যেন একটি নতুন শুরুর আশায় তৈরি হয়েছিল সবাই। কিন্তু কে জানতো আবারও মহামারী করোনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে! ঠিক তাই ঘটলো। বছরের শুরু দিন থেকেই দেশজুড়ে জ্যামিতিক হারে বাড়ছে ভাইরাসটির সংক্রমণ। বছরের প্রথমদিন যেখানে সংক্রমণের হার ছিল ২.৪৩ শতাংশ সেটি সপ্তাহান্তে গিয়ে উঠেছে ৪.৮৬ শতাংশে। আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সংক্রমণ বাড়লেও সাধারণ মানুষের মধ্যে নেই ন্যূনতম সচেতনতার লক্ষণ। স্বাস্থ্যবিধি মানতে সরকারের তরফ থেকে নানাবিধ নির্দেশনা দেয়া হলেও মাস্ক পরতে পর্যন্ত অনীহা মানুষজনের মধ্যে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ২ সপ্তাহের ব্যবধানে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। লকডাউন-শাটডাউনের মতো একই শব্দ ব্যবহার না করে প্রয়োজনে নতুন কৌশল অবলম্বনের তাগিদ তাদের। সর্বক্ষেত্রে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো প্রয়োজন বলেও অভিমত তাদের। গত এক সপ্তাহের করোনা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১ জানুয়ারি দেশে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩৭০ জন। এ সময় মৃত্যু হয় ৪ জনের। ১৫ হাজার ২১৪টি নমুনা পরীক্ষা বিপরীতে সেদিন শনাক্তের হার ছিল ২.৪৩ শতাংশ। এর পরদিন ২ জানুয়ারি দেশে আক্রান্ত হন ৫৫৭ জন ও মৃত্যু হয় ১ জনের। এদিন পরীক্ষার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৯ হাজার ১৩০টি। এর বিপরীতে সংক্রমণের হার আগেরদিনের থেকে কিছুটা কম হয়ে দাঁড়ায় ২.৯১ শতাংশে। ৩ জানুয়ারি আবারও বাড়ে সংক্রমণ এবং মৃত্যুর সংখ্যা। এদিন ১৯ হাজার ৯৮০টি নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে করোনায় শনাক্ত হন ৬৭৪ জন। শনাক্তের হার বেড়ে দাঁড়ায় ৩.৩৭ শতাংশে। এদিন ভাইরাসটির সংক্রমণে মৃত্যুবরণ করেন ৪ জন। একইভাবে ৪ জানুয়ারি নতুন করে আক্রান্ত হন ৭৭৫ জন, মৃত্যু হয় ৬ জনের। মোট ১৯ হাজার ৮৩৮টি পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার আগেরদিনের মতোই ৩.৩৭ শতাংশেই থাকে। তবে বাড়ে ৫ জানুয়ারি। এদিন মোট আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে হয় ৮৯২ জন। মৃত্যু হয় ৩ জনের। ২১ হাজার ২৫১ পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার বেড়ে দাঁড়ায় ৪.২০ শতাংশে। এই ধারা অব্যাহত থাকে সপ্তাহের শেষদিন বৃহস্পতিবারও। এদিন নতুন করে শনাক্ত হন ১ হাজার ১৪০ জন। এ সময় মৃত্যু হয় আরও ৭ জনের। সপ্তাহের শুরুতে যে পরীক্ষার পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ২১৪টি সেখান থেকে বেড়ে এদিন পরীক্ষা করা হয় ২৩ হাজার ৪৩৫টি। এর বিপরীতে শনাক্তের হার হয় ৪.৮৬ শতাংশে। সপ্তাহের ব্যবধানে ভাইরাসটির ধারাবাহিক সংক্রমণ বৃদ্ধি ঘটলেও স্বাস্থ্যবিধি মানতে অনীহা লক্ষ্য করা গেছে সর্বস্তরে। সরেজমিনে রাজধানীর কয়েকটি শপিং সেন্টার ঘুরে দেখা যায়, সরকারের নির্দেশনা থাকলেও অনেকের মুখেই মাস্ক নেই। কারও কারও মাস্ক থাকলেও তা গলায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। কেউ আবার নামকাওয়াস্তে থুতনিতে মাস্ক রেখে কথা বলছেন। রাজধানীর মৌচাক মার্কেটের তৃতীয় তলায় প্রিন্স শাড়ি ঘরে বিয়ের গায়ে হলুদের জন্য শাড়ি কিনতে এসেছেন বাড্ডা থেকে মৌমিতা। তার সঙ্গে রয়েছেন চাচাতো বোন রেবেকা এবং ভাই তৌফিক। সবার কাছেই মাস্ক রয়েছে। কিন্তু কেনাকাটার সুবিধার্থে মৌমিতা তার মাস্কটি খুলে নিজের ভ্যানিটি ব্যাগে রেখেছেন। তৌফিকের মাস্কটি