ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

হে জলবায়ু- এবার পশ্চিমে তোমার অভিশাপ!

প্রকাশিত: ২০:২৬, ৫ আগস্ট ২০২১

হে জলবায়ু- এবার পশ্চিমে তোমার অভিশাপ!

বেশ ক’বছর ধরে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্রে দাবানল শুরু হয়েছিল যে দাবানলগুলো দীর্ঘ সময় ধরে জ্বলেছিল এবং ফলে অস্ট্রেলিয়ায় হাজার কয়েক বন্য প্রাণী নিহত হয়েছিল। বিগত বেশ কিছু বছর ধরে ইউরোপের কিছু দেশে বিশেষত ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেনে উচ্চ দাবদাহে মানুষ মারা গেছে। অস্ট্রেলিয়ায় ভয়াবহ এক ঝড় ও বন্যায় দেশের একটি বড় অংশ কাদামাটি-জোয়ারের পানিতে মানুষের ঘরবাড়ি, বসতি ডুবে যায়! এ বছর আকস্মিকভাবে কানডার পশ্চিমাঞ্চলে তাপ পঞ্চাশ ডিগ্রী সেলসিয়াসের উপরে ওঠায় বৃদ্ধাবাসের শত শত বাসিন্দার মৃত্যু হয়। এর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঐ অঞ্চলে অসংখ্য বজ্রপাত হয় যার ফলে লাখ লাখ একর বনভূমি দাবানলের কবলে পরে পুড়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমের ক্যালিফোর্নিয়ায়ও তাপমাত্রা পঞ্চাশে উঠে যায় এবং এ অঞ্চলের বনভূমিতেও দাবানলের প্রকোপ দেখা দেয়। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেও তাপমাত্রা পঞ্চাশের বেশি হয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়েছে। অতি সম্প্রতি জাপানে, জার্মানিতে, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডসে পরে ইংল্যান্ডে যে ভারি বৃষ্টিপাত হয় তাতে দেখা গেল জাপানে ভূমিধস হয়ে প্রাণহানি হয়েছে, বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে, জার্মানিসহ ইউরোপীয় দেশগুলোতে ভারি বর্ষণে অনেক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে, ঘরবাড়ি, রেল, পাতালরেল, রাস্তাঘাট ধ্বংস হয়েছে। আমাদের নিত্য বন্যার দৃশ্য টিভিতে দেখে দক্ষিণ এশিয়ার বন্যার্ত জনমানুষ বিস্মিত ও চমৎকৃত হয়েছে এই দেখে যে ডুবে যাওয়া ঘরবাড়ি থেকে শ্বেতকায় ধনী নারী-পুরুষ-শিশু বেরিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছে। ওরা আমাদের সমান অবস্থায় নেমে এসেছে। এবার চীনের এক প্রদেশে শত বছরের রেকর্ড ভেঙ্গে যে ভারি বৃষ্টিপাত হয়েছে তাতে সেখানেও ঐ প্রদেশে ঘরবাড়ি, গাড়ি, রেল, পাতালরেল, রাজপথ ধ্বংস হয়ে গেছে। অনেক মানুষের মৃত্যুও হয়েছে। এগুলো প্রকৃতি এবং জলবায়ুর অভিশাপ তুল্য নয় কি? জার্মানির মের্কেল, চীনের শি জিন পিং এক সুরে বলেছেন- এ ঘটনা ডিভাস্টেটিং। তখন ভাবলাম, আমাদের উপক‚লের মানুষকে সিডর, আইলা, আমফান নামের ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব সহ্য করতে হয়েছে এবং এ ধরনের নিয়মিত হয় বন্যা, অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়ের ফলে জোয়ারের পানি ঢুকে তারা যে প্রতি বছর ঘর, বাড়ি, সম্পদ, গরু-ছাগল হারায় এ সত্যটির কিছুটা এবার পশ্চিমা ধনী দেশগুলো উপলব্ধি করেছে বলে মনে হয়। যদিও আমাদের উপক‚লের এবং হাওড় এলাকার মানুষকে এই ‘ডিভাস্টেটিং’ সমস্যা প্রতিবছর মোকাবেলা