ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাকালে থেমে থেমে বৃষ্টি, মানুষকে ধরে রাখছে ঘরে

প্রকাশিত: ২২:৫৯, ২২ জুন ২০২১

করোনাকালে থেমে থেমে বৃষ্টি, মানুষকে ধরে রাখছে ঘরে

সমুদ্র হক, বগুড়া অফিস ॥ ‘সাঁতা লাগিছে’। আষাঢ়ের প্রথম সপ্তাহজুড়ে বৃষ্টির পাঁকে পড়া বগুড়ার গ্রামের লোকজন বলছে ‘এঙ্কা সাঁতা লাগল ক্য (এ কেমন বৃষ্টি)।’ শহরের মানুষেরও একই অবস্থা। লকডাউনের কারণে ঘর হতে বের হচ্ছে কম। সকালের বৃষ্টি অলস করে দিয়েছে। ঘুম ভাঙছে দশটার দিকে। তখনও বৃষ্টি। কখনও মুষলধারায়। তারপর কিছুক্ষণ ঝিরিঝরি। ফের ভারি বৃষ্টি। বিরতি দিয়ে মেঘলা আকাশ। পুনরায় শুরু। মাঝারি থেকে ভারি টানা চলল কিছুক্ষণ। বিকেলে যেন কুয়াশা। এরপর মনে হবে সন্ধ্যা রাত। ঘড়ি দেখে সময় নির্ধারণ। হঠাৎ গোধূলি বেলা। তারপর সান্ধ্যকালীন বিরতি দিয়ে ফের বৃষ্টি শুরু। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের গানে ‘আজি ঝরঝর মুখর বাদর দিনে...’। বগুড়ায় কোভিডকালের এই বৃষ্টি ছন্দ কেড়ে নিয়েছে। করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। বর্ষার এই বৃষ্টি মানুষকে ধরে রাখতে পারছে ঘরে। গ্রামের চিত্র আলাদা। কি রোদ কি বৃষ্টি কৃষককে মাঠে যেতেই হবে। নিয়তির সঙ্গে ঘর বেঁধেছে তারা। মাথাল মাথায় বৃষ্টিতে ভিজে মাঠে ফসল পরিচর্যা। বৃষ্টি ভয়ের নয়। খুব বেশি হলে সর্দিকাশি জ¦র। বড় ভয় বজ্রপাতের। ফসলের মাঠে কর্মরত অনেক কৃষক বজ্রাঘাতে মারা গেছে। অতীতে জমির মধ্যে পাথারে বড় বট পাকুড়ের গাছ থাকতো। বৃষ্টি ও বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে কৃষক আশ্রয় নিত বড় গাছের নিচে। এখন হাজার খুঁজেও কোন পাথারের মধ্যে বটপাকুড় গাছ খুঁজে পাওয়া যাবে না। আষাঢ়ের বৃষ্টিতে বগুড়ার গ্রামের কয়েক কৃষকের সঙ্গে কথা বললে তারা এমনটিই বলেন। রানীরপাড়া গ্রামের কৃষক বাসেত আলী বললেন, কিশোর বেলায় চালা ঘরে বারান্দায় বসে টিনের ঢেউয়ে বৃষ্টির পানি ঝরা দেখেছেন। মনে হতো লাইন ধরে গড়ে যাচ্ছে। তারপর উঠানে বৃষ্টির পানিতে গোসল করা ছিল আনন্দের। গ্রামের অনেকে বৃষ্টির মধ্যে কাপড় ও খড় দিয়ে গোল করে পেঁচিয়ে ফুটবল বানিয়ে কেউ জাম্বুরাকে বল বানিয়ে খুলিতে অথবা স্কুলের মাঠে খেলতো। কখনও চিৎপটাং। তবু আনন্দ। বৃষ্টিতে ভেজাই ছিল আনন্দের। বাঙালীর বৃষ্টি সংস্কৃতির বড় অনুষঙ্গ ছাতা। ছাতা ছাড়া ঘর থেকে বের হওয়া ছিল কাপড় না পরেই বের হওয়া। সেই ছাতা আবার আজকের দিনের মতো হাতলে সুইচ টিপে মেলে ধরার নয়। কাঠের বাট ইংরেজী ‘জে’র মতো। টেনে মেলে ধরতে হতো। ছাতার কাপড় এমনভাবে থাকতো যেন শরীরের উপরের অংশ না ভিজে যায়। বর্তমানে সুইচ টেপার আধুনিক বাহারি ছাতা মেলে ধরলে গোল হয়ে থাকে। মাথা রক্ষা পায়। গা ভিজে যায়। বর্ষার মৌসুমে এই ছাতা সংস্কৃতির বিবর্তন ঘটিয়েছে। বর্ষায় টিনের চালা ঘরে থাকার একটা মজা ছিল। বৃষ্টির রিমঝিম রিমঝিম যে শব্দের কথা বলি তা টিনের চালার নিচে থাকলেই বোঝা যায়। বৃষ্টির রাতে টিনের চালা ঘরে শুয়ে থাকলে আরামের ঘুম চলে আসে। বর্ষায় ঘর থেকে বের হওয়ার পর হঠাৎ বৃষ্টি এলে দৌড়ে টিনের চালার নিচে আশ্রয় নিয়েও স্বস্তি। বর্ষায় নদীতে মাছ ধরা ছিল আরেক রোমাঞ্চ। মাঝিরা নৌকায় খেয়া জাল নিয়ে নদীতে যেত। কৃষক তউরা জাল ফেলতো নদীতে। কেউ পলই দাড়কি স্রোতের অনুক‚লে ও প্রতিক‚লে ফেলে কায়দা করে মাছ ধরতো। আর বড়শিতে মাছ ধরা তো আরেক আনন্দের। সঙ্গে ধৈর্যের পরীক্ষা। সেই দিনের বর্ষার রূপ আজও আছে। তবে ধরা দেয় না সেই দিনগুলোর মতো। বর্তমানের বর্ষাকাল অনেকটা যান্ত্রিক। গ্রামেও আজকাল পাকা বাড়িঘর। টিনের চালার বাড়িও কমে যাচ্ছে। শহরে টিনের বাড়ি হন্যে হয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বহুতল ভবনে থেকে কি বৃষ্টির রিমঝিম রিমঝিম শব্দ শোনা যায় না বোঝা যায়! জানালা দিয়ে তাকালে শুধু দেখা যায় ঘন কুয়াশার মতো বৃষ্টি ঝরছে ও শোঁ শোঁ করা এক ধরনের শব্দ। শহরের সড়কে বৃষ্টির জলাবদ্ধতা তো আছেই। গ্রামে অবশ্য জলাবদ্ধতা নেই। নিচু রাস্তা ডুবে গেলে লোকজন পানি গলিয়ে পার হয়ে যায়। বড় ডোবাও পার হয় লুঙ্গি হাতে ধরে হাঁটু পর্যন্ত তুলে। গ্রামের লোকজনের কথা: সাঁতা লাগিছে।
×