ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

৫০-এ বাংলাদেশের অর্থনীতি

প্রকাশিত: ২০:০৬, ১৯ এপ্রিল ২০২১

৫০-এ বাংলাদেশের অর্থনীতি

বাংলাদেশের সমকালীন জনসংখ্যা প্রায় ১৬৫ মিলিয়ন। ১৯৭১ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭০ মিলিয়ন। ১৯৮১ সালে গড়ে ১ জন নারীর মোট সন্তান উৎপাদন হার (১জন নারী তার জীবদ্দশায় যে ক’জন সন্তান ধারণ করেন) ছিল ৫%। ২০২১ সালে এ হার নেমে দাঁড়িয়েছে ২.১% এ। ২০২১ এর গণশুমারী অনুযায়ী সম্ভবত এ হার আরও নিচে নেমে আসবে। গড় সন্তান উৎপাদন হার ২.১% এ এলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নেমে আসবে শূন্যতে। এই হিসেবে ১৯৭১ সালের বিপরীতে ২০২১ সালে বাংলাদেশ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সন্তোষজনকভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে বলা চলে। এই সফলতার সঙ্গে ১৯৭১ সালের তুলনায় গ্রাম থেকে নগরবাসের পরিমাণ বাড়া, শ্রম শক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, অপেক্ষাকৃত বিলম্বে বিয়ে করা এবং শিক্ষার হারে উন্নয়ন বিবেচ্য। আর গড় জীবন প্রত্যাশার ১৯৭১ সালের ৫৬ থেকে ২০১৯ সালে ৭২ বছরে উন্নয়ন ১৯৭০ দশকের এর তুলনায় ২০২০ দশকে উন্নীত আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রতিফলন করছে। ২০১৯ এর মূল্য মাত্রায় ১৯৭১ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ৩৫০ মার্কিন ডলার। ১৯৯০ সালে এর পরিমাণ হয়েছিল ৫১০ মার্কিন ডলার। এখন মাথাপিছু আয় উন্নীত হয়েছে ১৮৬০ মার্কিন ডলারে। বিদেশ থেকে শ্রমিক প্রেরিত আয় হিসেবে আনলে এই বছর মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ২০৩০ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ এই আয়ের বিবেচনায় উন্নয়নশীল দেশের পরিচিতি পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। ২০৩১ সালে মাথাপিছু আয় ৩৯০০ মার্কিন ডলারে উন্নীত হবে বলে প্রক্ষেপিত হয়েছে। এই হিসেবে নিশ্চিতভাবে বলা চলে যে, ১৯৭১ সালের অর্জিত স্বাধীনতা ২০১০ থেকে গণতন্ত্রের নিয়মানুগ প্রয়োগ ও প্রসার বলে ২০২১ সালে বাংলাদেশের পরিচিতি সমৃদ্ধির হিসেবে ভাস্বর করেছে। মাথাপিছু আয় বাড়া এই ৫০ বছরে কর্মসংস্থান বাড়ানো প্রতিভাত করেছে। ১৯৭০ এর দশকে দেশে বেকারত্বের বিস্তৃতি ছিল লভ্য শ্রম শক্তির ৩০%। তৎকালীন পরিকল্পনা কমিশনের হিসাবে ১৯৭০-৭৪ সালে দেশে শিক্ষিত বেকার ছিল ৪৪%, কৃষি খাতে বেকারত্বের হার ছিল প্রায় এক তৃতীয়াংশ। ১৯৭০ এর দশকে শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের ব্যাপ্তি ছিল মূলত কৃষিতে। কৃষি উন্নয়নে শ্লথতা এবং শিল্প ও সেবা খাতের স্বল্প বিস্তারন ১৯৯০ পর্যন্ত দেশের কর্মসংস্থানের ব্যাপ্তি আশানুরূপ বাড়াতে পারেনি। ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা কালে কৃষির বহুমুখীকরণ এবং বিদেশ থেকে শ্রমিক প্রেরিত আয় প্রাপ্তি, নগরাঞ্চলে শিল্প ক্ষেত্রের শ্রমচাহিদা বাড়ানোর সঙ্গে গ্রামীণ শিল্প, নির্মাণ, গৃহায়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাণিজ্য, পরিবহন ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে আশাতীত মাত্রায় কর্মসংস্থানের ভিত্তি প্রসারিত করেছে। ২০১০ এর দশকে অভ্যন্তরে ৪.৬ মিলিয়ন ও বিদেশে ২.৮ মিলিয়ন কর্ম সৃষ্টি হয়েছে। ২০১০- ১৭ পর্যন্ত গড়ে প্রতি বছর প্রক্ষেপিত বার্ষিক হার ২.৯% এর বিপরীতে ১.৬% হারে শ্রম সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৫ তে কর্মপ্রাপ্ত শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৫৮.৭ মিলিয়ন। ২০১৯ এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৩.৩ মিলিয়নে। দেশের সার্বিক শ্রম শক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ ৩৬% এ উঠে এসেছে। ৭০ এর দশকে বিদ্যমান বেকারত্ব, কৃষি ও শিল্পের প্রসারণের নিচু হার এর তুলনায় ২০২০ এর দশকে এই প্রেক্ষিতে বেকারত্ব তত প্রকট নয়। ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২১ সালে ২০ লক্ষাধিক কর্ম সৃষ্টি হবে, আর শ্রম বাজারে প্রবেশ করবে ১৫ লক্ষ শ্রমিক। ২০২৫ সালে নতুন কর্ম সৃষ্টি হবে ২ লক্ষ ৫০ হাজার আর শ্রম বাজারে নতুন প্রবেশ করবে দেড় লক্ষাধিক শ্রমিক। অন্য কথায় দেশ পূর্নাঙ্গ কর্মসংস্থানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ১ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা কালে (১৯৭৩-৭৮) প্রকৃত প্রবৃদ্ধির হার হয়েছিল বার্ষিক ৪%। ২য় ও ৩য় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রবৃদ্ধির হার হয়েছিল বার্ষিক ৩.৮%। ৪র্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে এই হার হয়েছিল ৪.২%, পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে এই হার উন্নীত হয়েছিল ৫.১% এ। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে প্রবৃদ্ধির হার উঠেছিল ৬.৩% এ এবং ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে কোভিড-১৯ এর বাধাবিঘ্ন সত্ত্বেও এই হার দাঁড়িয়েছিল ৭.১৩% এ। ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে প্রকৃত প্রবৃদ্ধির হার ২০২১ সালের ৭.৪% থেকে ২০২৫ সালে ৮.২৫% এ উন্নীত হবে বলে প্রক্ষেপিত হয়েছে। এই হার থাইল্যান্ড, ভারত ও চীনের সমকালীন প্রবৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি। ১৯৭০ ও ৮০ এর দশকের তুলনায় সমকালে বাংলাদেশের বিনিয়োগ বেড়েছে। ১৯৮৯ সালে অর্থনীতিতে মোট বিনিয়োগ হয়েছিল জিডিপির ১৩%। বিনিয়োগের এই হার ১৯৯৮ এ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ২৩%। এবং ২০১৯ সালে বিনিয়োগের হার উঠে এসেছে জিডিপির ৩২% এ। ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা কালে মোট বিনিয়োগ হবে ৬৩.৬ ট্রিলিয়ন টাকা, যার মধ্যে ৭৫% অর্থাৎ ৪৭.