ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. রাজীব চক্রবর্তী

বাংলাদেশ-করোনাকালীন চাঙ্গা অর্থনীতির এক ব্যতিক্রমী উদাহরণ

প্রকাশিত: ২০:৫৩, ১৬ জুন ২০২১

বাংলাদেশ-করোনাকালীন চাঙ্গা অর্থনীতির এক ব্যতিক্রমী উদাহরণ

করোনাকালীন সময়ে যেখানে বিশ্বের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে, রফতানিনির্ভর দেশগুলোর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে গেছে, পণ্যের কঁাঁচামাল আমদানির অভাবে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনমুখী শিল্পগুলোর মুখ থুবড়ে পড়েছে, সেখানে লণ্ঠনের বাতির মতো পথ দেখানো বাংলাদেশের সাম্প্রতিক মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধি অর্থনীতির জন্য একটি ইতিবাচক দিক। এক সময় উপহাসের তলাবিহীন ঝুড়ির বাংলাদেশ আজ আস্তে আস্তে দক্ষিণ এশিয়া ছাড়িয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে আলো ছড়াচ্ছে। যদিওবা অর্থনীতিবিদরা মানুষের মধ্যে আর্থিক বৈষম্য বৃদ্ধির হেতুর ওপর বেশি আলোকপাত করছেন। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ প্রথম ২০১৫ সালে এলডিসি থেকে নিম্ন মধ্যবর্তী আয়ের দেশে উত্তীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তখন মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল ১০৫০ ডলার। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে বিগত ৫ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২২৭ ডলার, যা প্রতিবেশী ভারতের মতো বৃহত্তর অর্থনীতির দেশ থকে ২৮০ ডলার বেশি। উল্লেখ করার মতো আর একটি অর্জন হলো উদ্বৃত্ত রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ এই প্রথম বন্ধুপ্রতিম শ্রীলঙ্কাকে, যাদের অর্থনীতি এই করোনা সঙ্কটে বিপর্যস্ত, প্রায় ২৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দিতে যাচ্ছে। আমরা জানি এই দ্রæত মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বৈদেশিক মুদ্রার প্রভাব। রেমিটেন্সের পাশাপাশি এই মুদ্রার একটা বিশাল অংশ এসেছে করোনাকালীন রফতানিমুখী পোশাক কারখানা খোলা রাখার কারণে। অবশ্য একশ্রেণীর জনগণ গার্মেন্টস খোলা রেখে, ব্যাংক-বীমা খোলা রেখে লকডাউনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। আমাদের মতো আরেক শ্রেণী আবার আর্থিক প্রতিষ্ঠান খোলা রেখে লাগাতার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সমালোচনা করছে। তবে এই সমালোচনাও সত্য যে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনও স্বল্পমূল্যের পোশাক শিল্প ও অদক্ষ রফতানিমুখী বিদেশী শ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। বললে অত্যুক্তি হবে না, এই দুটি ক্ষেত্রই কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের মতো, যা কিছুটা অন্যের ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে অদক্ষ শ্রমিক পাঠানো অনেকটা রাজনীতি নির্ভর। স্বল্পমূল্যের পোশাক খাত থেকে চায়নাসহ বেশ কিছু দেশ আস্তে আস্তে বের হয়ে আসছে। তাই বাংলাদেশকেও কাস্টমাইজড প্রোডাক্ট কনসেপ্টের পাশাপাশি সুলভমূল্যে পণ্যের বাজারের ওপর জোর দিতে হবে। বাংলাদেশের তৈরি নিজস্ব ডিজাইন ও ব্র্যান্ড সম্পর্কে বিদেশীদের জানাতে হবে। গবেষণার মান বাড়াতে প্রয়োজনে দেশের ফ্যাশন টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিক কোলাবরেশন বাড়াতে হবে। চলমান এই অর্থনৈতিক অগ্রগতি ধরে রাখার জন্য সরকারকে ব্যাপক বিনিয়োগের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ শ্রমের বাজার সৃষ্টি করতে হবে। