ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

ইলিয়াস উদ্দীন বিশ্বাস

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন

প্রকাশিত: ২০:৪২, ১৮ এপ্রিল ২০২১

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন

গণফোরামের ড. কামাল হোসেন একজন আইন বিশেষজ্ঞ ও দেশের সংবিধান প্রণেতাদের অন্যতম। তিনি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘তারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংশোধন নয়, আইনটা বাদ দেয়ার পক্ষে।’ ড. আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক। তিনিও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিপক্ষে। শুধু তারাই নন, অনেকেই এই আইনের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। আমি আইনের মানুষ নই, একজন নাগরিক হিসেবে সাধারণ বোধবুদ্ধি থেকে এ বিষয়ে আমার কিছু কথা তুলে ধরলাম। যতদূর জেনেছি, লেখক মুশতাক আহমেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল সোশ্যাল মিডিয়ায় উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রচার ও সরকারের বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানো, ‘জাতির জনকের প্রতিকৃতি’, ‘জাতীয় সঙ্গীত’ এবং ‘জাতীয় পতাকা’কে অবমাননা। এ কারণেই ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তিনি গ্রেফতার হয়ে কারাগারে ছিলেন। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে কাশিমপুর কারাগার থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি হাসপাতালে নিলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে অনেকেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে সোচ্চার। যে কোন মৃত্যুই দুঃখজনক, সেটা স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক যেটাই হোক না কেন। তবে অস্বাভাবিক মৃত্যু মানুষকে নাড়া দেয় বেশি। আইন মানুষের কল্যাণের জন্য হয়ে থাকে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আইনের অপপ্রয়োগ যুগ যুগ ধরেই হয়ে আসছে বিভিন্ন দেশ ও সমাজে। তাই তো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘প্রশ্ন’ কবিতায় লিখেছেন- আমি যে দেখেছি গোপন হিংসা কপট রাত্রিছায়ে/হেনেছে নিঃসহায়ে,/আমি যে দেখেছি প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে/বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। আমি এক দশক ধরে ফেসবুক ব্যবহার করে আসছি। ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন মানুষের জীবনযাত্রা ও যোগাযোগকে অনেক সহজতর করেছে, তেমনি এর অপব্যবহার মানুষকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। সংবাদপত্র সম্পাদনা করেই প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ, এতে তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করা হয়। অবশ্য এখানে হলুদ সাংবাদিকতা বলে একটা কথা আছে। তবে এর প্রতিকারের ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কি সে ধরনের কোন ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে? এসব মাধ্যমে যে যার মতো করে সত্য-মিথ্যা যা খুশি বানিয়ে লেখে ও স্মার্টফোন দিয়ে গোপনে ছবি তুলে তা আপলোড করে মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে- সেটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। বিশেষ করে এর শিকার বেশি হচ্ছে নারীরা। এতে আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছে অনেকে। এমন অজস্র ঘটনার কয়েকটি তুলে ধরলাম। * কুষ্টিয়ায় সংখ্যালঘু পরিবারের কলেজ পড়ুয়া মেয়েকে প্রতারণার মাধ্যমে ধর্মান্তর ও বিয়ে করেছে এক ভ-। এখানেই শেষ নয়, মেয়েটিকে নির্যাতন ও মাথার চুল কেটে ফেসবুকে নগ্ন ছবি পোস্ট করেছে ওই লম্পট। প্রাণনাশেরও হুমকি দিচ্ছে। উপায়ান্তর না দেখে কুষ্টিয়া মডেল থানায় লিখিত অভিযোগ করেছে মেয়েটি। পুলিশ সোমবার সন্ধ্যায় শহরের শাপলা চত্বর থেকে প্রতারক নাজমুল হোসেনকে গ্রেফতার করেছে। (যুগান্তর ০২/১০/১৮) * বিউটি ম-লের মুখম-লের সঙ্গে বিবস্ত্র এক মেয়ের ছবি জোড়া লাগিয়ে আপত্তিকর ছবি বানানো হয়। এরপর আপত্তিকর কথা লিখে ও মুঠোফোন নম্বর দিয়ে ছবিটি একটি ফেসবুক আইডি থেকে পোস্ট করা হয়। ফেসবুকে এই আপত্তিকর ছবি ছড়িয়ে দেয়ার জেরে সেই কিশোরী আত্মহত্যা করেছে বলে অভিযোগে মামলা হয়েছে। (প্রথম আলো, ১০/০৯/২০২০) * নওগাঁর এক কলেজছাত্রীর অনৈতিক সম্পর্কের গোপন ভিডিও ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়ার হুমকির অভিযোগে সাইদিস হাসান সনি নামের এক কলেজছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়েছে। (সোনার দেশ, ০৮/০৪/২১) * বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলায় ফেসবুকে নগ্ন ছবি পোস্ট করা ও বারবার অনৈতিক প্রস্তাবের যন্ত্রণা সইতে না পেরে দিশা মজুমদার (১৭) নামের এক কলেজছাত্রী আত্মহত্যা করেছে। (দৈনিক শিক্ষা ২৭/০৯/১৮) * রাজশাহীতে এক সরকারী চাকরিজীবীর নগ্ন ছবি ও ভিডিও ধারণ করে সামাজিক মাধ্যমে দেয়ার হুমকি দিয়ে চাঁদা দাবি করা প্রতারক চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। (বাংলা ট্রিবিউন)। এক সময় আলেমদের অনেকেই ফতোয়া দিতেন, টিভি দেখা হারাম। টিভি দেখা আর ইউটিউব দেখার মধ্যে কি এমন পার্থক্য আছে সেটা তো সবারই জানা। আলেম নামধারী কিছু ব্যক্তি বিদ্বেষপ্রসূত ও উস্ককানিমূলক বক্তব্য ইউটিউবে প্রচার করে কিংবা ফেসবুকে লাইভে এসে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে জানমালের ক্ষতি সাধন করছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাজুড়ে ২৬-২৮ তারিখের হেফাজত কর্মীদের সহিংসতা তার এক জ¦লন্ত উদাহরণ। এমন সব অজস্র ঘটনা দেশে ঘটছে এবং এসব কি ডিজিটাল অপরাধ নয়? এই ধরনের ডিজিটাল অপরাধ রোধে করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংশোধন-সংযোজনের প্র্রস্তাব না দিয়ে আইনটা একেবারে বাদ দেয়ার পক্ষে ড. কামাল হোসেনের এমন বক্তব্য আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ যেন না হয় আর শক্তের অপরাধে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে যেন না কাঁদে, সেদিকে সরকারের সজাগ দৃষ্টি রাখা একান্তভাবে উচিত। লেখক : উপাচার্য, নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ; শিক্ষাবিদ ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক
×