ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ বাসেত মজুমদার আমাদের প্রেরণা

প্রকাশিত: ২২:০৭, ২৯ অক্টোবর ২০২১

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ বাসেত মজুমদার আমাদের প্রেরণা

জীবন চলার পথে কিছু ভিন্ন ধাঁচের মহত মানুষের দেখা মেলে, যারা সংখ্যায় কম কিন্তু স্মরণে ভাস্বর। আমাদের প্রাণপ্রিয় বিজ্ঞ আইনজীবী বাসেত মজুমদার সব সময়ই ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী বিশিষ্টজন-যার সাক্ষাতে চিত্ত বিকশিত হতো, হৃদয় শ্রদ্ধায় সিক্ত হতো। সদা হাস্যময়, স্বতঃস্ফ‚র্ত, সজ্জন ও আস্থার বরপুত্র ছিলেন তিনি। দীর্ঘ ওকালতি জীবনের পথ সাফল্যের সঙ্গে পাড়ি দিয়েছিলেন বহু ত্যাগ-তিতিক্ষায় আর অন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। এভাবেই ধীরে ধীরে অতিক্রম করেছিলেন বাধার বিন্ধ্যাচল। অসাধারণ গুণ ও প্রতিভার অধিকারী আবদুল বাসেত মাজুমদার আইন জগতে ইতিহাস হয়ে রইবেন। ২৭ অক্টোবর ২০২১ তিনি আমাদের ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন অনিবার্য গন্তব্যে। তার আত্মার শান্তি কামনা করছি। তাকে সম্মান জানিয়ে তার মৃত্যুর দিন সুপ্রীমকোর্ট ও ঢাকা কোর্টের বিচার কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এই নজির বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম, এটিও একটি ইতিহাস। যিনি আনন্দ, দুঃখ-বেদনা, হাসি-কান্না সবটাকে নির্লিপ্তভাবে গ্রহণ করতে পারেন, যিনি আনন্দে উদ্বেল হন না, দুঃখে ভেঙ্গে পড়েন না, যিনি ভয় এবং ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, তিনিই যথার্থ জ্ঞানী। তিনিই প্রকৃত সাধক এবং ঋষি। বিজ্ঞ আইনজীবী বাসেত মজুমদার তার জীবদ্দশায় আন্তরিক সাধনার মধ্য দিয়ে প্রতি মুহূর্তে নিজেকে উত্তরণের চেষ্টা করেছেন। সেই সাধন পথেরই কিছু ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি আলোচ্য প্রবন্ধে। আবদুল বাসেত মজুমদার আইন পেশায় ৫৬ বছর পার করেছেন। অত্যন্ত সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি তার পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছেন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে তিনি অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। গুরুত্বপূর্ণ আইনী বিষয়ে তিনি আদালতকে সব সময় সহযোগিতা করেছেন। তিনি ছিলেন সর্বজনশ্রদ্ধেয়। দরিদ্র মানুষের আইনজীবী হিসেবে তিনি ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিলেন। বাংলাদেশের আইনজীবী সম্প্রদায় চিরকাল তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। দেশের প্রবীণ আইনজীবী ও আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল বাসেত মজুমদার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি, সম্পাদকসহ বিভিন্ন পদে। তিনি আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীদের সংগঠন সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের আহ্বায়ক ও বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদের সভাপতি ছিলেন। আবদুল বাসেত মজুমদারের জন্ম ১৯৩৮ সালের ১ জানুয়ারি কুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলার শানিচৌঁ গ্রামে। লাকসামের হরিচ্চর হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন (এসএসসি), কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও বিএ পাস করেন তিনি। এরপর ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে এমএ এবং ১৯৬৩ সালে এলএলবি ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৬৬ সাল থেকে আইন পেশায় নিয়োজিত। বাবার ইচ্ছায় আইন পেশায় আসার পর তিনি এ অঙ্গনে নিজেকে খ্যাতিমান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। বাসেত মজুমদার স্যারের ওকালতি ও রাজনৈতিক জীবন বর্ণাঢ্য। কুমিল্লার একজন সাধারণ মানুষ ঢাকায় এসে বাংলাদেশের আইনজীবী মহলে সমাদৃত ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তার নিজস্ব কর্মকৌশল আর বুদ্ধিদীপ্ত ওকালতির জন্য। কেউ একবার তার সান্নিধ্যে গেলে তার ভক্ত বনে গেছেন। প্রকৃতপক্ষে আমরা যারা আইনজীবী তাদের সকলের জন্য তিনি ছিলেন একটি সুউচ্চ স্তম্ভ। সাধারণভাবে তার সঙ্গে মিশে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল আমার জীবনে। আমি একদম কাছ থেকেই দেখেছি তার সরলতা। ব্যক্তিজীবনে তিনি সহজ-সরল, নিবেদিত, আদর্শবাদী সজ্জন একজন মানুষ ছিলেন। লোভ-লালসা, চাওয়া-পাওয়ার উর্ধে থেকেই তিনি এ পর্যায়ে উঠে এসেছিলেন। তিনি মানুষের সান্নিধ্য পেলে খুশি হতেন। যে কোন মানুষকে দেখলেই তিনি যেন তার