করতে হয়। তাছাড়া নদীর ¯্রােতের প্রবল শক্তি প্রতিবছর দু’পাড়ের মাইলের পর মাইল ভূমি যখন ভেঙ্গে নিয়ে যায় তখন হাজার হাজার নদীভাঙ্গা মানুষ ভূমিহীন হয়ে পড়ে। এদের অনেকে ঠাঁই নেয় রাজধানীসহ বড় শহরের ফুটপাথে। সম্পন্ন কৃষক একদিনে নিঃস্ব হয়ে যায়। এই স্বল্প ভূমির দেশে বিপুল জনসংখ্যার খাদ্য ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা রীতিমতো একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ যা আমাদের সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ নানারকম ভাতা ও সহায়তা যেমন-কাজের বিনিময়ে খাদ্য বা টাকা ইত্যাদি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচীর মাধ্যমে এই ভূমিহীন, গৃহহীন, আয়হীন লাখ লাখ মানুষকে বেঁচে থাকার উপায় প্রদান করছে। পশ্চিমা দেশগুলোর জনসংখ্যা এত কম আবার ভূমির পরিমাণ আমাদের দেশের তুলনায় এত বেশি হওয়া সত্তে¡ও তারা এই প্রথমবার প্রকৃতির রোষ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের পরিণতির বাস্তব প্রমাণ দেখে হতভম্ব হয়ে গেছে। ইউরোপকে গত দু’বছর যাবত সুইডেনের জলবায়ু যোদ্ধা বালিকা গ্রেটা থুনবার্গ নানাভাবে বৈশ্বিক উষ্ণতার রাশ টেনে ধরতে আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদেও সে উন্নত দেশগুলোর সরকারগুলোকে সময় থাকতে বৈশ্বিক উষ্ণতা হ্রাসের লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আবেদন জানিয়েছে। কিন্তু তাতে পশ্চিমের উন্নত দেশের সরকারের মধ্যে কোন রকম প্রভাব দেখা যায়নি। বরং ওরা ওদের চিরকালীন অভ্যাস-রীতি মেনে বিরোধী মতকে পুরস্কৃত করে থামিয়ে দেবার চেষ্টা করেছে। এই প্রথমবার প্রকৃতি ও জলবায়ু নিজ হাতে ওদের নেতিবাচক কৃতকর্মের জন্য প্রবল হারিকেন, টর্নেডো, ভারি বৃষ্টি, ভূমিধস, বন্যা, অতিরিক্ত উষ্ণায়ন, বিদ্যুত সঞ্চালন ব্যবস্থা বিকল হওয়া ইত্যাদির পাশাপাশি করোনা মহামারীতে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি সংঘটন করেছে যা পশ্চিমা উন্নত দেশের সরকারগুলোকে প্রকৃত অর্থে এই প্রথমবার জলবায়ুর উষ্ণায়ন হ্রাসে কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য করছে। সত্যি বলতে- প্রকৃতিকে ধনী দেশে ওদের পক্ষে অচিন্ত্যনীয় এই অঘটনগুলো সংঘটিত করার জন্য ধন্যবাদ জানাতে হয়। কারণ ক্ষতি যতক্ষণ নিজের ওপর না হয় ততক্ষণ মানুষ অন্যের ক্ষতিতে মোটেও বিচলিত হয় না। এমনকি করোনাক্রান্ত প্রতিবেশীর মৃত্যুতেও অন্য প্রতিবেশী বিচলিত হয় না। এটি এখন প্রতিদিনের চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সংঘটিত এ ঘটনাগুলোর জন্য পশ্চিমা বিশ্ব যে মোটেই প্রস্তুত ছিল না, তা তাদের সরকার প্রধানদের বিস্ময়ভরা উক্তিতে প্রমাণিত। তবে, বিজ্ঞানীরা বার বার ফসিল জ্বালানি থেকে সরে এসে সবুজ জ্বালানি বা সৌরশক্তি, সমুদ্রের জোরালো বাতাসের শক্তিকে ব্যবহার করে বিদ্যুত উৎপাদন করতে আহ্বান জানিয়েছে যা তাদের কাছে উপেক্ষিতই থেকেছে এতদিন। এখন দেখা যাচ্ছে জি ২০ এর চারটি ধনী দেশ অস্ট্রেলিয়া, চীন, ব্রাজিল ও রাশিয়ার বিদ্যুত-জ্বালানির উৎস ব্যবহারের