ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

রায়হান আহমেদ তপাদার

জলবায়ু পরিবর্তনে হুমকির মুখে বিশ্ব

প্রকাশিত: ২০:০১, ২৪ অক্টোবর ২০২১

জলবায়ু পরিবর্তনে হুমকির মুখে বিশ্ব

২০১৫ সালের ঐতিহাসিক প্যারিস সম্মেলনের ধারাবাহিকতায় আসছে নবেম্বরে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে জড়ো হবেন বিশ্বনেতারা। প্যারিসে প্রথমবারের মতো বিশ্বের সব দেশই কার্যত জলবায়ু ইস্যুতে একমত হয়েছিল। ঘোষণা এসেছিল, সবাই একযোগে কাজ করবে। সমস্যাটা হচ্ছে, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দেশগুলো কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। প্যারিস চুক্তিতে দেশগুলো বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি প্রাক-শিল্পযুগের (১৮৫০-১৯০০) চেয়ে দুই ডিগ্রী সেলসিয়াসের অনেক নিচে রাখতে সম্মত হয়েছে। তবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার চেষ্টার কথাও বলা হয়েছে। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন-ডাই অক্সাইড নির্গমন ৪৫ শতাংশ কমানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিরপেক্ষ হওয়ার লক্ষ্যও নির্ধারণ করা হয়েছে। সার্বিকভাবে, জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানোর প্রচেষ্টায় আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তবে সবটা হয়ে গেছে, এটা বলার সময় আসেনি। অনেক দেশ উচ্চাভিলাস নিলেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাস্তবসম্মত কৌশল ঠিক করেছে হাতে গোনা কয়েকটি। এ অবস্থায় গ্লাসগো সম্মেলনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, দেশগুলোকে এমন নীতিমালায় সই করানো, যা কার্বন নিঃসরণ কমানোর কাজটা শুরু করবে এখনই। এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রতিবছরে ৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা ওঠে এমন দিনের সংখ্যা ১৯৮০’র দশকের তুলনায় এখন দ্বিগুণ বেড়েছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল চেঞ্জ ইনস্টিটিউটের সহযোগী পরিচালক ডক্টর ফ্রিডরিক অটো মন্তব্য করেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই প্রবণতার কারণ হিসেবে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধিকে ১০০% দায়ী করা যায়। সারাবিশ্ব যখন উষ্ণতর হচ্ছে, তাপমাত্রা অত্যন্ত উচ্চ হওয়ার সম্ভাবনা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই উচ্চ তাপমাত্রা মানুষ এবং পরিবেশ উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর। এছাড়া উচ্চ তাপমাত্রা দালানকোঠা, রাস্তাঘাট এবং পাওয়ার সিস্টেমেরও ক্ষতিসাধন করতে সম্ভব। সাধারণত মধ্যপ্রাচ্য এবং উপসাগরীয় অঞ্চলেই তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াস হয়ে থাকে। প্রতি দশকে যেভাবে বাড়ছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা তা বিস্ময়কর। এই গ্রীষ্মে ইতালি (৪৮.৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস) ও কানাডায় (৪৯.৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস) রেকর্ড তাপমাত্রা পরিলক্ষিত হওয়ার পর বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন যে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার না কমালে বিশ্বের অন্যান্য জায়গাতেও ৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের ওপর তাপমাত্রা অনুভূত হতে পারে। আমাদের দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। বিবিসি’র এক বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে একটি ডকুমেন্টারি সিরিজ আরম্ভ হয়েছে, যার নাম ‘লাইফ এ্যাট ৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াস’। এই সিরিজের মাধ্যমে যাচাই করার চেষ্টা করা হয়েছে যে অত্যন্ত উচ্চ তাপমাত্রা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মানুষের জীবনকে কিভাবে প্রভাবিত করছে। ৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রার ওপরেই নয়, এর নিচের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতাও মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। বর্তমান হারে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়তে থাকলে ২১০০ সালের মধ্যে পৃথিবীর ১২০ কোটি মানুষ তাপমাত্রাজনিত চাপের ফলে শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যেই সংখ্যাটি বর্তমানের তুলনায় অন্তত চার গুণ বলে উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায়, যেটি গত বছর প্রকাশিত হয়েছে। অতি উচ্চ তাপমাত্রার কারণে খরা এবং দাবানলের সম্ভাবনা বাড়তে থাকায় মানুষের পারিপার্শ্বিক পরিবেশও পরিবর্তন হচ্ছে এবং জীবনযাপন কঠিন করে তুলেছে। এই ধরনের ঘটনার পেছনে অন্যান্য কারণের ভূমিকা থাকলেও মরুকরণের অন্যতম প্রধান কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার ডেথ ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক বিশ্বের উষ্ণতম স্থানগুলোর একটি। গ্রীষ্মে পার্কটির বিশেষ বিশেষ জায়গার তাপমাত্রা নিয়মিতভাবে ৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের বেশি থাকে। কিন্তু এই পার্কের আশপাশের এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এলাকার গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যখন মাপা হয়, তখন গড় তাপমাত্রার মান ৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে থাকে। এই গবেষণাটি করতে ইউরোপের কোপারনিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিসের তৈরি বৈশ্বিক ইআরএ৫ ডাটাসেট থেকে দৈনিক সর্বোচ্চ তাপমাত্রার তথ্য নেয়া হয়েছে। জাতিসংঘের একটি বিজ্ঞানী প্যানেল হুঁশিয়ার করেছে মানুষের নানা কর্মকান্ডের পরিণতিতে অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে এখন দ্রুত হারে সাগর-পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে এবং বরফ গলছে। সেই সঙ্গে, জীবজন্তুর বিভিন্ন প্রজাতি তাদের আবাসস্থল বদলাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বরফের আচ্ছাদন বিলীন হওয়ার কারণে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। ফলে পরিস্থিতি দিনকে দিন বিপজ্জনক হয়ে পড়ছে। আইপিসি বা জলবায়ু বিষয়ক আন্তর্জাতিক প্যানেলের সাম্প্রতিক একটি বিশেষ রিপোর্টে এসব চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। গত এক বছরের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে এটি তাদের তৃতীয় রিপোর্ট। এর আগে বিজ্ঞানীরা বোঝার চেষ্টা করেছেন, এই শতকের শেষভাগে গিয়ে যদি বিশ্বের তাপমাত্রা ১.৫ শতাংশ বেড়ে যায়, তার পরিণতি কী হতে পারে। সর্বশেষ এই রিপোর্টে দেখা হয়েছে, তাপমাত্রার বাড়ার কারণে সমুদ্র এবং বরফে আচ্ছাদিত অঞ্চলের ওপর তার প্রভাব কী হতে পারে। বিজ্ঞানীরা এবার যা পেয়েছেন, তা আগের রিপোর্টগুলোর তুলনায় অনেক ভীতিকর। খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে সাগর-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাড়ছে, বরফ গলছে দ্রুতহারে এবং এর প্রভাব পড়ছে পুরো বিশ্বের প্রাণীজগতের ওপর। ব্লু-প্ল্যানেট (পৃথিবী) এখন মহাসঙ্কটে। বিভিন্ন দিক থেকে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে এবং এর জন্য আমারাই দায়ী। আইপিসিসির নতুন এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২১০০ সাল নাগাদ সাগর-পৃষ্ঠের উচ্চতা ১.১ মিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। আগের ধারণার চেয়ে এই উচ্চতা ১০ সেমি বেশি। আমরা নজিরবিহীন কিছু বিপদের ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছি, বলছেন আইপিসিসি প্যানেলের অধ্যাপক ডেরা রবার্টস। আপনি যদি স্থলভাগের খুব ভেতরেও বসবাস করেন, তাহলেও সাগর এবং পরিবেশে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে আপনি নিরাপদে থাকতে পারবেন না। যেভাবে আপনার জীবনযাপন প্রভাবিত হতে পারে বন্যার ক্ষতির মাত্রা দুই থেকে তিনগুণ বাড়তে পারে। যদিও কার্বন ডাই অক্সাইডের মতো নয় মিথেন। এই গ্যাস বায়ুম-লে খুব অল্প কিছু সময়ের জন্য থাকে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য এটি কার্বন ডাই অক্সাইডের চেয়েও অনেক বেশি ক্ষতিকর। করোনাভাইরাস মহামারীর লকডাউন সত্ত্বেও গত বছর বায়ুমন্ডলে যে পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড ও মিথেন গ্যাস পাওয়া গেছে সেটা একটা রেকর্ড। এ বছরের এপ্রিল মাসে ব্লুমবার্গ মিডিয়ায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছে যেসব দেশ তার একটি বাংলাদেশ। আমাদের দেশেও প্রচুর পরিমাণে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হচ্ছে। প্যারিসভিত্তিক কোম্পানি কেরস এসএএস স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবি ও তথ্য বিশ্লেষণ করে তারা মিথেনের অন্যতম উৎস হিসেবে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাকে চিহ্নিত করেছে। আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও তাদের গবেষণায় পেয়েছে একই ধরনের ফল। ব্লুফিল্ড টেকনোলজিসের প্রতিষ্ঠাতা ইওতাম এরিয়েল বলেছেন, তাদের বিশ্লেষণেও দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশে প্রচুর মিথেন উৎপন্ন হচ্ছে। এই গ্যাসের উৎস সম্পর্কে কিছু ইঙ্গিতও দেয়া হয়েছে যার মধ্যে রয়েছে ধান ক্ষেত, ময়লা আবর্জনার ভাগাড় বা ল্যান্ডফিল, কয়লার মজুদ, পাইপলাইনের ছিদ্র দিয়ে প্রাকৃতিক গ্যাস বের হয়ে আসা ইত্যাদি। বর্ণ ও গন্ধহীন এই মিথেন গ্যাস যখন ওপরে উঠে যায় তখন সেটা তাপকে আটকে রাখে। মিথেন গ্যাসের এই ক্ষমতা কার্বন ডাই অক্সাইডের চেয়েও অনেক বেশি। তাপকে আটকে রাখার মাধ্যমে এই গ্যাস বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান একটি কারণ। এই মিথেন গ্যাসের নির্গমন কিভাবে কমানো সম্ভব তা বিবেচনায় রাখতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় আমাদের বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দরকার নেই, আমাদের প্রযুক্তিগত সহায়তা দরকার, উত্তম ব্যবস্থাপনা দরকার। এটি মোকাবেলায় উন্নত দেশগুলোকে যেমন আর্থিক সহায়তা দিতে হবে, তেমনি প্রাপ্ত অর্থ সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশের ন্যায় ভুক্তভোগী দেশগুলোর পরিকল্পিত নীতি প্রণয়ন জরুরী। লেখক : গবেষক
×