৫ ট্রিলিয়ন টাকা উৎসারিত হবে ব্যক্তি খাতে। এই পরিমান বিনিয়োগ ১৯৭০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত কল্পনা করা যায়নি। ১৯৭০ এর দশকে সার্বিক বিনিয়োগের ৫০% সরকারী খাতে হয়েছে। সমকালে গণখাতের বিনিয়োগ ২৫% নেমে এসেছে, আর ব্যক্তি বিনিয়োগের পরিমাণ ৭৫% এ স্থিতিশীল রয়েছে। ১৯৭০ ও ৮০ এর দশকে দেশের সার্বিক সঞ্চয়ের ৮৭.৪% অভ্যন্তরে উৎসারিত হয়েছে বলে হিসাব করা হয়েছে। ২০২১ সালে সেই অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় প্রক্ষেপিত হয়েছে ৮১১০ বিলিয়ন টাকায় (দ্রষ্টব্য, ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিরকল্পনা, পৃঃ ১৬১-১৬২)। ২০২১ সালে গণবিনিয়োগ প্রক্ষেপিত হয়েছে ২৫৭৯ বিলিয়ন টাকা। এই বিনিয়োগ ২০২৫ সালে ৩৯৮৭ বিলিয়ন টাকা হবে বলে পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর মধ্যে সিংহভাগ ৮৭% আসবে ব্যক্তি বা বেসরকারী সঞ্চয় হিসেবে। বাকি ১৩% উৎসারিত হবে গণক্ষেত্রে, কর ও অন্যান্য রাজস্ব হিসেবে। সামগ্রিক সঞ্চয়ের ১১.৫% আসবে বৈদেশিক উৎস থেকে। ১৯৮০-৯০ এর দশকের তুলনায় এ হল স্বস্তিমূলক অবস্থান। মোট জাতীয় সঞ্চয়ের এই বিভাজন অর্থনৈতিক সফলতার পরিচায়ক এবং সামনের দশকে এ আরও স্বস্তি ও সন্তোষমূলক হবে। পঞ্চাশ বছর আগে বাংলাদেশের অবকাঠামো ভয়ানক নিম্ন পর্যায়ের ছিল। সে তুলনায় সমকালের অবকাঠামো উন্নয়নের স্তর ও হার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় সন্তোষজনক এবং কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে দ্রুতবেগে এগিয়ে যাওয়ায় সহায়তা দিতে সক্ষম। ১৯৮৩-৮৪ সালে বিদ্যুতের মাথাপিছু উৎপাদন ছিল ৪৫কিঃওঃ। ২০১৮-১৯ সালে এ বেড়ে হয়েছে ৪৯০কিঃওঃ। বর্তমানে দেশের নগর ও গ্রামের প্রায় সকল গৃহস্থালি বিদ্যুতের সংযোগ প্রাপ্ত। বর্তমানে দেশে ১৫৫টি বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র বিদ্যমান। এর মধ্যে ৯৬টির মালিকানা সরকারের আর ৫৯টির মালিকানা ব্যক্তি উদ্যোগের। সমকালে দেশের বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২৪০০০ মেঃওঃ। ২০২৫ সালে এই ক্ষমতা ৩০০০০ মেঃওঃ এ উন্নীত হবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। কল কারখানার বিস্তৃতি, সেচ সুবিধা প্রসারণের বাইরে দেশের প্রায় সকল গৃহস্থালি এখন টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর ব্যবহার করছে, যা ১৯৭০ বা ১৯৮০ এর দশকে ছিল অকল্পনীয়। ৮ম পরিকল্পনা কালে প্রতি বছর বিদ্যুত উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে জিডিপির প্রায় ২% বিনিয়োগ করা হবে বলে স্থিরিকৃত হয়েছে। ২০২৫ সালে এই হিসাবে ৫৪২.