গলায় ঝুলিয়ে রাখা। প্রশ্ন করলে উত্তর দেন, মাস্ক তো আছে। কিন্তু সব সময় পরে রাখতে গেলে দমবন্ধ হয়ে আসে। তাই মাঝে মাঝে খুলে রাখি। মাস্ক নেই দোকানের কর্মচারীদেরও অনেকেরই। কেন মাস্ক নেই জানতে চাইলে দোকান মালিক রহমান বলেন, আসলে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে গেলে মাস্ক এদিক-ওদিক যাবেই। মাস্ক যে নেই তা নয়। সবার কাছে রয়েছে। কিন্তু কাজের ব্যস্ততায় এক জায়গায় নেই। শুধু মৌচাক মার্কেটেই নয় মাস্ক ব্যবহারে অনীহা দেখা গেছে বসুন্ধরা সিটি শপিং সেন্টারেও। এই শপিং সেন্টারটির প্রবেশ মুখে মাস্ক পরার বাধ্যবাধকতা থাকায় প্রায় সবাইকে মাস্ক পরেই ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। কিন্তু গেট পার হলেই থাকে না এ বাধ্য-বাধকতা। তখন যে যার মতো মাস্ক খুলেই কেনাকাটা করে বেড়ান। সেন্টারের ৮ তলায় রেস্টুরেন্টে পরিবার নিয়ে খেতে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাবেরিন। কারও মুখেই মাস্ক নেই। জানতে চাইলে বলেন, মাস্ক আছে তো। সবার পকেটেই একটি করে মাস্ক রয়েছে। কিন্তু মাস্ক পরে তো আর খাওয়া-দাওয়া করা যাবে না তাই খুলে রেখেছি। এমনকি মাস্ক ব্যবহারে অনীহা হাসপাতালগুলোতেও। রাজধানীর কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে বিভিন্ন রোগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা তো দূরে থাক তাদের সঙ্গে আসা স্বজনদের মধ্যেও মাস্ক ব্যবহারে চরম অনীহা। রাজধানীর জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গাইবান্ধা থেকে চিকিৎসা করাতে এসেছেন প্রিন্স তালুকদার। অপারেশন হয়ে গেছে গত সপ্তাহে। এখন সুস্থতার পথে। সঙ্গে স্ত্রী এবং মামাতো ভাই রয়েছেন। ক্যান্সারের মতো সংবেদনশীল একটি রোগে আক্রান্ত হয়েও মাস্ক পরার কোন আগ্রহ নেই প্রিন্সের। মাস্ক নেই তার স্ত্রী কাকলীর মুখেও। বলেন, এইখানেই তো গত একমাস ধরে আছি। নিজের বাড়ির মতোই হয়ে গেছে সব। বাড়িতে কি আর কেউ মাস্ক পরে থাকে ? পরিস্থিতি এ রকম চলতে থাকলে মধ্য জানুয়ারিতে দেশজুড়ে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডাঃ এ বি এম আব্দুল্লাহ। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে করোনার কয়েকটি ঢেউ মোকাবেলা করেছি। হারিয়েছি কত প্রিয়জনকে। ওমিক্রনসহ করোনার অন্যান্য ভেরিয়েন্ট আবারও নিজেদের দৌরাত্ম্য বাড়াচ্ছে পুরো পৃথিবীতে। দেশেও আমরা সেই আভাস পাচ্ছি। এই মুহূর্তে স্বাস্থ্যবিধি না মানলে পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। সবারই উচিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। আর কিছু না হউক অন্তত ঃ মাস্কটা পরা বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রয়োজনে প্রশাসনকে কঠোর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। মহামারী সতর্কতায় স্কুল-কলেজে স্বাস্থ্যবিধি কঠোর করার তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রয়োজনে বন্ধের কথাও বলেন তারা। দেশব্যাপী করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় ইতোমধ্যে সশরীরে ক্লাস বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের দাফতরিক সকল কার্যক্রম চালু থাকলেও আগামী রবিবার থেকে অনলাইনে ক্লাস চালানোর ঘোষণা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। স্বাস্থ্যবিধি মানতে কঠোর হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও। প্রয়োজনে সশরীরে ক্লাস বন্ধ করার প্রস্তুতিও রয়েছে কর্তৃপক্ষের। বৃহস্পতিবার এক জরুরী