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের স্বল্পমেয়াদী ঋণ প্রকল্পের আওতায় আনতে হবে এবং ঋণ অনুমোদন হবে অব্যশই বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী। ইদানীং সরকার বেশ কিছু রফতানি শিল্প অঞ্চল অনুমোদন দিয়েছে। পোশাক শিল্পের সঙ্গে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যদ্রব্য, পাটজাত দ্রব্য, চামড়াজাত শিল্প, ঔষধ শিল্পও এখন রফতানি আয়ের সঙ্গে যোগ হয়েছে। সঠিক নির্দেশনা ও সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে এই শিল্পগুলোও ভবিষ্যতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অবদান রাখবে। অর্থাৎ টেকসই অর্থনীতির জন্য অভ্যন্তরীণ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিনিয়োগ জোরদার করতে হবে। ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের নিশ্চয়তা দেয়াসহ বিনিয়োগবান্ধব তৈরি নীতিমালা আরও স্পষ্ট করতে হবে। আসলে গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নতির কোন বিকল্প নেই। কৃষিপ্রধান এই দেশের খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়িয়ে উদ্ধৃত খাদ্যের রফতানি কিভাবে বাড়ানো যায় তা ভাবতে হবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীণ তরুণ সমাজ গ্রামেই কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে। নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হওয়ার আগেই নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার ভ‚য়সী প্রশংসা করেছিলেন। তাই এই যোগাযোগ ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে সরকারের উচিত অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সম্ভাবনাময় বিনিয়োগের ক্ষেত্রসমূহের তালিকা তৈরি করা, যেখানে সহজে ঋণ পাওয়া যাবে। ফলে অবাস্তব প্রকল্পের মাধ্যমে ইচ্ছামতো ব্যাংকের টাকা নয়-ছয় করার সুযোগ ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তার কাছে কমে আসবে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, সরকার যেভাবে রেলের সংস্কার শুরু করেছিল সেবা পাওয়ার দিক থেকে সেই গতি দৃশ্যত শ্লথ। বেসরকারী পরিবহন মালিকদের ওপর যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেকাংশে নির্ভরশীল। দুর্ভাগ্য যে ভ্রমণপ্রিয় বাঙালী হওয়া সত্তে¡ও আমরা নিজের দেশের বিভিন্ন জেলা ঘুরতে পছন্দ করি না। হয় নিরাপদ না ভেবে বা আরামদায়ক রেলনির্ভর কোন যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকার কারণে। দেশে এখনও নিরাপদ পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। উন্নত কারখানা না থাকার কারণে এখনও বাস, রেলের বগি, ইঞ্জিন আনতে হয় বিদেশ থেকে। বাস, রেলের মতো ভারি শিল্পে সরকারের সঙ্গে বেসরকারী বিনিয়োগ এখন সময়ের দাবি। এই খাতে বিনিয়োগ হলে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ একটি ভোক্তা শ্রেণীর দেশ। সবই আমদানিনির্ভর। এই মাত্রাতিরিক্ত আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে আনতে হবে। বিস্তৃতভাবে দেশে উথপাদনমুখী মাঝারি ও ভারি শিল্পের বিকাশ ঘটাতে হবে। এর জন্য দেশের তরুণ প্রজন্মকে কারিগরিমুখী শিক্ষার জ্ঞান দিতে হবে। শুধু সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি খুলে কি হবে যদি তার ব্যাপক প্রয়োগ না থাকে। চীন যেভাবে ক্ষুদ্র থেকে ভারি শিল্পের উন্নতি করেছে তা তাদের সুষ্ঠু নীতিমালারই ফল। তাই এখনই সময়, সরকারকে এই অর্থনৈতিক অগ্রগতি ধরে রাখার জন্য বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈচিত্র্য আনয়নের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ শিল্প বিপ্লবের উন্মেষ ঘটাতে হবে। লেখক : গবেষক [email protected]
×