ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

শিল্প সৃজন শিল্প অন্বেষণ

প্রকাশিত: ২১:৪২, ৩ ডিসেম্বর ২০২১

শিল্প সৃজন শিল্প অন্বেষণ

নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের নাটকীয় চরিত্র হ্যামলেট কি পড়ছো প্রশ্নের উত্তরে রহস্য নিয়ে বলে, ‘কথা, কথা আর কথা’। কথার মাঝে যদি ভাব-বিষয়-দর্শন না থাকে তবে সেটা শুধুই কথার কথা। কাজের কথা না। কথা হবে কাজের আর কাজ হবে মানুষের বিকাশ এবং প্রকাশের বিশ্বাসে বিশ্বাসী বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির বর্তমান মহাপরিচালক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব লিয়াকত আলী লাকী। তাঁর স্পস্ট-দৃঢ় এবং প্রায়োগিক উচ্চারণ, ‘শিল্প নির্মাণ, অনুধাবন, সমালোচনা, লেখালেখি এই বিষয়গুলো চর্চার বিষয়। স্বাভাবিক প্রবণতায় একজন শিল্পী শিল্প সৃজন করতেই পারেন, কিন্তু সামগ্রিক অর্থে জেনে-বুঝে শিল্প নির্মাণ হবে, সবাই সেটা অনুধাবন করবে। আর সে জন্য শিল্প নিয়ে সমালোচনা ও লেখালেখি হওয়া দরকার। এই জানা-বোঝার গ-িটাও হতে হবে সংকীর্ণ গ-ির মধ্যে আটকে না থেকে বৃহত্তর গ-িতে। প্রাচ্য যেমন নিজের প্রাচুর্যতা জেনে পাশ্চাত্যকে জানবে, তেমনি বর্তমান জানবে লুপ্তপ্রায় অতীতকে। বর্তমানের শিল্পী যেমন তার ক্যানভাসে তুলে ধরবে সমকালকে, তেমনি বিষয়গত প্রয়োজনে মহাকালকে জায়গা করে দেবে সৃজনের বৃহত্তর গ-িতে। এই সৃজন প্রক্রিয়া চলবে শিল্পের সকল শাখায়’। সেই আদর্শগত ভাবনা থেকে ২০১৯ সালের ২৩ জুলাই দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ও কর্মবীর লিয়াকত আলী লাকীর ভাবনাও কর্ম পরিকল্পনায়, সংস্কৃত বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সার্বিক সহযোগিতায়, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে, শিল্পের পাঁচটি শাখা যথাক্রমে- চলচ্চিত্র, চরুকলা, নাটক, সঙ্গীত ও নৃত্যকলা বিষয়ে বাস্তবায়িত হয় এ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স ২০১৯। করোনা উত্তর স্থবিরতা কাটিয়ে উঠে লিয়াকত আলী লাকী এবার আরও বিষয়ের বিস্তৃত এবং গভীরে ধাবমান। শিল্পের পাঠ-অনুশীলন-আত্তিকরণ শুধুমাত্র রাজধানী কেন্দ্রিক শিল্পীদের মধ্যে আটকে থাকতে পারে না, এবার সেটিকে ছড়িয়ে যেতে হবে ৬৪টি জেলার মধ্যে দিয়ে সারা বাংলাদেশের উদীয়মান শিল্পীদের হৃদয়েরর মর্মমূলে। আর সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে ও চারুকলা বিভাগের বাস্তবায়নে, বাংলাদেশ চারুশিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমের প্রথিতযশা শিল্পী ও শিক্ষকদের অংশগ্রহণে, চিত্রকলা-ভাস্কর্য-স্থাপত্য-ফটোগ্রাফি-ডিজাইন-নিউমিডিয়া প্রভৃতি আর্ট মাধ্যমে গত ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১ থেকে আরম্ভ হয়ে ৩০ নবেম্বর ২০২১ পর্যন্ত, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার হলে, সারাদেশে ভার্চুয়াল সংযুক্তির মাধ্যমে এবং বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর পরিদর্শনে মধ্যে দিয়ে উদযাপিত হলো ২ মাসব্যাপী আর্ট এ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স ২০২১। ২১ কিংবা ২২ শের বয়স বিবেচনায় না বরং উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ এবং তদুর্ধ এবং ৫৫ ঢাকা মহানগরীর শিল্প শিক্ষার্থী এবং অবশিষ্ট সারাদেশের প্রতিটি জেলা থেকে দুজন করে মোট ১৫৫ শিল্প শিক্ষার্থীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশ গ্রহণের মধ্যদিয়ে অনুষ্ঠিত হওয়া আর্ট কোর্সটিকে প্রাজ্ঞতা-জীবনবোধ এবং প্রাণচঞ্চল বিশ্লেষণী মনোমুগ্ধকর উপস্থাপনা দিয়ে এগিয়ে নিলেন বরেণ্য শিল্পী ও শিক্ষক সমরজিৎ রায় চৌধুরী, বুলবুল ওসমান, হাশেম খান, নিসার