৬ বিলিয়ন টাকা বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতে প্রযুক্ত হবে বলে পরিকল্পিত হয়েছে। এই মাত্রার উৎপাদন ও বিনিয়োগ ১৯৭০ থেকে ১৯৯০ এর দশকে ছিল অকল্পনীয়। স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে নজর দেয়া হয়। ফলত লাগসই পরিকল্পনা হাতে নেয়ার ফলে ১৯৭৯ সালে গ্যাসের উৎপাদন ৫০ বিলিয়ন কিউবিক ফুটে উঠে আসে। ১৯৯০ সালে গ্যাসের উৎপাদন ১৫০ বিলিয়ন কিউবিক ফুটে উন্নীত হয়। এর পরে দেশের অভ্যন্তরে ও উপকূল সীমায় নতুন ক্ষেত্র শনাক্তকরণে ধীর গতির ফলে গ্যাসের উত্তোলনের বৃদ্ধির হার কমে আসে। সমকালে গ্যাস শহরাঞ্চলের গৃহস্থালীতে, ইউরিয়া সার ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রযুক্ত। ১৯৭০-১৯৮০ এর দশকের গ্যাস উৎপাদন এই সময়ে নিত্য নতুন ব্যবহারের ক্ষেত্র, বিশেষত শিল্প উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর বাইরে প্রতিবছর ১ মিলিয়ন টন কয়লা উৎপাদিত হচ্ছে। সম্প্রতি দিনাজপুরে আকরিক লোহা উত্তোলনের প্রকল্প হাতে নিয়ে খনিজ সম্পদের লভ্যতা ও ব্যবহারের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। ১৯৭০-৯০ এর ৩ দশকের তুলনায় ২০২০ এর এই শতকে সড়ক, রেলপথ, সমুদ্র ও নৌ-বন্দর, বিমান পরিবহনের দর্শনীয় উন্নয়ন অর্জিত হয়েছে। সমকালে দেশে ৫৫০০০ কিঃমিঃ পাকা সড়ক, ২৮৭৭ কিঃমিঃ রেলপথ, ৩৮০০ কিঃমিঃ নৌ-পথ, ৩টি সমুদ্র বন্দর, ৩টি আন্তর্জাতিক ও ৮টি অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর বিদ্যমান ও কর্মশীল। ১৯৭০ থেকে ২০০০ শতকের তুলনায় দেশ এখন একক উৎপাদন, পরিবহন ও বাজারজাতকরণের উৎপাদনশীল নিলয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এসব অবকাঠামো আরও সুসংহত করার লক্ষ্যে ১৫০০০ সড়ক নির্মাণ ও উন্নয়ন, ৩৭৫০০ মিঃ পুল কালভার্ট নির্মাণ, ৮০০ কিঃমিঃ রেললাইন নির্মাণের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। দেশে টেলি নিবিড়তা ইতোমধ্যে ১০০% ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৮ তে বঙ্গবন্ধু উপগ্রহ স্থাপন করে বাংলাদেশ পৃথিবীর ৫৭তম উপগ্রহের মাধ্যমে যোগাযোগ সেবা বিস্তৃত ও প্রয়োগ করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। ১৯৭০-৯০ এর দশকের তুলনায় পরবর্তী ২ দশকে বাংলাদেশে সুষম খাদ্য উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। দেশ এখন খাদ্যে সয়ংসম্পূর্ণ বলা চলে। সম্প্রতি শর্করা খাদ্য ভাতা প্রান্তিক ভাবে কমে এলেও মাথাপিছু মাছ, মাংস, ডিম ও দুধের লভ্যতা বেশ বেড়েছে। তেমনি বেড়েছে আলু, তেলবীজ, ফলফলাদি ও শাকসবজির লভ্যতা। বাংলাদেশকে এখন ১৯৭০-৯০ দশকের মতো খাদ্য ঘাটতির দেশ বলা যায় না। বাংলাদেশ সমকালে চাল উৎপাদনে বিশ্বে ৩য়, পাট উৎপাদনে ২য়, সবজি উৎপাদনে ৩য়, চাষকৃত মাছ উৎপাদনে ২য়, আম উৎপাদনে ৭ম, আলু উৎপাদনে ৮ম। ১৯৭০ এর দশকের তুলনায় বাংলাদেশে চালের উৎপাদন বেড়েছে ৪ গুণ, গম দুই গুণ, ভুট্টা ১০ গুণ ও সবজি ৫ গুণ। বাংলাদেশ থেকে এখন প্রতিবছর ৭৩০০০ টনের চেয়ে বেশি মাছ রফতানি হচ্ছে। ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রস্তাবিত ৩৬০ বিলিয়ন টাকা বিনিয়োগ দেশের কৃষি উৎপাদনকে তাৎপর্যমূলক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারবে বলে আশা করা যাচ্ছে। সমকালে জিডিপির ৩৫% শিল্প খাত থেকে উৎসারিত হয়। এর মধ্যে কারখানাজাত শিল্পের অবদান ছিল যথাক্রমে ১৮% থেকে ২৪% ভাগ। ১৯৭০-৯০ এর দশকে শিল্প খাতের প্রসার লক্ষণীয়ভাবে সীমিত ছিল। অবকাঠামোর প্রসারণ, ব্যক্তি খাতের প্রসার, সরকারী নিয়ন্ত্রণ শিথিলকরণ ও বিনিয়োগের সঞ্চালন দেশের শিল্প উৎপাদনকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। তৈরি পোশাক ও ওষুধ শিল্প দেশে শিল্পায়নের সারথী হিসেবে কাজ করছে। ১৯৭০-৯০ দশকের তুলনায় শিল্পের এই প্রসার নিঃসন্দেহে উৎসাহব্যঞ্জক। ১৯৭১ সালে সারা বাংলাদেশে ১২৭৬টি বৃহৎ ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল। এসবে নিয়োজিত মোট শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ২৪৪২৫৭। এর বিপরীতে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক ক্ষেত্রই ৩৪ বিলিয়ন ডলার পরিমাণ রফতানি করেছে, ৩০ লক্ষাধিক শ্রমিককে লাভজনক কর্মসংস্থান দিয়েছে। একই সঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে এবং বেড়ে উঠেছে বস্ত্র ও সূতা বুনন, ওষুধ ও কৃষি শিল্প, মৎস্য ও সামুদ্রিক খাদ্য উৎপাদন ও রফতানিকারী শিল্প। সমকালে জিডিপির ৩৫% শিল্প খাত থেকে উৎসারিত হচ্ছে। দেশ এখন ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। ১৯৭০ থেকে ৯০ এর দশকের শেষ পর্যন্ত এসব শিল্পের বিকাশের তুলনায় শিল্পের এরূপ বিস্তার বাঙালীদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে। ১৯৭০-এর দশকে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবা প্রায় অলভ্য ছিল। সেই দশকে সারাদেশে ৮৮০০ হাসপাতাল শয্যা, ৯২০০ চিকিৎসক, ২৮৫০০ বিশেষজ্ঞ (চিকিৎসক) ৯১০০০ নার্স ছিল। গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্য সেবার তেমন কোন সুযোগ ছিল না। এর বিপরীতে ২০১০ এর শতকে স্বাস্থ্য খাতে অভূতপূর্ব প্রসারণ ঘটেছে। ম্যালেরিয়া, বসন্ত, কলেরা, যক্ষ্মা, কুষ্ঠ প্রায় নির্মূল হয়ে গেছে। গড় জীবন প্রত্যাশা ১৯৭১ সালের ৪৬ বছর হতে ২০১৯ সালে ৭২ বছরে উন্নীত হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার প্রায় বার্ষিক ১.২% এ নেমে এসেছে। গৃহস্থালি বহির্ভূত শ্রমে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। গড়ে ১জন নারী তার সারা জীবনে ২ সন্তানের বেশি সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন না। অনধিক ১ বছরের প্রায় সকল শিশু সংক্রমণ রোগের টিকার আবরণে এসেছে। গড়ে ১৫০০০ জনগণের জন্য ১টি সমাজ ক্লিনিক প্রায় সকল ইউনিয়নে স্থাপিত হয়েছে। অনুরূপভাবে স্বাধীনতার ১ম ৪ দশকের তুলনায় সাম্প্রতিক দশকে শিক্ষা ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব প্রসারন ঘটেছে। সমকালে বয়স্ক সাক্ষরতার হার ৯৫% হারে উঠে এসেছে, প্রাথমিক পর্যায়ে ৫-১২ বয়োবর্গের সকল শিশু শিক্ষা পাচ্ছে, সকল বয়স্কদের ৮০% এখন স্বাক্ষর, দেশে সমকালে ১৪৫টি বিশ্ববিদ্যালয়, ১১১টি চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়, ৩৫টি দন্তীয় কলেজ বিদ্যমান। নেট মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার হার প্রায় ৭০% এ উন্নীত হয়েছে। কারিগরি, বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ২০০৯ এর ৯% থেকে সমকালে প্রায় ১৮% এ উঠে এসেছে। ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জিডিপির ২% শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ খাতে প্রযুক্ত করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ২০২১ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত ৭০১ বিলিয়ন টাকা বিনিয়োগ করবে বলে স্থিরীকৃত হয়েছে (দ্রষ্টব্য, ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, পৃঃ ৬৮২)। সার্বিক ভাবে প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে নিট ভর্তির হার ২০২৫ সালে ১০০%, মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে নিট ভর্তির হার ৬৪% তে উন্নীত করার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। ১৯৭০ এর দশকের তুলনায় বাংলাদেশ সমকালে আলোকিত ও প্রযুক্তিভিত্তিক উৎপাদনযোগ্য সমাজে রূপান্তরিত হয়েছে বলা চলে। ১৯৭০ থেকে ২০১০ শতকের বিদ্যমান দারিদ্র্যের অভিঘাত ২০১০ থেকে ২০২০ শতকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে কমে এসেছে। দারিদ্র্যের অভিঘাত ২০১৯ এর ২০.৫% থেকে ২০২৫ সালে ১৫.৬ এ নেমে আসবে বলে প্রক্ষেপিত হয়েছে। চরম দারিদ্র্য ২০১৯ এর ১০.৫% থেকে ২০২৫ এ ৭.৪% নেমে আসবে বলে পরিকল্পিত। প্রবৃদ্ধি অর্জন ও দারিদ্র্য বিমোচনের প্রক্রিয়ায় দরিদ্র, সামাজিকভাবে দূরে থাকা জনগোষ্ঠী, যথা- ভিক্ষুক, উপজাতীয়, নদী ভাঙ্গা ও প্লাবন বিধ্বস্ত অসহায় জনগোষ্ঠী, তৃতীয় লিঙ্গ, সমাজ পরিত্যক্ত গোষ্ঠী হিজড়া ও দেহজীবী নারীগণকে সরকার থেকে আয় সহায়তা ও হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। সামাজিক প্রতিরক্ষণে ২০১৯ এর জিডিপির ১.২% থেকে বরাদ্দ ও ব্যবহার ২০২৫ সালে জিডিপির ২% উন্নীত হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় দেশে বিদ্যমান ৩০ শ্রেণীর ৫ মিলিয়ন দলিতদের সমাজ ও কর্মজীবনের মধ্যস্রোতে আনা হচ্ছে। ১৯৭০ থেকে ৯০ এর দশকের তুলনায় ৫০ বছরের এখনকার বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক ভাবে উন্নত ও দ্রুত অধিকতর উন্নয়নের পথে আত্মবিশ্বাসী অভিযাত্রী। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে দেশবাসী দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিব শতবর্ষে এই প্রেক্ষিতে জাতির জনকের স্বপ্ন অনুযায়ী সোনার বাংলা আমাদের সকলের চোখের সামনে কোভিড-১৯ এর সাময়িক ব্যত্যয়াদি এবং মুষ্টিমেয় মৌলবাদীদের বিরোধিতা সত্ত্বেও নিশ্চিত উজ্জ্বল সম্ভাবনার দিক নির্দেশ করছে। লেখক : সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী
×