মনের কথা বুঝতে পারতেন। তিনি মানুষের চাহিদা বুঝতে পারতেন, সাধ্যমতো অনেকের অভাব-অভিযোগ মেটাতে সচেষ্ট থাকতেন। তিনি একজন পরম ধৈর্যশীল মানুষ ছিলেন। এই সরলতা, ধৈর্য গুণ, নিষ্ঠা, একাগ্রতা, সততা, উপকারী মনোভাব, উদারতা, মানবপ্রেম, অসাম্প্রদায়িকতা তাকে দেশের আইনজীবী মহলে সর্বোচ্চ আসনে আসীন করেছে। তার কথা ও কাজের সমন্বয় এত দৃঢ় ও আস্থাশীল ছিল যে, তা কম মানুষের চরিত্রেই দেখা যায়। আমি নীলফামারী থেকে ঢাকায় এলেই বাসেত মজুমদার স্যারের সঙ্গে তার বনানীর বাসায় দেখা করতাম। আমার সঙ্গে স্যারের কথোপকথন হতো রাজনীতি, আইন এবং আমার লেখা নতুন কোন গ্রন্থ নিয়ে। স্যার আমাকে জাহাঙ্গীর আলম সরকারের পরিবর্তে আমার ডাকনাম সাগর নামেই ডাকতে পছন্দ করতেন। এ বিষয়ে স্যারের বক্তব্য ছিল¯‘আমি চাই তুমি একদিন তোমার অবস্থান সাগরের মতো বৃহত আকারে ছড়িয়ে দেবে এবং তোমার জ্যোতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে আইনাঙ্গন।’ অসুস্থ থাকার দিনগুলোতে স্যারের সঙ্গে কতদিন যে ফোনে কথা বলেছি সে কথা আজ লিখে বোঝাতে পারব না। আজ শুধু স্যারের উপদেশ আর আলাপচারিতাগুলো আমার ওকালতি জীবনের প্রেরণা হয়ে রইল। সম্প্রতি আমার লেখা ‘দ্রæত বিচার বিষয়ক আইনের ভাষ্য’ শীর্ষক গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে। গত জুন মাসে আমি তার কাছে পাণ্ডুলিপি নিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি অসুস্থ শরীরে আমার সঙ্গে আলাপচারিতায় উচ্ছ¡সিত ছিলেন। এরপর আমি নীলফামারী ফিরে এলাম। দিনকয়েক পরে ফোন করলাম, ফোন রিসিভ করেই স্যার বললেন, ‘সাগর, আমি তোমার পাণ্ডুলিপি পড়েছি। হাইকোর্ট আর সুপ্রীমকোর্টের নজিরের বাংলা অনুবাদ এবং ভাষ্য সংযোজনের পাশাপাশি বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের সমাবেশ ঘটিয়ে আইনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ উপস্থাপন করে বইটির কাজ ভালই করেছ তুমি। আমি তোমার অনুরোধেই শুধু নয়, বরং আইনের এই বিষয়টির প্রতি আমার একান্ত অনুরাগ থাকার কারণে তোমার এই গ্রন্থটিতে মুখবন্ধ লিখব।’ অবশেষে স্যার অসুস্থ শরীর নিয়ে মুখবন্ধটি লিখেছিলেন। গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর একদিন স্যারকে ফোন করে বললাম, ‘স্যার, বইটি প্রকাশিত হয়েছে। আমি কুরিয়ারে আপনার ঠিকানায় পাঠিয়ে দেব কি?’ অন্য প্রান্ত থেকে দরাজ কণ্ঠে স্যার বললেন, ‘সাগর, তুমি যখন ঢাকা আইবা তখন বইটি লইয়া আমার বাড়িতে আইবা।’ কিন্তু আমার সেই পরম সৌভাগ্য হলো না। আমি স্যারের পা ছুঁয়ে আরেকবার সালাম করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলাম। ব্যক্তিগত জীবনে আবদুল বাসেত মজুমদার ছিলেন অমায়িক, বিনয়ী ও ভদ্র। সবার সঙ্গে ছিল তার সমান ব্যবহার। তিনি সব সময় সাধারণ মানুষকে মূল্যায়ন করতেন। আমি কোন দিন শুনিনি কোন মানুষ তিনি যত সাধারণই হোন না কেন তার সাক্ষাত থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এ তার বিরল গুণ। সত্যিকারভাবে যারা সাধারণ মানুষকে ভালবাসেন, তারাই এমন উদার মানসিকতার অধিকারী হতে পারেন। বিজ্ঞ আইনজীবী আবদুল বাসেত মজুমদার আমাদের সামনে সেই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যিনি গরিব-অসহায় মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, ন্যায়বিচার প্রাপ্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন। শুধু একজন আইনজীবী নন বরং একজন অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির অন্যতম পুরোধা ছিলেন তিনি। দল-মত, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে তিনি সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ও সমাদৃত ছিলেন। তার মতো নীতিবান, প্রজ্ঞাবান, সর্বজন সমাদৃত, সৎ ও নির্লোভ চরিত্রের আইনজীবী যে কোন সভ্য সমাজের এক অমূল্য সম্পদ। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও বিচারপ্রার্থীদের আইনী সহায়তা প্রদানে বাসেত মজুমদারের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার মৃত্যু দেশের আইন অঙ্গনের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। তার মৃত্যুতে দেশ একজন দক্ষ আইনজীবীকে হারাল। বাসেত মজুমদার স্যার আমাদের কাছে প্রেরণার উৎস। আমার হৃদয় গভীর থেকে বিনম্র উচ্চারণ- মহান আল্লাহ পাক তাকে যেন জান্নাতবাসী করেন। নন্দিত এই আইনজীবীর সকল সফল কর্ম যেন আগামী প্রজন্মের আইনজীবীদের পাথেয় হয়ে থাকে। তার জীবন ও জীবনাদর্শ অনাগত ভবিষ্যত প্রজন্মকে আলোকিত মানুষ এবং সফল আইনজীবী হতে অনুপ্রেরণা দেবে। লেখক : আইনজীবী ও পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]
×