হোসেন, ফরিদা জামান, ড. রশীদ আমীন, ড. একেএম শাহনেওয়াজ, কানিজ সোহানী ইসলাম, সঞ্চয় চক্রবর্তীসহ আরও অনেক গুণীজন। কোর্স পরিচালক ও শিল্প সমালোচক মইনুদ্দিন খালেদের নিখুত এবং অর্থপূর্ণ কর্মকৌশলে অফলাইন এবং অনলাইনে এই শিল্পভ্রমণ ছিল বিষয়গত দিক দিয়ে জ্বল-স্থল-অন্তরীক্ষ থেকে শিল্পের হীরা-মণি-মুক্তা আহরণের আর আঙ্গিক গত দিক দিয়ে ঐতিহ্য-আধুনিকতা ছুঁয়ে উত্তর আধুনিক শিল্পরীতির সর্বশেষ নব্য ইজমকে আত্তিকরণের মধ্যে দিয়ে। আত্তিকরণের স্বার্থেই শিল্পের অনুশীলন অনুধাবন আর কল্পনা জাগরণে শিক্ষক-ছাত্রদের এক যেন শিল্পবিশ্ব ভ্রমণ। ইউরোপের সাংস্কৃতিক জাগরণের পথে গ্রীস, রোম, প্যারিস হয়ে আজকের ইংল্যান্ড, পারস্যের জাগরণের পথে ইরাক-ইরান হয়ে আজকের আফগান, প্রাচ্যের জাগরণে মুঘল মিনিয়েচার হয়ে বেঙ্গল স্কুল অফ আর্ট ছুঁয়ে আজকের চারুকলা অনুষদ। রিয়েলিজম, ইমপ্রেশনিজম, এক্সপ্রেশনিজম, কিউবিজম থেকে শুরু করে ডাডা ইজম, স্যুরিয়ালিজম, এ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজমগত কোন আঙ্গিক রীতি যেমন বোঝাতে বুঝতে বরেণ্য শিক্ষকেরা কার্পণ্য বোধ করেননি তেমনি শিল্প মনোস্ক ছাত্র-ছাত্রীরা চিত্রকলা-ভাস্কর্য-স্থাপত্য-ফটোগ্রাফি-ডিজাইন-নিউমিডিয়ার আকার এবং সত্তা বুঝে নিতে অনাগ্রহবোধ করেনি। জ্ঞানর্জনে ক্লান্তি এলে শিক্ষার্থীরা সুযোগটাকে বোঝা হিসাবে না নিয়ে বরং বুঝে ওঠাটাকে প্রাণবন্ত করতে প্রতিদিনের দুই ক্লাসের মধ্যবর্তী ১৫ মিনিট বিরতি সময়ে মুখে তুলে নিয়েছে মিনারেল ওয়াটার-¯œ্যাকস আর ঘ্রাণ ছড়ানো এক মগ কফি। আয়োজক শিল্পকলা একাডেমি জানে, শিক্ষার্থীর দেহ মন সজীব থাকলে মেধার বৃদ্ধি ঘটে। মেধার বৃদ্ধি তথা বিকাশ ঘটাতে একদিন মিজারুল কায়েস এবং আব্দুর রাজ্জাকের চোখে চোখ রেখে বর্তমান বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সহযোগী শিক্ষা অফিসার সৈয়দ শামছুল করিম ও প্রদর্শক প্রভাষক সোহেল মাসুদ শিখেছিল কিভাবে যাদুঘরের প্রদর্শনশালায় সংরক্ষিত চিত্রকর্ম দেখতে হয়। চারুকলা বিভাগের গাইড লেকচারার মোঃ মাহাবুবুর রহমান (সুজন) এর তত্ত্বাবধানে ঢাকার অংশগ্রহণকারী শিল্পশিক্ষার্থীদের নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘরের বিজ্ঞ কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ জাদুঘর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন শিল্পের নন্দনতত্ত্ব, শিল্পকলার ভাষা, সভ্যতার ইতিহাস, রেনেসাঁ যুগ থেকে পোস্টমডার্নিজম পর্যন্ত, পাল যুগের চিত্রকলা, মুঘল মিনিয়েচার থেকে বেঙ্গল স্কুল, বাংলাদেশের অসংখ্য রতœখচিত শিল্পের স্বর্ণ-মণি-মুক্তা। আর সে কারণেই বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী শিল্প শিক্ষার্থীদের হাতে আর্ট এ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সের সনদ প্রদান শেষে বললেন, ‘১৯৭৪ সালে শিল্পের সর্বাঙ্গীন কল্যাণ সাধন, প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। বর্তমানে আমাদের প্রধানমন্ত্রী সেই লক্ষ্যপূরণে সর্বোচ্চ আন্তরিক। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আন্তরিকভাবে সচেষ্ট সংস্কৃতির জাগরণের ঢেউ সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে, পাশাপাশি বিশ্ব সংস্কৃতির মানচিত্রে স্বতন্ত্র পরিচয়ে বাংলাদেশের শিল্পীদের তুলে ধরতে। এ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স সম্পন্ন করার মধ্যে দিয়ে এক ঝাঁক শিক্ষার্থী আরও ভালভাবে শিল্প নির্মাণ, শিল্প অনুধাবন এবং শিল্প সমালোচনায় দক্ষতা ও প্রাজ্ঞতা দেখাবে বলেই বিশ্বাস। আর সেটি হলেই সার্থক আর্ট এ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সের সকল আয়োজন যার প্রধানতম লক্ষ্য শিল্প সৃজন শিল্প অন্বেষণ।
×