নীতি এখন পর্যন্ত বৈশ্বিক তাপমাত্রা ৫০০ সেলসিয়াসকে টার্গেট করেনি যা এই পৃথিবী নামক গ্রহকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবে! অথচ আসন্ন নবেম্বরে গøাসগোতে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের আগে উক্ত চার দেশের জলবায়ু নীতিতে জ্বালানির উৎস নির্ধারণে তাদের স্ব-স্ব জ্বালানি নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন না আসলে আসন্ন গøাসগো জলবায়ু সম্মেলন ব্যর্থ হবে বলে সতর্কতা ও হতাশা ব্যক্ত করছে বিভিন্ন জলবায়ু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও সংস্থা। ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে ২০০ রাষ্ট্রপ্রধান পাঁচ বছর পর পর জলবায়ুর উষ্ণায়নের সীমা ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে ২০ সেলসিয়াস কার্যকর করার চুক্তিতে সম্মত হয়েছিল। জাতিসংঘ এ বছরের শুরুতে রাষ্ট্রগুলোর বর্তমান জলবায়ু পরিকল্পনা কোনভাবেই ‘প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য’র কাছাকাছি আসেনি বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে যা চরম হতাশাজনক। যেটি একটি ‘রেড এলার্ট’ সব রাষ্ট্রের প্রতি। এদিকে ভারতের হিমালয়ে বরফ গলে শিলাখণ্ড স্থানচ্যুত হয়ে, নদীর বরফ গলা পানি প্রবল শক্তি নিয়ে বাঁধ ভেঙ্গে বসতি, বৃক্ষ, বন, মানুষের প্রাণ নিয়েছে- এ ঘটনা কিন্তু গত দশ বছরে দু’বার হলো। অথচ হিমালয় তার বরফ নিয়ে অটুট না থাকলে নদী প্রথমে অতি স্ফীত হয়ে গ্রাম-বসতি-বনাঞ্চল, ক্ষেত খামার ডুবিয়ে দেবে। পরে বরফ না থাকলে নদী উৎস হারা হয়ে শুষ্ক হয়ে যাবে যেমন আমরা মঙ্গলগ্রহে শুকিয়ে যাওয়া নদীপথ দেখতে পাই। নদীবাহিত মিষ্টি জলের অভাবে মানুষ বা কোন প্রাণ বেঁচে থাকবে না, কোন ফসল ফলবে না, কোন বৃক্ষ-ঘাস, পশু, পাখি, কীটপতঙ্গ বেঁচে থাকবে না। আশ্চর্য এই যে, পৃথিবীর এই মহাসাগরগুলোর লবণাক্ত জল শোধন করা বা লবণাক্ত ভূমিতে লবণসহিষ্ণু ফসল উৎপাদন করা যা এখনও গবেষণা স্তরে আছে; সেসব উদ্ভাবন, গবেষণা পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষকে বাঁচাতে সক্ষম কিনা সন্দেহের অবকাশ আছে। অথচ, জ্ঞানী মানুষ জীবাশ্ম জ্বালানি- পেট্রোল, কয়লা বর্জন করে সৌরশক্তিকে ব্যবহার করে পৃথিবীর জলবায়ু উষ্ণায়নকে কমিয়ে এনে নদীর উৎস বরফের আচ্ছাদনকে সুরক্ষা দিয়ে পৃথিবীর অনেক ক্ষতি কমাতে সক্ষম হতো। আমার মনে হয়, বাংলাদেশ সবচাইতে বেশি জনবান্ধব সরকার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। সরকার দ্রæত বাংলাদেশকে কয়লা ব্যবহার থেকে পুরোপুরি সরিয়ে আনবে এবং সবুজশক্তি ব্যবহার করে স্বদেশ ও স্বজাতির মর্যাদা বৃদ্ধি করে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে এটি প্রাধান্য পাবে- এ বিশ্বাস আমাদের আছে। কেননা তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা- দেশ, জাতি সর্বোপরি পৃথিবীর ভাল-মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণ তিনি ভালভাবে বোঝেন ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। লেখক : শিক্ষাবিদ
×