নির্দেশনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানায়, করোনাভাইরাসের নতুন ভেরিয়েন্ট ওমিক্রনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল খোলা রাখা ও সশরীরে পাঠদান কার্যক্রম ব্যাহত হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সশরীরে শিক্ষা ও পরীক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে মাস্ক পরিধানসহ যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করার জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্টদের বিশেষভাবে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয় করোনার সংক্রমণ রোধে সবগুলো স্কুল-কলেজে বাড়তি সচেতনতার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক যে প্রবাহ তার প্রেক্ষিতেই বাংলাদেশে এই অবস্থা। তবে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত পরীক্ষার বিবেচনায় ওমিক্রন শনাক্ত কম। কিন্তু জিনোম সিকোয়েন্সসহ সঠিকভাবে পরীক্ষা করা হলে এটি কি পরিমাণ হবে তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। তাই এ মুহূর্তে স্বাস্থ্যবিধি মানতে নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে। এতদিন যে ভাষায় বলা হয়েছে তাতে মানুষের গা সওয়া হয়ে গেছে। তাই এবার নতুন কৌশল প্রয়োগ করতে হবে। টিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে একটা অনীহা তৈরি হয়েছে। সুরক্ষা এ্যাপে এখন পর্যন্ত টিকা নিতে নিবন্ধন করেছেন মাত্র কিছু মানুষ। এক্ষেত্রেও নতুন কৌশল ব্যবহার করতে হবে। মাস্ক পরার ক্ষেত্রে পাড়া-মহল্লায় ঘরে ঘরে গিয়ে মাস্ক বিতরণ করতে হবে। কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশনের সময় প্রয়োজনীয় সহায়তার জন্য একটা স্বেচ্ছাসেবী গ্রুপ তৈরি করতে হবে। একইভাবে স্মার্টফোন বা ইন্টারনেটের স্বল্পতায় যারা টিকার জন্য নিবন্ধন করতে পারছেন না তাদের জন্য স্বেচ্ছাসেবী গ্রুপটা কাজ করবে। তিনি বলেন, সর্বোপরি করোনা প্রতিরোধে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। একইভাবে লকডাউন-শাটডাউন-বিধিনিষেধ শব্দের বাইরে গিয়ে নতুন পরিকল্পনার প্রয়োজন। এদিকে বিশ্বব্যাপী করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের ব্যাপক সংক্রমণ ঘটলে বাংলাদেশে মাত্র গুটিকয়েক রোগীর আক্রান্তের তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। নতুন বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ৩ হাজারের বেশি সংক্রমিত হলেও ওমিক্রনে আক্রান্ত কি না এ ব্যাপারে কিছুই পরিষ্কার করেনি প্রতিষ্ঠানটি। এক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে উল্লেখ করে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ এম ইকবাল আর্সলান বলেন, ওমিক্রনে আক্রান্তের সংখ্যা জানার জন্য অধিকসংখ্যক জিনোম সিকোয়েন্সিং করা প্রয়োজন। কিন্তু সে জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক ল্যাবরেটরি আমাদের নেই। হাতে গোনা কয়েকটি ল্যাবরেটরিতে কিছু জিনোম সিকোয়েন্সে হচ্ছে যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এরজন্য আমাদের সক্ষমতা। কিন্তু এটি অনেক ব্যয়বহুল। তিনি বলেন, তবে ভেরিয়েন্ট যাই হউক আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে এটাই সবচেয়ে বড় কথা। সরকার যেসব নির্দেশনা দিয়েছে সেগুলো মেনে চলতে হবে। প্রয়োজনে জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। ঘরে ঘরে মাস্ক পৌঁছে দেয়ার পাশাপাশি কোয়ারেন্টাইন-আইসোলেশন নিশ্চিত করতে হবে।
×