ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সুবর্ণজয়ন্তীর সুবর্ণ সুযোগ

প্রকাশিত: ২১:৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২১

সুবর্ণজয়ন্তীর সুবর্ণ সুযোগ

তারুণ্যের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর দুর্মর কবিতায় উচ্ছ্বসিত ‘আগুন-স্বপ্নে’ ব্যক্ত করেছেন, ‘সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয় জ্বলে পুড়ে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়’। বাঙালীর জীবনে সুকান্তের সেই অগ্নিগর্ভা কবিতার প্রথম ‘সকাল-সূর্য’ উদ্ভাসিত হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে, ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে। আর দ্বিতীয় বিজয় সম্ভাষিত হয়ে উঠছে একবিংশ শতকে বাঙালীর শান্ত সাহস শেখ হাসিনার অসীম নেতৃত্ব প্রজ্ঞায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কল্যাণেই ‘ক্ষুধা দারিদ্র্যের বাংলাদেশ’ শব্দসমূহ আজ জাদুঘরের পথে এবং পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবার প্রান্তে মেহনতি মানুষের স্বপ্ন-বাস্তবতার বাংলাদেশ। পুকুরে ঢিল ছুঁড়লে যেমন পাড়ের শেষতক অবধি লহরি খেলে তেমনি জাতির যে কোন অর্জনের ক্ষেত্রেও তাই হয়। সবার মাঝে আনন্দের ঘোড় সওয়ার হয়। বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের মুহূর্তে বিগত ৫০ বছরের অর্জন ঠিক তেমনি। এখানে আছে বিশ্বকে নাড়া দেবার মতো কিছু মাইলফলক এবং রেকর্ড গড়া-ভাঙ্গার ইঙ্গিত। সাম্প্রতিক জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), বাংলাদেশ ব্যাংক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তেমনি কিছু চিত্র সামনে এসেছে। যেখানে প্রায় ১৩ নতুন খাতে বিশ্বের শীর্ষ দশের তালিকায় আছে বাংলাদেশ। তবে সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হলো প্রতিক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় ২য়, ৩য় বা ১০ম এর ভেতর স্থান করে নিলেও যাদের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে তাদের প্রত্যেকের আছে স্বাধীন হবার বহুদিনের ইতিহাস এবং আয়তন-সক্ষমতায় বাংলাদেশের চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বেশি শক্তিমত্তা। এরপরও দেখা গেছে ধান উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ, ইলিশে প্রথম, তৈরি পোশাকে দ্বিতীয়, প্রবাসী আয়ে অষ্টম, সবজিতে তৃতীয়, আলুতে ষষ্ঠ, কাঁঠালে দ্বিতীয়, আমে অষ্টম, পেয়ারায় অষ্টম, পাট রফতানিতে প্রথম, উৎপাদনে দ্বিতীয়, ছাগলের দুধে দ্বিতীয়, মিঠাপানির মাছে তৃতীয়, আউটসোর্সিংয়ে দ্বিতীয় অবস্থান। আর এসব অসাধ্য সাধন হয়েছে শেখ হাসিনার মতো লড়াকু মানুষ এবং জনগণের অসীম মানসিকতায়। সেই মননেরই ফল শিক্ষা, স্বাস্থ্যে উন্নতি, মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার হ্রাস, দারিদ্র্য বিমোচন এবং বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে স্যাটেলাইটের যুগে প্রবেশ। যদিও এই পথচলা মোটেও সহজ ছিল না। কারণ স্বাধীনতার পরপরই দেশ বিনির্মাণ সম্পন্ন করার পূর্বে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা, সামরিক শাসন, কৌশলী বৈষম্য প্রতিষ্ঠার দিকে দেশকে নিয়ে যাওয়া হয়। এসব হটিয়েও আজকের এই অর্জন; এটা সত্যিই বিস্ময়ের। শুধু তাই নয়, বিশ্ব পরিসংখ্যান অনুযায়ী আগামী ২০৩৫ সালের মাঝে বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হয়ে উঠবে। আর এখানেই চিন্তার উদ্ভব; কারণ দেশ উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনুন্নত দেশ হিসেবে যে সুবিধাগুলো বিশ্বের কাছ থেকে পাওয়া যেত তা ধীরে ধীরে বন্ধ হতে শুরু করবে। যেমন, বহু দেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রত্যাহার করে নেবে। তাই এসবের পূর্বেই নতুন ব্যবসায়িক জোট পরিকল্পনা প্রয়োজন। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক জোরদারের মাধ্যমে বন্ধুত্ব এবং বাণিজ্য ঘাটতি দুই-ই সামাল দেয়া সম্ভব। ভিন্নভাবে বললে চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আগামীদিনের উদ্ভাবনী বা শিল্প চিন্তার বিস্তৃতি জরুরী। তাছাড়া ততদিনে রোবটিক সায়েন্স, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহারও বাড়বে। ফলে বহুক্ষেত্রে শারীরিক শ্রমের বিষয়গুলো অর্থহীন হয়ে আসবে। যেমন শপিং, গাড়ির ড্রাইভিং, রেস্টুরেন্ট সার্ভিসসহ প্রায় বহু কিছুই হবে ‘ইন্টারনেট-অনলাইনে’। ফলে বিশ্বব্যাপী প্রথাগত লোকবলের যে বাজার সেটা ক্রমেই ছোট হয়ে আসবে। কাজেই ওষুধ শিল্প, পর্যটন শিল্প, তৈরি পোশাক, বিদ্যুত উৎপাদনের মতো বিষয়ের পাশাপাশি গবেষণার মারাত্মক আয়োজন আবশ্যক এবং সেটা শক্তির নবায়ন এবং রূপান্তর পরীক্ষায়। তবে এই সমস্ত আয়োজনের পাশাপাশি নিজেদের সংস্কৃতি চর্চাকে প্রচ-ভাবে এগিয়ে নিয়ে মৌলবাদী আচরণকে প্রতিহতের দারুণ প্রস্তুতি রাখতে হবে। ভিন্নভাবে বললে, এজন্যে প্রয়োজনে সরকারের হার্ডলাইনেরও প্রস্তুতি রাখা জরুরী। আর এতে পূর্ণ সমর্থন যোগাতে হবে জনগণকে। কারণ ইতিহাস সাক্ষী- বহু সম্ভাবনাময়, সমৃদ্ধশালী দেশ মৌলবাদ এবং বিশৃঙ্খলার কারণে ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। তেমন চেষ্টা এদেশের ক্ষেত্রেও যে চলছে তার প্রমাণ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা। সেখানটায় বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ ভাষা চত্বর, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গন, আব্দুল কুদ্দুস মাখন মুক্তমঞ্চ, সরকারী গণগ্রন্থাগার, কালীবাড়ি মন্দিরের প্রতিমা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাব, জেলা পরিষদ ভবন, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, জেলা পুলিশ লাইন, সার্কিট হাউস, ফায়ার সার্ভিসের কার্যালয়, সদর উপজেলা ভূমি অফিস, সিভিল সার্জনের কার্যালয়সহ রাষ্ট্রীয় এবং প্রগতিশীলতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল স্থাপনায় পাকিস্তানী কায়দায় নির্বিচারে হামলা করা হয়েছে। এই হামলার রুট এবং উন্মাদনাকে ময়নাতদন্তের আদলে নিরীক্ষণ করলে দাঁড়ায়, স্বাধীনতা বিরোধিতাকারীরা যেমন তৎকালীন সময়ে বাঙালিয়ানাকে গ্রাস করার পরিকল্পনায় মত্ত ছিল এই সময়েও সেই চেষ্টা অব্যাহত আছে। শুধু তাই নয় উত্তরাধিকারসূত্রে দেশবিরোধী সেই নেতৃত্বের ধারাবাহিকতাও তাই আছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর এবং বঙ্গবন্ধুর ১০১তম জন্মদিন হিসেবে বাংলাদেশের অর্জন ভীষণ আনন্দের। নিজেকে বারংবার ছাড়িয়ে যাবার অপার সম্ভাবনাও প্রবল। তবে এই সম্ভাবনাকে সমুন্নত করতে ক্ষমতা কেন্দ্রিক লড়াইয়ের বাইরে নিজ দেশের স্বার্থ সম্পর্কে আপোসহীন থাকার মানস গুরুত্বপূর্ণ। আর এমন সম্মিলিত বোধই পথ তৈরি করতে পারবে ভবিষ্যত রাজত্বের, বিশ্বজয়ের বাংলাদেশের। লেখক : প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ [email protected]
×